ফারিয়া ওমর ঝুমুর, মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি,টেকজুম.টিভি// “মাথার উপর নীল আকাশ,নিচে টলটল করা স্বচ্ছ পানি, সে পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছেকচুরিপানা,শাপলা,কলমি।পানির নিচে বিভিন্ন প্রজাতির দেশিয় মাছ।পাশেই জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরছে। চারপাশে তাকালে সবুজ আর সবুজ গাছ-গাছালি,ঝকঝকে রোদ,পাখিদের কিচিমিচি করা শব্দ।” এই অংশটুকি পড়ার পর মনে হবে ছোট বেলায় চিত্রাংকন খাতায় আকা কোন গ্রামীন দৃশ্যের বিবরন দিচ্ছি।কিন্তু না,এই দৃশ্য কোন চিত্রাংকন খাতায় আকা চিত্র না,এই চিত্র হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ আড়িয়াল বিলের।
বিশ্বাস না হলে, নিজেই চলে আসেন বর্ষার সময় আড়িয়াল বিলে।ভ্রমনপ্রেমীদের জন্য প্রকৃতিতে হারিয়ে যাওয়ার রাজ্য হচ্ছে এই আড়িয়াল বিল৷
মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর,সিরাজদিখান উপজেলা ও ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার বিস্তৃত জুড়ে রয়েছে এই আড়িয়াল বিল।ঢাকার সবচেয়ে বড় এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল হচ্ছে আড়িয়াল বিল।এর আরেক নাম হচ্ছে চূড়াইন বিল।
আড়িয়াল বিলে রয়েছে অসংখ্য ডেঙ্গা,এগুলোকে মূলত বিশাল আকৃতির দীঘি যায়।সবচেয়ে বড় দীঘির নাম হচ্ছে সাগরদীঘি।এই দিঘীগুলোই হচ্ছে প্রাকৃতিক মাছের আবাস্থল।
আড়িয়াল বিল একই সাথে পর্যটন শিল্প, শস্য উৎপাদন, মৎস উৎপাদনে ব্যপক অবদান রাখে।চলুন সে অবদানের কারনগুলো জেনে নেওয়া যাক____
মৎস উৎপাদনে আড়িয়াল বিলঃ
আড়িয়াল বিলে প্রায় সব রকমের দেশি মাছ পাওয়া যায়।তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,সরপুটি,কৈ,৫ জাতের রুই, বোয়াল,কাতলা,টেংরা সহ নানারকম ছোট-বড় মাছ।সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সরপুটি ও কৈ মাছ।এই বিলের এক একটা কৈ মাছ হাজার টাকা পিস হিসেবেও বিক্রি করা হয়।মাছগুলো দেখতে যেমন স্বচ্ছ,খেতেও তেমন সুস্বাদু।কথিত আছে,অতীতে এই বিল থেকে মাছ ভারতে পাঠানো হত ঘোড়ায় চেপে। বর্তমানে এই মাছ ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের মাছ ব্যবসায়ীরা পাইকারি মূল্যে কিনে নিয়ে যায় রোজ।
মূলত বেশিরভাগ মাছ ডেঙ্গায় চাষ করা হয় তবে প্রাকৃতিক নিয়মেই বেড়ে উঠে এই মাছ।বর্ষাকালে ডেঙ্গার নালা খুলে দেয়া হয়,তারপর মাছের পোনা গুলো পুরো বিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।প্রাকৃতিক নানারকম জলজ উদ্ভিদ খেয়ে একসময় বড় হয়ে ফিরে আসে আবার নিজের আবাসস্থলে।এই পুরো চমৎকার ব্যাপারটাই ঘটে প্রাকৃতিক নিয়মে।শীতে বিলের পানি কিছুটা শুকিয়ে আসলে জেলেরা নেমে যায় মাছ ধরতে।পরে সে দেশি মাছ রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রির জন্য যায়।
বর্তমানে দেশিয় মাছের চাহিদা শহরে অনেক বেশি।সে চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে উঠেছে ই-কমার্স খাতে রেডি টু কুক উদ্যোক্তারা।যাদের কাজ হচ্ছে মাছ কেটে,বাছাই করে,ধুয়ে একদম রেডি করে ভোক্তাদের নিকট পৌছে দেয়া।এইসকল ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের জন্য আড়িয়াল বিল এর মাছ এক নতুন সম্ভাবনার নাম। যেহেতু আড়িয়াল বিল এর সাথে রাজধানী ঢাকার যোগসূত্র বেশ ভালো,সে হিসেবে শহরের দরজায় দরজায় টাটকা দেশী মাছ পৌছে দেয়া যাবে খুব সহজেই।
শস্য উৎপাদনে আড়িয়াল বিলঃ বর্ষাকালে টুইটুম্বুর আড়িয়াল বিলের মাছের সাথে আরেকটা জিনিস ও দেখা যায়, সেটা হচ্ছে শাপলা।পুরো বিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে শাপলা।এই শাপলা গুলো প্রাকৃতিক ভাবেই ফোটে।আশেপাশের অনেকই তখন এই শাপলা তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। কোন প্রকার খরচ ছাড়াই বর্ষার মৌসুমে লাখ লাখ টাকার শাপলার আটি বিক্রি করা হয়।বর্ষা চলে যায়,আসে শীত।সে সময় বিলের অনেক পানিই শুকিয়ে যায়।কিন্তু চিরঋনী এই বিল তখন আমাদের দিয়ে যায় উর্বর জমি।সেই জমিতে ধান চাষ করা হয়,পাশাপাশি চাষ করা হয় আলু,ঢেরস,মিষ্টিকুমড়ার মত বিভিন্ন সবজি।
উৎপাদিত এত ফসলের মধ্যে মিষ্টিকুমড়া নজর কাড়বে বেশি। বর্ষা শেষে কচুরিপানার স্তুপে কুমড়ার বীজ রোপন করা হয়।মূলত আশ্বীন মাস থেকে কুমড়ার বীজ রোপন শুরু হয়।শীতের শেষের দিকে জমি থেকে পাকা মিষ্টি কুমড়া তোলা হয়।উৎপাদিত এক একটা মিষ্টি কুমড়া প্রায় দুই মন ওজনের কাছাকাছি ও হয়ে থাকে।সে মিষ্টি কুমড়াকে কেজি মাপে,পাশাপাশি ভাগ করে টুকরা মাপেও বিক্রি করে মুন্সিগঞ্জ সহ,রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে।আড়িয়াল বিলের মিষ্টি কুমড়ার মত এত চমৎকার মিষ্টি কুমড়া খুব কমই দেখা যায়।
পাকা মিষ্টি কুমড়া থেকে বিচি বাছাই করে,পরিষ্কার করে,শুকিয়ে ও বিক্রি করা হয় কেজি মাপে। এইসব শুকনো বিচিগুলো ড্রাই ফ্রুটস এর সাথে মিশিয়ে বিক্রি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তারা।
বর্তমানে মাঠ পর্যায়ের অনেক কৃষকরাই অনলাইনের মাধ্যমে কাচা শাক-সবজি বিক্রি করছেন,পাশাপাশি ফ্রেশ ড্রাই ফ্রুটস নিয়েও কাজ করছেন অনেকে।এই খাতে আড়িয়াল বিলের মিষ্টিকুমড়া সহ বিভিন্ন সবজি বিক্রি করার একটা ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে নতুন উদ্যোক্তাদের।
পর্যটন শিল্পে অবদানঃ প্রতিবছরই বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন আসেন বর্ষার আড়িয়াল বিল কে সঙ্গ দিতে,প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে।অনলাইনের মাধ্যমে যদি আড়িয়াল বিলের সৌন্দর্যের প্রচার করা যায়, তাহলে দিনকে দিন পর্যটনের সংখ্যা বাড়বে কোন সন্দেহ ছাড়াই। একইসাথে এইসকল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধারন করার জন্য বাড়বে ইউটিউবার,ব্লগার।এই সব নিয়ে যত প্রচার হবে অনলাইন জগতে,তত বেশি পর্যটন শিল্পে অবদান রাখবে আড়িয়াল বিল।