পোড়া ইটের মতো লালচে রং, লম্বাটে আকৃতি, ভেতরে রসালো, নরম আর কড়া মিষ্টিতে কানায় কানায় পূর্ণ আমাদের টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম যার উপর দুধ জ্বাল করে শুকিয়ে তৈরি করা মাওয়া ছিটিয়ে দেয়া থাকে। যাকে এককথায় বলা হয় মিষ্টির রাজা। একবার খেলে দ্বিতীয় বার খাবার ইচ্ছে জাগে মনে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, এই মিষ্টি একটি বা দুটি খেলে মন ভরে না, কখন যে মনের অজান্তে মুখে পুরে নিবেন এই রসালো জিনিসটা আপনি টেরই পাবেন না।
কিশোরগঞ্জ আমার শশুরবাড়ি, যখন আমাকে দেখতে এসেছিলো, তখন আমার এক ভাসুর ভর পেট খাওয়া দাওয়ার পর এক বসাতেই ১৬ টা মিষ্টি খেয়ে নিয়েছিলেন,, তখন আমার কাছে বিষয়টা হাসির মনে হলে ও এটা বুঝতে বাকি নেই যে,, কতটা জনপ্রিয়তা রয়েছে এই টাঙ্গাইলের চমচমের।
এই সুস্বাদু ও লোভনীয় চমচম টাঙ্গাইলের অন্যতম একটি ঐতিহ্য যা ২০০ বছর প্রাচীন। টাঙ্গাইল জেলা শহর থেকে প্রায় ৭ কি.মি দূরত্বে ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত পোড়াবাড়ি নামের গ্রাম থেকেই উৎপত্তি ও বিস্তৃতি এ চমচম এর।পোড়াবাড়ি নামক এই ছোট শান্ত গ্রামটির নামানুসারে ই মিষ্টির নামকরণ করা হয়েছিল পোড়াবাড়ির চমচম।
বৃটিশ আমল থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোড়াবাড়ির চমচম টাংগাইলকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। পোড়াবাড়ির চমচমই সারাবিশ্বে টাঙ্গাইল জেলাকে এনে দিয়েছে এক অনন্য পরিচিতি।আজও সবাই টাঙ্গাইলের নাম নিলে আগে চমচমের নামটাই আগে নেয়।
চমচমের প্রথম কারিগর কে এ নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে,,, অনেকের মতে যশোরথ হালই নামে এক ব্যক্তি এই চমচম প্রথম তৈরি করেন।যারা চমচম তৈরির সাথে জড়িত তাদের হালই বলে।যশোরথ নামক একজন মুনি আসাম থেকে পোড়াবাড়িতে এসে চমচম তৈরি করেন।
আবার অনেকের মতে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি বৃটিশ আমলে টাঙ্গাইলে যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়ি গ্রামে আসে।আসাম থেকে আগত এই দশরথ প্রথমে টাঙ্গাইলের যমুনার সুস্বাদু মৃদু পানি ও খাটি গরুর দুধ,চিনি,সামান্য ময়দা ও এলাচ দানার সংমিশ্রণে এই চমচম তৈরি করেন।ঘোষ ও পাল বংশের লোকেরাও বংশানুক্রমে এ মিষ্টি তৈরির সংগে জড়িয়ে আছে।
যার হাত ধরেই তৈরি হোক না কেন টাঙ্গাইলের চমচমের স্বাদ ও তৈরির মূল রহস্য এখানকার পানির মধ্যে নিহিত। দেশের অনেক জায়গা থেকেই টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির কারিগর নিয়ে অনেকেই টাঙ্গাইলের চমচম তৈরির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হতে পারেনি।এটাকে আমি আল্লাহর রহমত বলবো কারন পানির গুনে এতো স্বাদের মিষ্টি সত্যি ই আশ্চর্যজনক।
ব্রিটিশ আমলে সন্তোষ এর জমিদার পরিবারের এক মেয়ের বিয়ে ছিলো৷ আমাদের দেশের প্রখ্যাত জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সেই বিয়েতে চমচম বানানোর জন্য পোড়াবাড়ি থেকেই কিছু দক্ষ কারিগর নিয়ে যান, কিন্তু তাদের হাতের চমচম ও তেমন মজা হয়নি যেমন টা তারা পোড়াবাড়িতে বানায়। শুধু তাই নয় এখান থেকে ভারত কলকাতায় ও কারিগর নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে টাংগাইল এসে চমচম বানানো শিখে গেলেও নিজেদের জায়গায় গিয়ে আর তেমন হয়না।
টাঙ্গাইলের অন্যতম নদী বন্দর ছিলো পোড়াবাড়ি।১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে আতিয়া পরগনার শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন হযরত শাহ জামান। তিনি তখন পোড়াবাড়ি গ্রাম কে নদী বন্দর হিসেবে গড়ে তোলেন। আর এ সময়ে ধলেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীরে পোড়াবাড়ি এলাকা জুড়ে গড়ে উঠে ব্যবসা কেন্দ্র।তখনকার সময়ে একদম রমরমা ব্যবসা ছিলো । এখানের ঘাটে ভীড় জমাতো বড় বড় সওদাগর। লঞ্চ, স্টীমার, নৌকার সমাগম ছিলো সারাদিন রাত।
এছাড়াও টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে মাত্র ৩ মাইল পশ্চিমে একদা একটি ঘাট ছিল, এর নাম তালান ঘাট। সেখানেও ভীড় জমাতো সওদাগরী নৌকা, জাহাজ ও লঞ্চ। সে সময় দেশী বিদেশী ব্যবসায়ীদের পদচারনায় পোড়াবাড়ি ছিল ব্যস্ত এক ব্যবসাকেন্দ্র।
তখন জনসংখ্যা কত কম ছিলো অথচ সপ্তাহে ১৫০ থেকে ২০০ মন চমচম। এত এত চমচম ই শুধু তৈরি হতো পোড়াবাড়িতে ই, নিশ্চয় বুঝতে আর বাকি নেই যে, কি পরিমান চাহিদা ছিলো টাঙ্গাইলের চমচমের। ৪০-৫০ টা শুধু চমচম কে কেন্দ্র করে ই দোকান ছিলো।
সে সময় চমচম মিষ্টি তৈরির সাথে ছিলো আরো অনেকে রাজারাম গৌড়, কুশাইদেব, নারায়ন, কাকন হালুই, শিবশংকর গৌড়, প্রকাশ চন্দ্র, মদন গৌড় ও মোহন লাল প্রমূখ। তার পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ চলমান সময়ে খোকা ঘোষ এবং গোপাল চন্দ্র দাসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যদি ও সেই মনকাড়া, সুবাস এখন দেখা মেলানা। দিন বদলের সাথে ধলেশ্বরী তে চর জেগে উঠেছে, সেই ঘাট আর নেই, পানির ও দেখা মেলেনা, পোড়াবাড়ি ও আর রমরমা নেই। কালের গর্ভে যেন হাড়িয়ে গেছে সব। চমচম এর সাথ জড়িয়ে থাকা দীর্ঘদিনের ব্যবসায় ভাটা পরেছে। পেট না চললে ঐতিহ্য কে ধরে রাখতে পারে কজন..
সেই পেটের দায়ে অনেকে পোড়াবাড়ি ছেড়েছে, অনেকে ছেড়েছে বাপ দাদার আমলের আয় রোজগারের এই পথ। পাড়ি জমিয়েছে শহরে, চলে গেছে দূর দূরান্তে কাজের খোঁজে। পোড়াবাড়িতে গেলে একেবারে জীর্ণশীর্ণ ২-৪ টা দোকানের দেখা মেলে এখন আর তাদের পারিবারিক অবস্থা ও তেমন ভালো না। তাদের নিয়ে প্রতিবেদন করতে যায় অনেকেই কিন্তু তাতে কোন পরিবর্তন হয়নি তাদের ব্যবসার।
তবে হ্যা শহরের পাঁচআনী বাজারে এখন চমচমের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে চমচম এবং বিভিন্ন প্রকার মিষ্টিকে ঘীরে গড়ে উঠেছে ৩০-৩৫ টা মিষ্টির দোকান। এখানে সবথেকে প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান হলো জয়কালী এবং গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার। এদের দোকানের চমচম সহ সকল মিষ্টির স্বাদই অসাধারণ। হালই বংশের রাধা বল্লভ দাসের পিতামহ এই গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার এর প্রধান পুরুষ। তার ছেলেরা এখন হাল ধরেছেন এই দোকানের।
পোড়াবাড়ি বাজারে গিয়ে কথা হলো শীব শংকর( বাঙ্গালী) বাবুর পরিবারের সাথে,, তারা বংশক্রমানুসারেই এই মিষ্টি তৈরির সাথে যুক্ত, বর্তমানে তাদের পরিবারের ৫ ভাইয়ের সবারই রয়েছে মিষ্টির ব্যবসা,তাদের তৈরি মিষ্টি গুলো পৌঁছে যাচ্ছে দেশের প্রতিটি কোনায়,বর্তমানে ওর্ডার অনুযায়ী মিষ্টির সাইজের তারতম্য হয়ে থাকে।
পোড়াবাড়ি থেকে খুব ভোরে ড্রাম ভর্তি করে মিষ্টি পৌঁছে যায় সবজায়গায়,, ধলেশ্বরী নদী( আঞ্চলিক নাম এলেংজানি) ঘোলা হওয়ায় এখন আর ঐ পানি ব্যবহার করা হয় না বলে জানান তারা।এলেংজানি নদীর পানি ব্যবহার হয় না কিন্তু এলাকার পানি ব্যবহার করেই আজও তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু এই মিষ্টি।
এছাড়াও দে,নাগ,মোদক উপাধিরএরাও এই মিষ্টি তৈরির কাজ করে থাকেন।
পোড়াবাড়ির চমচম ছাড়াও টাঙ্গাইলের আরো যেসব সুস্বাদু মিষ্টি বিখ্যাত:
রসগোল্লা,দই,কালোজাম,রসমালাই,পানতোয়া,রাজভোগ,মোহনভোগ,আমিত্তি,জিলাপি, খাজা,মুড়ির মোয়া,ঢ্যাপের মোয়া,বাদামটানা, নইটানা,গজা,বাতাসা।
শুধু নামেই নয়,আকার আকৃতি আর স্বাদে গন্ধেও ভিন্নতা রয়েছে এসব মিষ্টির।প্রতিটি মিষ্টি যেন তার নিজস্ব স্বাদে ভরপুর।
টাঙ্গাইলের চমচমের অনেক চাহিদা থাকলে নেই কোন ই-কমার্স উদ্যোক্তা,, এই সেক্টরটাতে একটু কষ্ট করে লেগে থাকতে পারলে যেমন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা যেত ঠিক তেমনি দেশের মানুষের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হতো টাঙ্গাইলের তৈরি চমচমগুলো।
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছে যারা নিজেদের মিষ্টিকে পোড়াবাড়ির মিষ্টি বলে দাবি করলেও আসলে এগুলো আমাদের টাঙ্গাইলের চমচমের সুনাম নষ্ট করছে। ভালো এবং আসল মিষ্টি খেতে হলে আপনাকে আসতেই হবে টাংগাইলের পাঁচ আনী বাজারে। টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ২০-২৫ টাকা ভাড়া দিয়ে চলে যেতে পারবেন আসল চমচমের স্বাদ নিতে সাথে নিয়েও যেতে পারেন পরিবারের জন্য। তাছাড়া ও ই-কমার্স এর মাধ্যমে খুব সহজেই এখন মিষ্টি পৌছে যেতে পারে ঘরদ্বোরে৷ কেননা টাঙ্গাইল থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অন্যান্য জেলা গুলোর ভালো তাই বাস যোগে ও যেতে পারে মিষ্টি বা এখন কিছু কুরিয়ার সেবা একদিনেও খাবার আইটেম সরবরাহ করছেন। তাই ঝুকি নিতে হবে, তবেই উদ্যোগ এর সংখ্যা বাড়বে, ছড়িয়ে পরবে আমাদের মিষ্টি দেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ও ইন শা আল্লাহ।
লেখক:সূবর্ণা আক্তার
টাঙ্গাইল ফেব্রিক