খাতুনে জান্নাত আশা, ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি, টেকজুম টিভি// অনুর্বর মাটিতে সোনা ফলে! হ্যাঁ, এমন ভাবনাই প্রথমে আসবে আপনার মাথায় এই অর্থকরী শস্যের কথা প্রথম জানার পর! আপনি হয়ত একে অন্য নামে চিনে থাকবেন “শিমুল আলু” অথবা “কাঠ আলু”। এর পাতাগুলো দেখতে শিমুল গাছের পাতার মতো বলে শিমুল আলু বলা হয়ে থাকে একে। তবে সারাবিশ্বে এটি “কাসাভা(Cassava)” নামেই সর্বাধিক পরিচিত এবং পরম সমাদৃত স্টার্চ এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি শস্য, যা সারাবিশ্বের ২০০ মিলিয়নেরও অধিক জনগোষ্ঠীর খাবার চাহিদা পূরণ করে চলেছে। এটি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম শর্করা উৎপাদনকারী ফসল, যা বিশেষভাবে বিশ্বের উষ্ণপ্রধান দেশের প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে এই সোনার ফসলের কদর দেরীতে বুঝতে পারায় বহুবছর অবহেলিত আবর্জনার মতো এটি পাহাড়ি এলাকায়, বনে জঙ্গলে বিচ্ছিন্নভাবে জন্মাত, যার ব্যবহার খাদ্য হিসেবে খুব কম মানুষই করত। তবে দেরিতে হলেও এর সম্ভাবনা বুঝতে পারায় বর্তমানে কাসাভা বানিজ্যকভাবে চাষ হচ্ছে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে।
কাসাভার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এটি উচ্চ তাপমাত্রা সহিষ্ণু এবং খরা প্রবণ এলাকার অনুর্বর মাটিতেও অনেক ভালো জন্মে যেখানে অন্য কোনো ফসল জন্মানোর প্রায় সম্ভাবনাই থাকে না। আর তাই বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য তালিকায় কাসাভার ব্যবহার খাদ্য এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। খ্রীষ্ট পূর্ব ৪০০০ হাজার বছর পূর্বে কাসাভার উৎপাদন শুরু হলেও বাংলাদেশে ১৯৪০-৪১ সালের দিকে কাসাভা গাছ নিয়ে আসে খ্রীস্টান মিশনারিরা।
কাসাভা আলু যেহেতু অনুর্বর মাটিতেও ভালো জন্মায়, তাই এই আলু চাষ করে অনেক অনুর্বর পতিত জমিকে কাজে লাগানো যায়। তবে যদি কেউ উর্বর জমিতে কাসাভা চাষ করে, তবে এর সাথে অন্য ফসলও চাষ করা যায়। বিভিন্ন দেশের মানুষ কাসাভা আলুর সাথে আরও কিছু ফসল চাষ করে থাকে আফ্রিকা ও ল্যটিন আমেরিকায় কাসাভা আলুর সাথে ৯০ ভাগ চাষ করে তাদের জাতীয় ফলস ও শাক শবজি, ভারতে এর সাথে চাষ করে শিম, মোটর ডাল, পেঁয়াজ, চিনাবাদাম সহ নানা রকম শাক সবজি, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড কাসাভা আলুর সাথে নারিকেল, পাম ওয়েল, রাবার বাগান সহ শাক-শবজি চাষাবাদ করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় কাসাভার সাথে ধান ও ভূট্টা চাষ করা হয় আর বাংলাদেশে কাসাভা আলুর সাথে কচু ও সরিষা আবাদ করা হয়। কাসাভা আলুর ফলন তুলনামূলক অনেক বেশি হয় একটি গাছ থেকে ১৮ থেকে ২২ কেজি কাসাভা আলু ফলন দেয়। সাধারনত প্রতি হেক্টর জমিতে ৩০ থেকে ৩৫ টন কাসাভা আলু ফলন দেয়। তবে ভাল ফলন হলে প্রতি হেক্টর জমিতে ৫৫ থেকে ৬০ টন কাসাভা আলুর চাষ পাওয়া সম্ভব। আর অতিবৃষ্টিতে জমিতে পানি জমে থাকা ছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই আলু নষ্ট হয় কম, এতে সার কীটনাশকও লাগে কম, তাই এগুলো চাষে রিস্ক এবং খরচ কম কিন্তু লাভ অনেক। তাই বর্তমানে কৃষকরা এগুলো চাষে আগ্রহী হচ্ছে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে ব্যাপক পরিসরে উৎপাদিত হচ্ছে কাসাভা আলু। এই অঞ্চলগুলোর মাঝে ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা, গারো পাহাড় অধ্যুষিত অঞ্চল যেমন-হালুয়াঘাট, নেত্রকোনা সহ আরও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই আলুর চাষ হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে। বেসরকারি উদ্যোগে যারা দেশে কাসাভা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল- প্রান আরএফএল গ্রুপ। ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের তারা প্রশিক্ষন দিয়ে, কাসাভা আলুর বীজ দিয়ে উৎপাদন করিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ কাসাভা, যা দিয়ে আর তৈরী করছে বিভিন্ন খাদ্যের কাঁচামাল এবং রপ্তানী করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
কাসাভার পুষ্টিগুণঃ
কাসাভায় সাধারনভাবে ৩০-৪০ ভাগ শর্করা , ১-২ ভাগ প্রোটিন, এবং ৫৫-৬০ ভাগ জলীয় অংশ বিদ্যমান । আলুর তুলনায় কাসাভাতে দ্বিগুনেরও বেশী শর্করা থাকায় এটা আলুর চেয়ে আনেক বেশী পুষ্টিকর । যেখানে আলুতে ১৮ ভাগ শর্করার মাত্র ১৬.৩ ভাগ স্টার্চ হিসাবে থাকে সেখানে কাসাভার ৪০ ভাগ শর্করার ৯০ ভাগই স্টার্চ হিসাবে থাকে। এছাড়াও কাসাভাতে ক্রুড ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও ভিটামিন সি অনেক বেশি পরিমানে পাওয়া যায়।
রোগ নিরাময়ে কাসাভাঃ
কাসাভা আলু মানুষের জন্য কত রোগ নিরাময় হিসেবে কাজ করে। কাসাভার একটি অংশ আঠালো থাকে যা থেকে রস বের হয়, এই আঠালো অংশ ডায়াবেটিকস ও হৃদ রোগের জন্য কাজ করে, কাসাভা আলুতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ফাইবার যা শরীরের বাড়তি কোলেস্টরল দুর করে। ডায়াবেটিস রোগীদেরকে গোল আলু, মিষ্টি আলু কম খেতে বলা হলেও কাসাভা আলু খাওয়ায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এছাড়াও কাসাভা আলু ক্যান্সারজনিত সকল রোগের ঔষধ হিসবে কাজ করে ক্যান্সার নিরাময়ে ভূমিকা রাখে।
কাসাভা আলুর ব্যবহার ও প্রক্রিয়াজাতঃ
কাসাভা আলুকে প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে আটা ও স্টার্চ পাওয়া যায়। এই আটা দিয়ে বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরী সম্ভব, এছাড়াও ওষধ, ক্যামিকেল এবং গার্মেন্টস শিল্পেও এর স্টার্চ ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রতি কেজি আলু থেকে আটা ও স্টার্চ মিলিয়ে প্রায় ৩৪০ গ্রাম পর্যন্ত উৎপাদন করা সম্ভব। এক হেক্টর জমি থেকে বছরে প্রায় ২৫.৫ মেট্রিক টন অর্থাৎ ৩ হাজার ৪০০ কেজি কাসাভা আটা ও স্টার্চ পাওয়া সম্ভব।
- কাসাভা আলুর টিউবার পুড়িয়ে মিষ্টি আলুর মতো খাওয়া যায়,
- এগুলোকে সিদ্ধ করে মাংস, মাছ, শুটকি এবং অন্যান্য তরকারি রান্নায়ও গোল আলুর মত ব্যবহার করা যায়,
- কাসাভা থেকে প্রাপ্ত স্টার্চ কাগজ শিল্পে, বেকারী শিল্পে, ঔষধ শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে, জুস, জ্যাম-জেলি, গ্লুকোজ, অ্যালকোহল, আটা, গাম, তৈরীতে ব্যপকভাবে ব্যবহার হয়,
- এর স্টার্চ/আটা গমের আটার সংগে মিশিয়ে রুটি, পরাটা, কেক ইত্যাদি তৈরী করা যায়, বার্লি, সুজি, রুটি, নুডলস, ক্র্যাকার্স, কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, পাঁপড়, চিপসসহ নানাবিধ খাদ্য তৈরি করা যায়,
- গার্মেন্টস শিল্পে কাপড়ে মাড় দিতে কাসাভার স্টার্চ ব্যবহৃত হয়,
- এছাড়াও কাসাভা আলুর পিলেট, আটা মুরগি, গরু, মহিষ, ছাগল, মাছ, ইত্যাদির জন্য একটি বিকল্প খাদ্য হতে পারে। প্রক্রিয়াজাত পাতা পোল্ট্রি ও বিভিন্ন পশুর প্রোট্রিনজাতীয় খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
** কাসাভার ই-কমার্স সম্ভাবনা ও দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাবঃ
কাসাভা উৎপাদন বিপণনকে কেন্দ্র করে তৈরী হতে পারে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স উদ্যোক্তা। কারণ শুধু দেশে নয় সারাবিশ্বেই কাসাভার ব্যবহার হয় ব্যাপক পরিসরে। এটি সর্বাধিক উৎপাদিত হয় বিশ্বের খাদ্য এবং স্টার্চের চাহিদা পূরণে। অনেক খাদ্য এবং পণ্যের কাঁচামাল এই কাসাভা এবং এ থেকে উৎপাদিত স্টার্চ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল- বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে এবং ঔষধ শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রচুর পরিমাণ স্টার্চ দেশের বাইরে থেকে আমদানী করা হয়ে থাকে, অথচ দেশের অনুর্বর পতিত জমি কাজে লাগিয়ে কাসাভা উৎপন্ন করে এ থেকে প্রক্রিয়াজাত স্টার্চ উৎপাদন করলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করেও প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স অর্জন করা সম্ভব। যা হতে পারে আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। অলরেডি সরকার এ নিয়ে কাজ শুরু করছে এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপও বানিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন বিপণন শুরু করেছে এটা বেশ আশাব্যঞ্জক।
ক্ষুদ্র পরিসরেও তাই কাসাভা নিয়ে কাজ করতে পারে আমাদের অঞ্চলের স্থানীয় উদ্যোক্তারা। কাসাভা যেহেতু একটি পুষ্টিকর খাদ্য, রোগ প্রতিরোধক। তাই উদ্যোক্তারা চাইলে স্থানীয় ভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সহায়তা নিয়ে কাসাভা উৎপন্ন করে শুকনো কাসাভা আলু অথবা রেডি টু কুক কাসাভা আলুও প্যাকেজিং করে ই-কমার্সের মাধ্যমে সারাদেশে বিপণন করতে পারে। আবার একে প্রক্রিয়াজাত করে স্টার্চ উৎপন্ন করেও প্যাকেজিং করে সারাদেশে সাপ্লাই করতে পারে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরির উপযোগী করে, আবার বড় পরিসরে উৎপন্ন করলে হোল সেলার হিসেবেও বিভিন্ন বেকারিতে, ঔষধ কোম্পানি বা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সাপ্লাই দিতে পারে। আবার দেশের বাইরেও রপ্তানীর সুযোগ তৈরী করে নিতে পারে।
সর্বোপরি বলা যায়, কাসাভা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে পাটের পরই সোনার ফসল হিসেবে অবদান রাখতে পারবে, সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে যদি সঠিকভাবে এর উৎপাদন, বিপণন, প্রচার এবং প্রসার করা যায়।