রোখসানা আক্তার পপি, টাঙ্গাইল জেলার প্রতিনিধি, টেকজুম ডটটিভি // পাটের কথা মনে হলেই যেন পাটের আঁশের মৌ মৌ করা গন্ধ নাকে আসে। গ্রাম ছাড়া আমরা শহরের মানুষ রা এখন এই গন্ধ গুলোর দেখাই পাইনা। কিন্তু গ্রামে গ্রামে জমিতে এখন ও পাট তার সমহীমায় জায়গা করে আছে।
প্রাচীনকালে পাটকে বলা হতো নালিতা। বাংলাদেশ এর গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে পাট উৎপাদন হতো তাও প্রায় তিন হাজার বছর আগে। ধীরে ধীরে এর উৎপাদন বেড়েছে, পাট হয়েছে আমাদের প্রধান অর্থকারী ফসল এর মাঝে একটি। পাট আমাদের সোনালী আঁশ। পাট শুধু অর্থনীতি তে না গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে কৃষি সেক্টর এ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং কমার্শিয়াল সেক্টর এ। পাট এর মাধ্যমে প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়৷
পাট এমন একটা ফসল যার বাদ যায়না কিছুই। এর প্রতিটি অংশ আমরা ব্যবহার করি। পাটের শাক খাই যার মাঝে রয়েছে অনেক ঔষধী এবং পুষ্টিগুণ।। এই পাটের পাতা থেকে ই তৈরি হচ্ছে অর্গানিক গ্রীন টি।
পাটের পাতা জমিতে পরে থাকে, বা পাটের যে মোতা বা শিকড় বম জমিতে পরে থাকে তা পচনে কোন ক্ষতি নাই বরং জমির উর্বরতা বাড়ায় এবং পরবর্তী যে ফসল ফলানো হয় তার জন্য জৈব সার হিসেবে কাজ করে এবং ফলন ভালো হয়।
পাটের আঁশ এর তো বহুবিধ ব্যবহার আছেই। পাটের আঁশ এ তৈরি হয় সুতা, সে সুতা হলো অনেক অনেক পণ্যের কাঁচামাল।। সুতা থেকে হচ্ছে শাড়ি, লুংগি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবী, ফতুয়া, ব্যাগ, খেলনা, নকশি কাঁথা, পাপোস, জুতা, স্যান্ডেল, ছিকা, দড়ি, সুতলি, পর্দার কাপড়, গয়না, বাচ্চাদের দোলনা, হ্যান্ড ব্যাগ, মানিব্যাগ, শোপিছ, ওয়ালম্যাট সহ অনেক অনেক কিছু। । পাটের তৈরি পোশাক শরীর কে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে।
পাট পণ্য রপ্তানি হয় সৌদি আরব, জাপান, ইউরোপ এর বিভিন্ন দেশ, ইরান, সুদান, ঘানা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া সহ আরো অনেক দেশে। এছাড়া কাঁচা পাট রপ্তানি হয় ভারত, পাকিস্তান, চীন, আইভরিকোস্ট, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে।
পাটকাঠি দিয়ে আগে শুধু জ্বালানী কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হলে ও এখন তার ও অনেএএএক ব্যবহার রয়েছে। পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় চারকোল বা ছাই৷ আমরা যে শুধু আঁশ রপ্তানি করি বা বিভিন্ন পণ্য তাই নয়, রপ্তানি হচ্ছে এই ছাই যা থেকে তৈরি হয় কার্বন পেপার, ফটোকপির কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, ফেসওয়াশ সহ বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী৷
পাটের ছাই প্রধানত রপ্তানী হয় চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিল, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপীয় দেশ গুলোতে।।
ফোর্ড ও টয়োটার মত কোম্পানি গুলো ভারি কার্পেট ও আসন তৈরিতে পাট ব্যবহার করে৷ দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি তে এখন কাচের ফাইবার তৈরি করতে এবং গাড়ির দরজা বানাতে পাট ব্যবহার করে। এর বিশাল পরিমাণ তারা আমদানী করে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশ থেকে। জার্মানির বিএমডাব্লিউ কোম্পানির সর্বাধুনিক ইলেক্ট্রিক গাড়ির ভেতরের বক্স বডির উপাদান তৈরি কাঁচামাল হিসেবে পাট ব্যবহার করা হচ্ছে, যার বেশির ভাগ বাংলাদেশ থেকে যায়।
ঠিক এসব কারণে পাট একদিকে যেমন সোনালী আঁশ অন্যদিকে তেমনি রূপালি কাঠি ও।
পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ ২য় হলে ও রপ্তানিতে ১ম। বাংলাদেশ এ চলতি বছরে পাট উৎপাদন হয়েছে ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টন, যা বিশ্বে মোট উৎপাদন এর ৪২ শতাংশ। পাট থেকে তৈরি ২৮৫ ধরণের পণ্য রপ্তানি হয় বিদেশে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় ৩৮.২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাট আমাদের দেশের সাথে এতটা ই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে আমাদের জাতীয় প্রতীকে ও পাট পাতা ঠাই পেয়েছে।
এত হাজারো ব্যবহার এর পরে ও ১৯৫০ এর দশকে বাজারের ব্যাগ ও পণ্যের মোড়ক এ পলিথিনের ব্যবহার এর ফলে পাট এর ব্যবহার কমতে থাকে। ১৯৮০ সাল থেকে পাটের জায়গা নিয়ে থাকে ধান বা অন্যান্য ফসল। তবে আবারো এখন জনগণের সচেতনতার মাধ্যমে পাট পণ্য তাদের জায়গা ফিরে পাচ্ছে। পলিথিন এমন এক ক্ষতিকর পদার্থ যে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য যেসব গ্যাস দায়ী তার ১০-১৫ শতাংশ ই হবে প্লাস্টিক পোড়ানোর জন্য৷ বাংলাদেশের নদী স্তর গুলোর গভীরতা ও কমে আসছে পলিথিনের জন্য। তাই অবশ্যই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট আবারো প্রাধান্য পাচ্ছে এবং বিভিন্ন নীতিমালা নির্ধারণ করা হচ্ছে পাট শিল্পের ব্যবহারে।
২০১০ সাল থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার কমানোর জন্য পাট প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করা হয়। বাজারের ব্যাগ এর ক্ষেত্রে ও।
বাংলাদেশে ২০১৫ সালে মোবারক আহমেদ খান জুট পলিমার আবিষ্কার করেন, যা পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে৷ এছাড়া তিনি পাটের জুট টিন ও আবিষ্কার করেছেন যা অনেক বেশি হালকা, শুক্তিশালী ও শব্দ নিরোধক।। এসব এত এত আবিষ্কার এর জন্য পাটকে সুপারপ্ল্যান্ট ও বলা হয়।
টাঙ্গাইল এর প্রতিটি উপজেলায় কম বেশি পাট ফলন হয়। যদি ও আগের থেকে তা অনেক কমে গেছে। বোরো ধানের চাষ বেড়ে যাওয়া এর একটি কারণ। এরপরে ও বিগত বছর ১২০০০ একর এর উপর জমিতে পাট চাষ হয়েছে এর মাঝে টাংগাইল সদর উপজেলায় ২৫৫০ হেক্টর, ৩৭৬২ হেক্টর ভুয়াপুর এ, ১৩১০ হেক্টর গোপালপুর এ, ১২২৫ হেক্টর দেলদুয়ার এ। এছাড়া ও কালিহাতি, নাগরপুর, মির্জাপুর, সখিপুর, ধনিবাড়ি সব জায়গাতে ই পাট চাষ হয়।
অনেক বেশি সম্ভাবনার পরেও টাঙ্গাইল জেলা এ পণ্য নিয়ে সুবিধা করতে পারেনি এখানে কলকারখানা র স্বল্পতার জন্য।। এত পাট কিন্তু একটি মাত্র জুট মিল আছে তা ও মির্জাপুর এর গড়াই নামক জায়গায়।
অথচ একটা সময় ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত এলাসিন, যা দেলদুয়ার উপজেলার অন্তর্গত, এখানে বৃহৎ পাট ব্যবসা কেন্দ্র। এখান থেকে ঢাকা ও কলকাতার স্টীমার যোগে পণ্য আনা নেয়া হতো। একটা সময় এখানে পাট দিয়ে কাগজ তৈরি হতো। কাগজের মিল ছিলো এখানে। এখন সেসব ই অতীত।
তবে হ্যা ব্যক্তি উদ্যোগ এ ছোট ছোট কিছু পাটের মিল আছে যেখানে ফাইবার থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয়। যেমন আছে ভূয়াপুর এর সিরাজকান্দি তে প্রাক্তন একজন চেয়ারম্যান এর এমন একটি নিজ উদ্যোগ এ জুটমিল আছে।
পাটের ব্যবসা কিন্তু সব সময় ই জমজমাট টাঙ্গাইল এ। বিভিন্ন ধাপে ধাপে এগুলো ক্রয় বিক্রয় হয়। যেমন কৃষকের বাড়ি থেকে কিংবা হাট থেকে পাটের আঁশ কিনে নেয় বেপারিরা। বেপারিদের কাছ থেকে কিনে নেয় গুদামের মালিক কিংবা পাট ব্যবাসায়ীরা। এরপর তাদের থেকে চলে যায় বিভিন্ন মিল কারখানায় যেমন চলে যায় নারায়ণগঞ্জ কিংবা খুলনার পাটকলগুলোতে। এসব ধাপ অতিক্রম করে পাটপণ্য জায়গা করে নেয় ফ্যাক্টরি বা বাজারে কিংবা চালান হয় রপ্তানি বাজারে।
এত ধাপ ঘুড়ে কৃষকদের পাওয়া সামান্য হলেও তাদের মুখে হাসি থাকে, সংসার চলে যায়। এ কাজের সাথে জড়িত থাকে এক পরিবারের নারী পুরুষ দু রকমের সদস্য ই কেননা পাট যখন জাগ দেয়া হয় তখনকার আঁশ ছাড়ানোর কাজ, পাটখড়ি শুকানো সহ বিভিন্ন ধরনের কাজগুলো গ্রামীণ নারীরা করে থাকে৷
অবশ্যই এই সেক্টর আরো অনেক বেশি উন্নত হবে যদি উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞ্যান এর সাথে এলাকার মানুষ কে পরিচিত করানো যায়। অনেক ট্রেইনিং এবং প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানোর মাধ্যমে মানুষ দের যেমন পাট পণ্যের ইনোভেশন করতে সহায়তা করা যায় তেমনি সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই সম্ভাবনাময় সেক্টর আরো উন্নত করা যেতে পারে।
টাঙ্গাইল এ সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ এ এখন বেশ কিছু ট্রেইনিং সেন্টার আছে যেখানে বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের বা নারীদের ট্রেইনিং দেয়া হচ্ছে পাট পণ্যের প্রসেসিং এর৷
অনেক সমস্যা কাটিয়ে ই পাট পণ্য এখন মর্যাদা ফিরে পাচ্ছে। বিভিন্ন মেলাগুলোতে এখন পাটপণ্যের আধিক্য থাকে। চলতি অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৪৩ দশমিক ৮৭ কোটি ডলার যা গত বছরের সমসাময়িক সময়ের থেকে ৩৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়ছে। বীজ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এখন।
আগে যেমন পাটের পোশাকের প্রতি বাহিরের দেশগুলোর আকর্ষন বেশি ছিলো আমাদের দেশের জনগনের ই আকর্ষন ছিলো কম। কিন্তু দিনের বদলের সাথে এবং পণ্যের ভ্যারিয়েশন, উন্নতির সাথে সাথে আমাদের দেশে ও এখন পাটের পোশাকের আধিক্য বেড়েছে। এর হাত ধরে ই টাঙ্গাইল এর পাটের শাড়ি গুলোর কদর বাড়তেছে দিন দিন। অনেক উদ্যোক্তা ই তাদের উদ্যোগ এ যোগ করেছে পাটের শাড়ি, পাঞ্জাবী, জামা, জুতা, অলংকার ব্যাগ ইত্যাদি।।।
ইতিমধ্যেই গত বছরের জুন এ বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাট অধিদপ্তর দ্বারা “উচ্চ ফলনশীল পাট ও পাটবীজ উৎপাদন এবং উন্নত পাট পচন” প্রকল্পের আওতায় টাঙ্গাইল এর গোপালপুর এ দিনব্যাপী পাট চাষী প্রশিক্ষণের কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যা সাধারণ চাষীদের মাঝে পাট চাষের জন্য উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তা জোড়দার ও হচ্ছে।
পাটের বাজার রমরমা, এতটা আধিক্য এবং প্রতি বছর ই এর উৎপাদন মাত্রা বেড়েই চলছে টাঙ্গাইল সহ সারা দেশে। এই অবস্থায় এই সেক্টর কে আমাদের অবশ্যই কাজে লাগানো উচিৎ কেননা এর ফলে কৃষকদের মুখে হাসি যেমন ফুটবে তেমনি দারিদ্র্য বিমোচন হবে সাথে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে জিডিপি বাড়বে অবশ্যই।। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এই সেক্টর এ কাজ বাড়ানো উচিৎ। টাঙ্গাইল এ অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হলে নিজেদের এলাকা থেকে পাটজাত পণ্যের অনেক প্রসার সম্ভব এবং এই প্রসার সবথেকে বেশি ই-কমার্স এর প্রচারের মাধ্যমে। অবশ্যই সোনালি আঁশ পাট এর আধিক্য যেহেতু আছে তাই এই সেক্টর এর সম্ভাবনা অনেক বেশি।।। ই-কমার্স এর হাত ধরে শুধু দেশের ভেতরে না বাহিরে ও উদ্যোক্তাদের পণ্য পৌছানো সম্ভব।