বগুড়া জেলা রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলার মধ্যে অন্যতম একটি জেলা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মহাস্থানগড় এবং বগুড়ার দই এর জন্য বিখ্যাত এই জেলাকে উত্তরবঙ্গের রাজধানী বলা হয়ে থাকে। যার জেলা ব্রান্ডিং এর ট্যাগ লাইন Land of Pundra Civilization এবং বিশেষ পণ্য দই এবং আলু। পেন্ডামিক সিচুয়েশন শুরু হওয়ার পর থেকে বগুড়ার অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টেছে।
২০১৯ সাল পর্যন্তও হাতে গোনা কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ছিল বগুড়াতে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এবং কোভিড-১৯ এর প্রভাবে সারা বিশ্ব এবং বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার পাশাপাশি বগুড়াতেও ই-কমার্স বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বেচা বিক্রি এবং কেনাকাটা দুই ক্ষেত্রেই মানুষ এখন অনলাইনকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আর সেজন্যই গত দেড় বছরে অনলাইনে ক্রেতার সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েছে বিক্রেতার সংখ্যাও। অনেকে পেন্ডামিক সিচুয়েশনে নিজের জব হারিয়ে ই-কমার্সে ঝুঁকেছেন। অনেক মহিলারা নিজেদের প্রতিভাকে পূঁজি করে, নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে নিজের স্বপ্নগুলোকে ডানা দিয়েছেন। ধরেছেন সংসারের হাল। অনেক শিক্ষার্থীও পড়াশোনার পাশাপাশি এখন বগুড়া জেলা থেকে ই-কমার্সের সঙ্গে জড়িয়েছেন।
যত দিন যাচ্ছে ততই ই-কমার্স জনপ্রিয়তা লাভ করছে। বাড়ছে অনলাইন ভিত্তিক উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীর সংখ্যা। গত বছর যেখানে বগুড়াতে অনালাইন ভিত্তিক উদ্যোক্তা সংখ্যা শতকের ঘরে ছিল এখন তা হাজারের ঘরে চলে এসেছে। তবে সুখের কথা এই যে অনেকেই কিছু না জেনে ই-কমার্সে আসলেও নিজদেরকে দক্ষ করার কাজে মন দিয়েছেন। নিজেদের উদ্যোক্তা জীবনকে সম্মৃদ্ধশালী করতে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ,অনলাইন ওয়ার্কশপ এবং ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করছেন।
বগুড়া জেলার অর্থনীতি মূলত শিল্প,ব্যবসা বাণিজ্য এবং কৃষির ওপরে নির্ভরশীল। কৃষিক্ষেত্রে বেশ সমৃদ্ধশালী এই জেলা। বগুড়ার আলু অত্যন্ত জনপ্রিয়। বগুড়ায় উৎপাদিত আলু প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে দেশের বাহিরে যাচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ আলুই উৎপাদিত হয় বগুড়া এবং জয়পুরহাট জেলায়। বগুড়া জেলায় উৎপাদিত বিখ্যাত ফাটা পাকড়ী, লাল পাকড়ী আলুর চাহিদা রয়েছে সারা দেশে। এছাড়া বগুড়ার হাগরাই আলুও বেশ জনপ্রিয়। যা অত্যন্ত আঠালো এবং সুস্বাদু। আমাদের আশেপাশের অনেক দেশেই আলুর চাহিদা রয়েছে ব্যপক তাই রপ্তানি ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। আর যেহেতু ই-কমার্সের কল্যাণে এখন পণ্য সম্পর্কে জানানো সহজ হয়েছে তাই আশা করা যায় বগুড়ার বিখ্যাত আলুর চাহিদা দিনদিন আরও বাড়বে। গত বছর বগুড়া থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন আলু বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে।
বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলায় ঘোলাগাড়ি গ্রামে রয়েছে বেনারসি তাঁত শিল্প। যদিও অন্যান্য অঞ্চলের তাঁত শিল্পের মত বগুড়ার বেনারসি পল্লীও এখন বিলুপ্তির পথে। তবে এই বিলুপ্তি ঠেকাতে বর্তমান জেলা ভিত্তিক পণ্য নিয়ে কন্টেন্ট আশার আলো হয়ে এসেছ।
এছাড়া বগুড়ার লাল মরিচেরও বেশ চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন গুড়া মসলার কোম্পানিগুলো যারা প্যাকেটজাত মসলা গুড়া বিক্রি করেন তারা বগুড়ার লাল মরিচ অনেক বেশি পরিমাণে কিনে থাকেন। বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট, গাবতলি উপজেলা বিশেষ করে চরাঞ্চলে লাল মরিচের চাষ অনেক বেশি হয়ে থাকে।
আদমদিঘী উপজেলার মৃৎশিল্প অনেক পুরোনো শিল্প। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মাটির তৈজসপ্ত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহি মৃৎশিল্প। তবে আশা করা যায় খুব শীঘ্রই এ নিয়ে অনেক অনেক কন্টেন্ট আসবে এবং অন্যান্য দেশি পণ্যের মত এই পণ্যেও নতুন করে মাত্রা যোগ হবে।
বগুড়ার তৈরি জালি টুপি বেশ বিখ্যাত। ঈদের আগে এই টুপির চাহিদা বেড়ে যায়। তবে অনেকেই এই টুপি সম্পর্কে অবগত না থাকায় এর বাজার এখনো অনেক বেশি বিস্তৃত হতে পারে নি।
বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলায় তৈরি শন এবং বেতের ঝুড়িরও বেশ চাহিদা রয়েছে দেশে এবং বিদেশে। এরই মধ্যে বিশ্বের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এই ঝুড়ি। বর্তমানে প্লাস্টিকে ছেয়ে যাওয়া বাজারে নতুন করে এই ঝুড়ি নিয়ে আশার আলো জাগিয়েছে ই-কমার্স।
শুধু এ কয়টি পণ্যই নয়, গামছা,মাদুর,শাওইলের তাঁত শিল্প,বগুড়ার বিখ্যাত ঝুরি ভাজা,ভুট্টা,রাইস ব্র্যান অয়েল, পাটজাত সুতা ও পাটের তৈরি ব্যাগ এবং বিভিন্ন সবজির বীজেরও রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
আর এই জেলা ভিত্তিক পণ্য গুলো ই-কমার্সে তুলে ধরতে বগুড়ার উদ্যোক্তারা বেশ ভূমিকা পালন করছে। তারা ফেসবুক ভিত্তিক ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ গ্রুপে সময় দিয়ে, নিজেদের লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি করে জেলার বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করছে। এর ফলে বগুড়া জেলার পণ্য সম্পর্কে সারা দেশ তো বটেই পাশাপাশি বিশ্ব দরবারেও পৌঁছে যাচ্ছে।
ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি এবং সার্চ ইংলিশ এর ফাউন্ডার রাজিব আহমেদ এর প্রচেষ্টায় এবং দিক নির্দেশনায় উদ্যোক্তারা ইংরেজি নিয়েও পড়াশোনা করে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করছে। কারণ রাজিব আহমেদ মনে করেন, বাংলার পাশাপাশি ইউটিউবে যদি ইংরেজিতে জেলা ভিত্তিক বিভিন্ন কন্টেন্ট থাকে তা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ হবে। এতে করে খুব সহজেই আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলার পণ্য সম্পর্কে সবাই জেনে যাবে। আর এ কাজ করতে গেলে অবশ্যই আগে নিজেদেরকে দক্ষ হতে হবে। আর এই দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রিডীং সিলেবাস,১০ মিনিট রাইটিং পোস্টসহ বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ গ্রুপে। তাই অন্যান্য জেলার ন্যায় বগুড়ার অসংখ্য উদ্যোক্তা ১০ মিনিটা রাইটিং পোস্ট লেখাসহ রিডিং সিলেবাস পড়ছে এবং নিজেদেরকে তৈরি করছে। তারা নিজেদের উদ্যোগের পাশাপাশি তারা নিজেদের জেলাকে বিশ্ব দরবারে তুলে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে চায়।
তবে বগুড়া থেকে শুধু উদ্যোক্তারাই নয় অনেক শিক্ষার্থীও নিজেদের বেসিক ডেভেলপের জন্য এই রিডিং সিলেবাস কমপ্লিট করছে। তার মধ্যে বগুড়ার সরকারি শিশু পরিবার বালিকা থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী এই রিডিং সিলেবাস পড়ছে। তারা বেশ উৎসাহের সাথে সবাই মিলে পেন্ডামিকে ঘরবন্দী সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছে। উদ্যোক্তা এবং শিক্ষার্থী মিলিয়ে এখন ৫০ জন এই রিডিং সিলেবাসের সাথে সংযুক্ত আছে বগুড়া জেলা থেকে। এই রিডিং সিলেবাসটি বর্তমানে একটি মডেলের মাধ্যমে অনুসরণ করা হচ্ছ্ যার নাম করণ করা হয়েছে ময়মনসিংহের একজন সফল এবং পরিশ্রমী উদ্যোক্তা আরিফা খাতুনের নামে।তিনিই প্রথম জেলাভিত্তিক কন্টেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছে এই রিডিং সিলেবাসের মধ্য দিয়েই , তাই এই নামকরণ করেছেন ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জনাব, রাজিব আহমেদ। যেহেতু এটি একটি পাবলিক গ্রুপ তাই যে কেউ এই গ্রুপে কিছুক্ষণ সময় দিলে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
সর্বপরি, জেলাভিত্তিক ই-কমার্সে এই রিডিং সিলেবাস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেই আশা করা যাচ্ছে, কারণ ইতিমধ্যেই ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ গ্রুপের এবং রিডিং সিলেবাসের কল্যাণে আমরা জেলাভিত্তিক অনেক অজানা পণ্য সম্পর্কে বিভিন্ন কন্টেন্ট পেতে শুরু করেছি। বগুড়া জেলার পণ্যগুলোও উঠে আসতে শুরু করেছে।