প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই দেশের প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অপার সৌন্দর্যের আখড়া, অথচ আমরা সেসব সৌন্দর্যের আবিষ্কারে যেন বড্ড উদাসীন। আমাদের খুব কাছের পরিচিত সাধারণ পরিবেশে অসাধারণ সব সৃষ্টি রেখে চোখ শুধু দূরের সৌন্দর্য হাতড়ে বেড়ায়। তবে যে যাই বলুক প্রকৃত শান্তি কিন্তু লুকিয়ে আছে এই বাংলার সবুজ প্রকৃতিতেই, তাই মধুসূদনের মতো সুদূর বিদেশ ঘুরে অবশেষে এই বাংলার রূপের মুগ্ধতায়ই ছুটে আসতে হবে।
রূপসী বাংলা ঠিক তেমনিভাবে তার রূপের ঢালি সাজিয়ে বসেছে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার ছালড়া নামের ছোট্ট একটি গ্রামে, যার রূপে মুগ্ধ হবে যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী শিল্পমনা মানুষ। আর সবচেয়ে মুগ্ধ করার বিষয় হচ্ছে, এই গ্রামটা যেন ছোট্ট একটা সুন্দরবন!
ময়মনসিংহে সুন্দরবন! ব্যাপারটা প্রথমে কিছুটা অবাক করলেও সত্যি। আসলে একে প্রকৃতির খেয়াল বলতে পারেন। ছালড়া গ্রামটা ঘিরে আছে বিশাল সব বিল, দিঘী, বাঁশ ও বেত বন আর শালবন দিয়ে। আর এই বেতগাছ ও বাঁশবনের ভিতরে জোয়াড়ের মত পানি জমে থাকে, সেই সাথে বেত এবং বাঁশের কচিকান্ড অনেকটা শ্বাসমূলের মত দেখা যায়। এই দৃশ্যপট দেখে তখন যে কারোরই মনে হবে, এই বুঝি সুন্দরবন চলে এলো!
বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
রবিঠাকুরের এই চরণের সাথে গলা মিলিয়ে বলতেই হয়, সত্যিই তাই!
মুক্তাগাছা উপজেলার দুল্লা ইউনিয়নের ছোট্ট একটা গ্রাম এই ছালড়া, অথচ তার অপার সৌন্দর্য যেন আবহমান গ্রাম বাংলার মূর্তমান প্রতীক। ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে মুক্তাগাছা উপজেলার দূরত্ব ২০ কিলোমিটার এবং মুক্তাগাছা উপজেলা শহর থেকে ছালড়ার দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। এই ৩৪ কিলোমিটার জায়গার পুরোটাই যেন প্রকৃতির নিবিড় সৌন্দর্যের আধার। ময়মনসিংহ শহর থেকে ছালড়া পর্যন্ত যেতে হয় যে পথ দিয়ে তার পুরোটা জুড়েই সবুজ প্রকৃতির মেলা। যেতে যেতে রাস্তার দুপাশের প্রকৃতি, গাছের সারি, খোলা সবুজ প্রান্তর আর এর মৃদুমন্দ বাতাসের শীতল স্পর্শ আপনাকে দুচোখ বন্ধ করে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে প্রোরোচিত করবে আর মনের অজান্তেই হয়ত বলে উঠবেন তখন, “এ যাত্রা হোক অনন্ত কালের!”
এই শীতল প্রকৃতির রূপের গভীরতা বাড়তে থাকবে ছালড়া গ্রামের দিকে যত এগুতে থাকবেন। কখনো রাস্তার দু’পাশের বিলের বিশাল জলরাশি দেখে মনে হবে কোনো হাওড় এলাকায় চলে এসেছেন, আবার কখনো বা সবুজ বনের ভেতর দিয়ে পিচ ঢালা পথ আপনাকে দিবে এডভেঞ্চারাস অনুভূতি। চলতে চলতে দেখতে পাবেন বিলে জেলেদের জাল ফেলে মাছ ধরা, শালবনের কাঠকুড়ানীদের কাঠ কুড়ানো আর কৃষকের হাকডাক।
ছালড়া পৌঁছানোর পর এর আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে আপনাকে ঢুকতে হবে বাঁশ বেত ঘেরা গভীর অরণ্যে। এর ভেতরে কিছুদূর পর্যন্ত পাবেন কর্দমাক্ত মাটির রাস্তার দেখা, তবে প্রকৃতি দেখতে দেখতে কখন এটুকু পথ হেঁটে পেরিয়ে যাবেন হয়ত বুঝতেই পারবেন না। এই পথ ধরেই পৌঁছে যাবেন ছালড়া হ্যাভেনে। মাত্র ১০ টাকা প্রবেশমূল্যে সারাদিন ব্যাপী আপনি এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এর মূল আকর্ষন তিনটি বিশাল দিঘীর সমন্বয়ে সৃষ্ট বিশাল লেক, যা এর চারপাশের শালবনের বেষ্টনীতে আবদ্ধ। এ যেন অপার সৌন্দর্যের লীলাখেলা!
প্রায় ৭৭ বিঘা জায়গা নিয়ে এই পিকনিক স্পটটি আসলে তৈরী করা হয়েছিল মূলত মৎস শিকারীদের জন্য, যারা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে অবসর কাটাতে ভালোবাসে। যিনি এটি তৈরী করেছেন উনার ভাষ্যমতে, বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরায় উৎসাহিত করতে চান তিনি এই ছালড়া হ্যাভেনের মাধ্যমে, যা তাদের ধৈর্যশীল হতে সাহায্য করবে এবং ধীরে ধীরে একে আরও সাজিয়ে তুলতে চান যেন, সারাদেশের মৎস শিকারী আর ভ্রমনপ্রেমীদের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠে এটি। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা গ্রামীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এবং তরুণ প্রজন্মকে সেগুলোর সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে লাঙ্গল, হারিকেন আর গরুর গাড়ির চাকা রাখা হয়েছে এর ডেকোরেশনের অনুষঙ্গ হিসেবে। ছুটির দিনগুলোতে এখানে আয়োজন করা হয় বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগীতা, যাতে অংশগ্রহণ করার জন্য সারাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভীড় জমায়। তবে শুধু মৎস শিকারী নয়, এটি ভ্রমনপ্রেমীদেরও প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে। ছোট ছোট বোটে চড়ে লেকে ঘুরে বেড়ানোরও সুযোগ রয়েছে এখানে।
তবে আমার কাছে এই জায়গাটা বাড়তি আবেদন সৃষ্টি করেছে আর অনুভূতিগুলো একটু ভিন্ন আমেজ পেতে চাইছে। আমাদের দেশে যদিও ক্যাম্পিং খুব জনপ্রিয় নয়, তারপরও কিছু সাহসী ভ্রমনপ্রেমী দল্ভেদে নাইট ক্যাম্পিং করতে ছুটে যান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তাদের জন্য ছালড়া গ্রাম আর এই ছালড়া হ্যাভেন হতে পারে ক্যাম্পিং এর জন্য আদর্শ জায়গা। ভাবতেই আমার কল্পনার রাজ্যে ভেসে উঠছে সেই দৃশ্যপট-“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে”
জীবনানন্দ দাশের এই লাইনটার অর্থ নির্জন বনে বসে সন্ধ্যা হওয়া না দেখলে হয়ত বোঝা যাবেনা। ধীরে ধীরে চোখের সামনে ঘন অন্ধকার সবকিছু ঢেকে ফেলে উদ্ভূত হয় মাথার উপর তারাভরা বিশাল আকাশ, পূর্ণিমার চাঁদ। সামনে লেকের জলরাশিতে জোছনার আলোয় পরা শালবনের ছায়া, লেকের পানির কলকল শব্দ আর নানা রকম অচেনা পাখি আর পোকাদের শব্দ এক রহস্যময় আদিম আবেশ সৃষ্টি করেছে, যা উপভোগ করছে একদল ভ্রমনপ্রেমী। ফায়ারক্যাম্প ঘিরে বসে চলছে তাদের আড্ডা, গল্প আর গান। সাথে তাঁবু খাটিয়ে ঘুমানোর সরঞ্জাম সাথে করে নিয়ে আসলেও এই রহস্যাবৃত জগৎ থেকে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে যেন নারাজ তারা!
আপনি যদি এক ভ্রমনেই কিছুটা এডভেঞ্চার, সীমাহীন শান্তি আর প্রাণভরে পিউর অক্সিজেন ফুস্ফুসে বহন করে নিতে চান, তবে ছালড়ায় আপনাকে আসতেই হবে।