মধু শব্দটা শুনলেই মাথায় প্রথমে সুন্দরবন শব্দটা চলে আসে, সুন্দরবনের সাথে মধু শব্দটা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই একটা বনের মধু কি ৬৪ টি জেলার চাহিদা মেটাতে সক্ষম? অবশ্যই নয়। সেই লক্ষ্যে প্রান্তিক অঞ্চলের কৃষিজাত ফসলের এলাকাগুলোতে ধীরে ধীরে বাড়ছে মধুর খামার। যে সকল এলাকায় রবি শস্য উৎপন্ন হয় এবং বাগানের পরিমান বেশি, সে সকল অঞ্চলে মধু চাষের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা ও ভালুকা উপজেলা মধু চাষের গ্রাম বলে পরিচিতি পেয়ে আসছে বহু বছর ধরে। মধু চাষে ও মৌমাছি পালনে অবদান রেখে আসছেন সম্ভাবনাময় কিছু উদ্যোক্তা।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার আটানি বাজারের আলিম, পাড়াটঙ্গির তাজুল ইসলাম আর কাঠবওলার আব্দুল জলিল সহ আরও অনেকেই ১৩ বছরেরও উপর ধরে মৌমাছি ও মধু চাষ করে আসছেন। ময়মনসিংহে মধু চাষের সূচনা এই তিনজন অসম্ভব পরিশ্রমী ও দারুণ উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা হয়েছে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে এই মধু সংগ্রহ করে আসছেন এই চাষীগণ, প্রতি বছর আশানুরূপ মধু উৎপাদিত হওয়ায় তা রপ্তানী করছেন বিভিন্ন দেশে। কাঠবওলার চাষী আব্দুল জলিল বিআইএস এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মৌ চাষের উপর প্রশিক্ষণ নেন এবং টাঙ্গাইলের এক চাষীর কাছ থেকে উন্নত প্রজাতির মেলিফেরা মৌমাছি এনে ১২টি বাক্সের ১০০টি ফ্রেমে মৌচাষ শুরু করেন। তার খামারের নাম ‘ভাই-বোন মধু’, বর্তমানে তার ১০০টির উপর মৌমাছির বাক্স রয়েছে। প্রতিবছর ৩৫-৪০ মণ মধু এই বাক্সগুলো থেকে উৎপাদিত হয়, দেশের সব জায়গায় এই মধু চলে যায় বোতল বা কাঁচের জারে করে যা থেকে প্রায় ৫ লক্ষের মতো আয় হয়ে থাকে আব্দুল জলিলের৷ সরিষা ফুলের মধু তৈরি থেকে শুরু করে এখন কালোজিরা, ধনিয়া, কুল, রাবার, লিচু ফুল সহ আরও নানান জাতের মধু সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। ফলের মৌসুমে ফলনশীল এলাকায় মধুর বাক্স নিয়ে ছুটে যান মৌ চাষীরা, আবার ফসলের মৌসুমে, যেমন সরিষা, কালাই, ধনিয়ার সময় ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে দেন মৌমাছির বাক্স। মধু সংগ্রহের জন্য এই স্থানীয় মৌয়ালরা কখনও গাজীপুর, কখনও মধুপুর ছাড়াও শরীয়তপুর, নাটোর, সখীপুর, ঘাটাইল ও মুক্তাগাছায় অবস্থিত ফলের বাগান ও বনে ছুটাছুটি করেন।
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার কাচিনা গ্রামে শওকত হায়ত খান ১৯৯৫ সালে প্রশিকা থেকে মধু চাষের উপর জ্ঞান অর্জন করেন এবং সেখান থেকে কেনাডিয়ান এপিস মেলিফেরা জাতের মৌমাছি সংগ্রহ করে মধু চাষ শুরু করেন। প্রথমে তিনি ভ্রাম্যমান পদ্ধতিতে মৌসুমী ফুলের মধু সংগ্রহের মাধ্যমে তার উদ্যোগ শুরু করেন। এ বছর টাঙ্গাইলের মিয়াবাড়ী গ্রামে সরিষা ক্ষেতের পাশে ২৫০টি মৌমাছির বাক্স স্থাপন করে মধু চাষ করেন এবং প্রচুর মধু উৎপাদন করেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় ৮৫০ টি বাক্সে ১৮ জন শ্রমিক কাজ করছে এই মৌমাছি পালন ও মধু সংগ্রহের কাজে। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার কাচিনা বাজারে রয়েছে শওকতের মধুর গোডাউন, যার নাম ‘মেসার্স খান মৌ প্রতিপালন প্রকল্প’, যেখানে রয়েছে রপ্তানিমুখী উন্নত মানের মধু। ময়মনসিংহ জেলা ছাড়াও তিনি সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমান মৌচাষ করে আসছেন, সেই সাথে সরিষা, ধনিয়া, কলাই, কালোজিরা ক্ষেতের পাশে, লিচু, বরই কুল বাগানে অথবা খলিসা, গরান, কেওরা গাছের পাশে, রাবার বাগানে মৌমাছির বাক্স স্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের মধু সংগ্রহ, বিক্রয় ও রপ্তানী করে আসছেন তিনি।
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার শম্ভুগঞ্জের পাসতেরিল্যা গ্রামে রয়েছে হাফেজ আলমগীর হোসেনের ২৫০টি মৌমাছির বাক্স। বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের চারপাশ ঘিরে রেখেছে এই মৌচাষের বাক্সগুলো, যা থেকে মধুর মৌসুমে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২০০ কেজির মতো মধু সংগ্রহ করা যায়।
ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল ও হালুয়াঘাটের প্রত্যন্ত এলাকায় সরিষার ফলন খুব ভালো হয় এবং এসব সরিষা ক্ষেতে কৃত্রিম মৌচাক বসিয়ে মধু চাষ করা হয়, ফলে সরিষার ক্ষেতে মৌচাষ করে মধু সংগ্রহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে অনেক কৃষকরা।
দেশের বর্তমান অবস্থায় অনেকেই চিনির বদলে ঝুঁকছেন মধুতে। শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি, ত্বকের ঔজ্জ্বল্যতায় আর চিনির পরিপূরক হিসাবে মধুর চাহিদা ব্যপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে দেশে এবং বিদেশে। ফসলের ১৫% কীটনাশকের কাজ এবং ফুলের ৭০% পরাগায়ন ঘটায় এই মৌমাছি। দিন দিন কৃষিকাজে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারের কারণে কমতে বসেছে মৌমাছির সংখ্যা। সেই লক্ষ্যে এখন সরকারী ও বেসরকারীভাবে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে মৌমাছি পালনে এবং উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে মৌ পালনে দক্ষ করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সেই সাথে মধুর ঢাল মৌসুমে মৌচাষীদের আর্থিক সুবিধা দিতে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে নেয়া হচ্ছে সহায়তার ব্যবস্থা।
সাধারণত মৌচাষীরা তাদের উৎপাদিত মধু স্থানীয় বাজারে ও সরাসরি রপ্তানীর জন্য বিক্রি করে দেয়। সাধারণ ক্রেতাদের সাথে মধু বিক্রেতার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব ই-কমার্সের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিনা)-র বিভাগীয় প্রধান, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে আমাদের মধু সংগ্রহের বিষয়ে কিছু তথ্য জানান। তিনি বলেন, যদি কোনো উদ্যোক্তা বিশাল পরিসরে সরিষা চাষ করে তাহলে মৌচাষ ও মধু সংগ্রহের যাবতীয় সুবিধা বিনা থেকে দেওয়া হয়।তাছাড়া বিশাল পরিসরে যারা সরিষা চাষে আগ্রহী তাদেরকে বিনামূল্যে সরিষার বীজ সরবরাহ করে বিনা।
এ অঞ্চলের কৃষি উদ্যোক্তাদের সরিষা চাষ ও মৌচাষে দক্ষ করে তোলার জন্য বিনামূল্যে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয় বিনা থেকে। শুধু তাই নয় যেসব জমিতে সরিষা চাষ ও মধু সংগ্রহ করা হয় সেসব আবাদি জমি পরিদর্শন করতে যায় বিনার পরিদর্শক টিম।
ময়মনসিংহের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে সম্ভাবনাময় পণ্য হিসেবে মধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সেক্ষেত্রে শিক্ষিত উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বেশী বেশী কনটেন্ট লেখতে হবে, ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে প্রচার করতে হবে। মধুর সম্ভাবনা নিয়ে প্রচারের ফলেই প্রসার ঘটতে পারে এই অঞ্চলের সম্ভাবনাময় এই পণ্যের।
লেখক: আরিফা খাতুন, রোকসানা সুলতানা