টাঙ্গাইল নামটার সাথেই মিশে আছে অনেক অনেক জমিদারদের ঐতিহ্য৷ ইতিহাসে টাঙ্গাইল এর জমিদারদের জমিদারী সময়কাল চীর অম্লান হয়ে আছে জেলার প্রতিটি স্থানে।
লর্ড কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে একটি জমিদারী প্রথা চালু করেন। এই প্রথার মাধ্যমে সারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ছড়িয়ে যায় এর ফলে পুরো ভারতবর্ষের হিসাব নিকাশ ব্রিটিশদের জন্য সহজ হয়। এর ই রেশ ধরে জমিদার রা বিভিন্ন জায়গা থেকে জমিদারী পরিচালনা শুরু করেন এবং যে জায়গায় তারা জমিদারী করতেন সেই জায়গাগুলোতে নিজেদের বসবাস এর জন্য সুন্দর অট্টালিকা গড়ে তোলেন৷ এগুলো ই জমিদার বাড়ি।
সেই সময়ে জমিদার দের যেমন ছিলো অর্থ তেমনি ছিলো সখ। তাদের সখের কিছুটা ছোঁয়া আমরা বুঝতে পাই তাদের বাড়িগুলোর দিকে তাকালে। প্রতিটি জমিদার বাড়ি সেই সময়কার শিল্পীদের হাতের নিপুণ ছোঁয়াতে পূর্ণতা পেতো। তাদের শিল্পকর্ম গুলো অবশ্যই যত যুগ ই পাড় হয়ে যাক সবযুগের জন্যই নিদর্শন।
টাঙ্গাইল এ এমনি বেশ কিছু খুব সুন্দর জমিদারবাড়ি আছে কালের সাক্ষী হয়ে৷ প্রতিটি জমিদারবাড়ি যেন একটি আরেকটির থেকে রূপ সৌন্দর্যে এগিয়ে। এগুলো হতে পারে আমাদের জেলার পর্যটন কেন্দ্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে সেসব সৌন্দর্যমন্ডিত জমিদারবাড়ির কথাই তুলে ধরবো।
মহেরা জমিদারবাড়িঃ
টাঙ্গাইল এ অবস্থিত এত্তগুলো জমিদারবাড়ির মধ্যে যে বাড়িটি সবথেকে বেশি জ্বজুল্যমান হয়ে এখনো সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেটি হলো মহেরা জমিদার বাড়ি৷ চকচক করছে দেয়ালগুলো যেন স্বর্ণধোয়া পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় দেয়ালগুলো কে। এতটা দীপ্ত ছড়ায়।
মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে প্রতিটি স্থাপনার মাঝে। এক নজর তাকালেও যেন মনে হয় অতীতের কারিগরদের হাতের ছোঁয়া কি অপূর্ব ই না ছিলো৷ । ১৮৯০ সালের ও আগে গোড়াপত্তন ঘটে এই জমিদারবাড়ির। স্পেনের করডোভা নগরের আদলে নির্মিত এই জমিদার বাড়ি। কি লম্বা সময়। অথচ বাড়িটি দেখে বুঝার উপায় নেই।
কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা নামে দুই ভাই কোলকাতায় লবণ ও ডাল এর ব্যবসা করে প্রচুর টাকা পয়সা রোজগার করে মহেরা গ্রামে এসে তাদের এই অভূতপূর্ব জমিদারবাড়িটি স্থাপন করেন ১ হাজার ১৭৪ শতাংশ জমির উপর।
পুরো জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য বর্ণনা করতে হলে পুরো একটা আর্টিকেল পাড় হয়ে যাবে৷ তবে হ্যা, সংক্ষেপে বলতে গেলেও যে দৃশ্যটি প্রথম চোখে পড়ে তা হলো বিশাখা পুকুর৷ মূল গেট এ ঢোকার আগেও সুন্দর বাঁধানো এ পুকুরপাড়।। আর ভেতরে ঢুকলেই সসন্মানে দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরী লজ। এর যে ঝুলানো বারান্দা আর সুন্দর পিলার যে কোন দর্শনার্থী কে মুগ্ধ করতে বাধ্য।
এর পাশে ই আনন্দ লজ। সবথেকে আকর্ষণীয় এ ভবন এখানে। যার পাশে ই মহারাজ লজ। এখানে প্রতিটি ভবন যে নিজেদের সৌন্দর্য ছড়াতে ব্যস্ত।৷ ঠিক যখন জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হবে তার আগেই করা আরেকটি সুন্দর এবং অন্যসব ভবন গুলো থেকে আলাদা একটি ভবন তার নাম কালীচরণ লজ। ইংরেজি ইউ অক্ষরের আদলে করা এই ভবনটি থেকে মনে হয় যেন শেষ বিকেলে দ্যুতি ছড়ায়। ভবণটি রাণীদের জন্য নির্মিত ছিলো জন্য একে রাণী ভবন ও বলা হয়।
ভবনগুলোর পিছনে রাণীদের জন্য ছিলো রাণী পুকুর এবং আরেকটি পাসনা পুকুর। এখনো আছে সেগুলো। এছাড়া ও আছে মন্দির। ইভেন আনন্দ লজ এর পাশে রয়েছে একটি ভবন যেখানে জমিদার নায়েব রা বসে হিসাব নিকাশ করতেন, নাম তার কাচারি ভবন। এছাড়াও নায়েবদের জন্য ভবন আছে, গোমস্তাদের জন্য ঘর আছে। এখানে বাগান, শিশুপার্ক, বিভিন্ন আর্টিফিশিয়াল স্থাপনা আছে। একটা জায়গাতে মন কেড়ে নেয় তা হলো হরেক প্রজাতির গোলাপ। জানা অজানা বিভিন্ন রকম গোলাপে ভর্তি।। পাখ পাখালি, বাগান, পুকুর, বিল্ডিং সব মিলিয়ে মোট কথা এর ভেতরে যেন স্বপ্নপুরী, যা লাগে সব ই আছে।
টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরত্ত্বে,, ঢাকা টাঙ্গাইল রোড থেকে নাটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরত্ত্বে অবস্থিত এই জমিদারবাড়ি। প্রচুর দর্শনার্থীদের মন কেঁড়ে নেয় এই জমিদারবাড়ি। মন ভালো করতে যে কেউ এখানে ঘুড়ে আসতে পারেন। জমিদারী স্বাদ নিতে এই বাড়ি পার্ফেক্ট।
হেমনগর জমিদারবাড়ি / পরীর দালানঃ
নামটা শুনতে ই কেমন মনে হচ্ছে পরীদের আবাসস্থল মনে হয়। আসলে ঘটনা কিন্তু এটা না। এই সুন্দর জমিদারবাড়িটির মূল প্রাসাদ ভবনের উপরে মুকুটের মত রয়েছে দুইটা পরীদের মূর্তি, এই কারণে ই এই জমিদারবাড়িটি কে স্থানীয় লোকেরা পরীর দালান হিসেবে চিনে।
জমীদার হেমচন্দ্রের নাম অনুসারেই এই এলাকার নাম হেমনগর যা টাঙ্গাইল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীরে এবং গোপালপুর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৮৯০ সালের দিকে হেমচন্দ্র এখানে তার এই সুন্দর রাজকীয় বাড়িটি নির্মাণ করেন ১৮০০বিঘা জায়গা নিয়ে। রাজপ্রাসাদ টি ই নির্মিত হয় পাঁচ বিঘা জায়গাসহ। দিল্লী ও কলকাতা থেকে কারিগর এনে নির্মাণ হয় সুন্দর এই রাজবাড়িটি।
পরীর দালানে ঢুকতেই চোখে পড়ে এর মূল ভবনের চাকচিক্য। সত্যিই বিস্ময় নিয়ে আমি দেখছিলাম যেন মনে হচ্ছিলো ছুঁয়ে দেখতে না পারলে আমার আত্মা শান্তি পাচ্ছে না৷ দেয়ালে এত নামীদামী পাথর, রঙীন কাঁচ ব্যবহার করা যার শোভা এখনো বিদ্যমান। পিলার গুলো পর্যন্ত সুন্দর নানা রং বেরং এর পাথর আর কাঁচ দিয়ে নকশা করা।। মেঝে গুলোও অপূর্ব নকশা খোচিত এবং রেলিংগুলোতে ও নানান ধরণের নকশা করা।
২৫ টা কক্ষ যার সামনের পার্ট এ পুরো ইউরোপীয় ধরণে এবং ভেতরের দুই ভবন আমাদের দেশীয় কায়দায় করা যেখানে আছে লম্বা সারি বারান্দা। রাজবাড়ির উঠোন চত্ত্বরে ও ছিলো দিঘী যা ভরাট হয়ে গেছে। ৭ সন্তানের নামে ছিলো ৭ টা দিঘী। সামনের বিশাল অংশ জুড়ে ছিলো শান বাধানো ঘাট। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এটি অন্যতম একটি রাজবাড়ি হতে পারে। যার সরকারি সংস্কার প্রয়োজন এবং অনুমোদন ও পেয়েছে সংস্কারের।
জমিদার হেমচন্দ্রের বিশাল এই ভবন কিন্তু তাকে এলাকাবাসী নিষ্ঠুর লোকহিসেবে এখনো মনে রেখেছে।। খাজনা আদায় এর ব্যাপারে খুব বেশি কঠোর ছিলেন তিনি। একচুল ছাড় প্রজারা পায়নি।।৷ তবে হ্যা খারাপের মাঝেও ভালো হলো শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করেছিলেন। সেই সময়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল করেছিলেন যেখানে হিন্দু না শুধু মুসলমান রা ও পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এর কাছাকাছি বেশ কিছু পুরনো নিদর্শন আছে যা রাজা হেমচন্দ্র তার আত্মীয় স্বজনের জন্য বানিয়েছিলেন৷ ছোট ছোট সুন্দর কুঠির।
সব মিলিয়ে এই রাজবাড়িটির সংস্করন হলে এটি হয়ে উঠবে টাঙ্গাইল এর অন্যতম একটি ট্যুরিস্ট স্পট।
রায়বাড়ি জমিদারবাড়িঃ
টাঙ্গাইল এর জমিদারবাড়ি। যত এর গভীরে যেতে চাই তত ই অবাক হই। একটা ই কারণ যে আমরা জানি যে টাঙ্গাইল এ অনেক জমিদার ছিলো৷ তৎকালীন জমিদারদের সবাই যেহেতু নিজেদের প্রাসাদে থেকে জমদারী পরিচালনা করতেন৷ সেক্ষেত্রে অনেক জমিদারবাড়িও ছিলো। কিন্তু কতটা তার সঠিক পরিসংখ্যান আমরা জানিনা।। এটা ভাবতে ই কষ্ট হয়।
ঠিক তেমনি একটি জমিদারবাড়ি হলো আলিশাকান্দা রায়বাড়ি।। এলাকার লোকেরা একে রায়বাড়ি বলেই চিনে। লোকেশন ও খুব ই সহজ। টাঙ্গাইল সদর থেকে সিএনজি রিজার্ভ নিয়েই চলে যাওয়া যায়। কিংবা বিন্নাফোর বাজার বা চারাবাড়ি যেকোন একটা জায়গায় অটো নিয়ে গেলেই এরপর রায়বাড়ি সকলের পরিচিত।
জমিদার উপেন্দ্র সেন এর বাড়ি এটি। বিশাল বড় প্রাসাদ৷ যেখানে এখনো তার বংশধর বাস করে।। পুরো বাড়িটি নির্মাণ হয়েছিলো নিজেদের তৈরি ইট দিয়ে৷ দোতল বিশিষ্ট এ বাড়িতে দুইটা আলাদা পোর্শন আছে। আসলে এখন ভাগ হয়ে গেছে। নয়আনি এবং সাতআনি নাম। আয়তাকার বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বিশাল খালি জায়গা৷ উঠোনের মত কিন্তু বাড়ি দিয়েই ঘীরে আছে পুরোটা জায়গা, আলাদা প্রাচীর এর প্রয়োজন হয়নি। চ্যাপ্টা সুন্দর প্রাচীর গুলো অনেক জায়গাতেই খসে পড়লেও বাড়ির ফটকগুলো এবং দেয়ালে খোচিত নকশা গুলো তেমন ই আছে। এই খোলা জায়গাতে বিয়ে, পূজো পার্বন অনুষ্ঠিত হতো। ২৫ টা কক্ষ বিশিষ্ট এত বড় বাড়ি এখন বেশিরভাগ অংশ ই খালি পরে থাকে কেননা এত মানুষ নেউ যে থাকবে৷
দোতলায় আছেন জমিদার উপেন্দ্র সেন এর নাতী বংশধর। তবে হ্যা তারা এখানে থাকলে ও এখনো যদি সরকারি সংস্করন হয় কিংবা সরকারি কোন সেবামূলক কাজে লাগানো হয় এই বিশাল প্রাসাদ কে তবে তারা নিঃশর্তে দান করতে রাজী৷
করটিয়া জমিদার বাড়িঃ
করটিয়া জমিদার বাড়ি মোঘল স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন।টাংগাইল সদর উপজেলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে করটিয়া ইউনিয়নের পুটিয়া নদীর তীরে এই জমিদার বাড়ি অবস্থিত। একে করটিয়া রাজবাড়ীও বলা হয়ে থাকে।১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর জমিদারী প্রথা উঠে গিয়েছিলো, ফলে অনেক জমিদার ভারতে চলে যায়। তবে এই জমিদার বাড়িতে এখনও কিছু বংশধরেরা বাস করে। এজন্য বিশেষ করে বছরের দুই ঈদ ছাড়া সচরাচর জনসাধারণদের বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে দেয়া হয় না।
পন্নী পরিবারের ওয়াজেদ আলী খান পন্নী অরুফে চাঁদ মিয়া রাজবাড়ীটি স্থাপন করেন। জানা যায় বিখ্যাত পন্নী পরিবারের ১১ তম পুরুষ সা’দত আলী খান পন্নী করটিয়াতে পন্নী বংশের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।সেই থেকেই তার বংশধরেরা এখানে বসবাস করতে শুরু করেন।
করটিয়া জমিদার বাড়িটি ছায়াঘেরা, কোলাহলমুক্ত বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত । এতে রয়েছে লোহার ঘর, ঘরটির সিঁড়িও লোহার তৈরি। নজরকারা এই লোহার বাঁকানো সিঁড়িটি এই মহলের বিশেষ আকর্ষণ। সিঁড়িটি দিয়ে একদম পৌঁছে যাওয়া যায় দোতলার অন্দরমহলে। বাড়িটির ভেতরে জমিদারি আদলে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রাখা, যা দেখলে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে৷ ফার্নিচার গুলোতে জমিদারি আভা ছড়ানো আছে। হালকা গোলাপি রঙের বাড়িটির প্রতিটি চিলেকোঠা নানা লতা পাতা আঁকা রেলিং ও ছাউনিতে ঘেরা। যা প্রমাণ করে দেয় এগুলো মোঘল স্থাপত্য শিল্প।
পুরো ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রাজবাড়ির প্রাচীর এর মাঝে রয়েছে রয়েছে রোকেয়া মহল, মহলটি জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে বলে এখানে প্রবেশ নিষেধ। জরাজীর্ণ হলেও এর প্রতিটি কাঠামো দেখলেই মন ভরে আসে৷ অবশ্যই এটি সংস্কার করে হতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক অন্যতম একটি নিদর্শন। রোকেয়া মহলের পেছনেই অবস্থিত রাণীর পুকুরঘাট।পাড়াবাঁধা এই পুকুরের পাড়ে বসলে দেখা মেলে স্বচ্ছ পানিতে ঘুরে বেড়ানো ছোট বড় নানা ধরনের মাছ।পুকুরের পাশে সাড়ি সাড়ি নারিকেল গাছ যেন পুকুরের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।পুকুরের দুইধারে রয়েছে বাগান।বাগানে শাল, শিমুল,আম,কাঁঠাল সহ রয়েছে অনেক প্রজাতির গাছ। বিকেলের হালকা রোদের আঁচে মৃদ্যু বাতাসে খানিকটা সময় পুকুরের পাড়ে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগা কাজ করে।
রাজবাড়িটিতে আরো আছে তরফ দাউদ মহল,যদিও এই মহলটি বর্তমানে পরিত্যাক্ত । ১৫ ফুট উঁচু একটি বিশাল মিনার বিশিষ্ট স্থাপত্যশৈলির অন্যতম নিদর্শন নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে একটি মসজিদ। এই মসজিদটির চারপাশে আছে মোট ৮ টি গম্বুজ।শিল্পীর নিপুণ হাতে গড়া এই মসজিদটির সৌন্দর্য দেখার মত।গম্বুজগুলোর প্রতিটিতে নকশা আঁকা আছে যা দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
নরমালি জমিদার দের নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকে এলাকার লোকদের, তাদের কড়া নিষ্ঠুর শাসন এলাকার লোকদের বারবার তাদের নেগেটিভ আচরণ এর কথা ই মনে
করিয়ে দেয়। কিন্তু করোটিয়ার এ পন্নী পরিবার একেবারেই এদিক থেকে আলাদা৷ এলাকার লোকেরা তাদের দয়া, দান দক্ষিণা রবং ভালো ব্যবহার এর কথা এখনো প্রশংসা করে৷ মসজিদ, স্কুল, কলেজ, মাঠ, করোটিয়া বাজার সহ অনেক অনেক কিছু এই জমিদার রা শুধু এলাকার লোকদের কে ই দান করে গেছেন।। এই জায়গাগুলো থেকে বারবার তাদের প্রতি সন্মান চলে আসে।
পাকুল্লা জমিদার বাড়িঃ
টাংগাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলায় অবস্থিত পাকুল্লা জমিদার বাড়ি।করটিয়া জমিদার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরেই এর অবস্থান।২৭০ বছরের পুরনো এই জমিদার বাড়িটি বাংলা ১১৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
দোতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটি বাহিরে থেকেই মন কেড়ে নেয় এর নজরকারা রং দ্বারা। বাহিরে লাল ইটের তৈরি ইমারত এবং প্রধান ফটক বা সদর দরজা পেস্টেল রঙের যা দেখা মাত্র যেকেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়বে বদরুন্নেছা মহল,যার পিলারগুলোতে নানা নকশা ও কারুকার্য করা।বাড়ির সামনে বিশাল আঙিনা এবং একপাশে রয়েছে কাছারিঘর। যেখানে নবজাতক ও তার মা কে ৪০ দিন থাকতে হতো। ৪০ দিন পূর্ণ হলেই তারা অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারতো।এটি এই জমিদারদের এক আচার পালন বা প্রথা।তার পাশেই আছে একটি কুয়া ও সভাঘর ।বাড়ির পেছন দিকে আছে রান্নাঘর এবং সীমানা প্রাচীরের কাছে আছে বিশাল বাগান।বাগানটিতে ছোট বড় নানা ধরনের গাছপালা দেখা যায়।
ছোটখাটো জমিদারবাড়িগুলো এত সুন্দর হয় দেখতে তার প্রমাণ পাকুল্লার জমিদারবাড়ি। আর এখানে গেলে ঘুড়ে দেখেই চলে যাওয়া যায় করোটিয়া জমিদারবাড়িতে কেননা খুব অল্পদূরত্ত্ব দুই জমিদারবাড়ির মাঝে।
দেলদুয়ার জমিদার বাড়িঃ
টাংগাইলে একমাত্র মুসলিম জমিদার বাড়ি হচ্ছে দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি।টাংগাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি। জমিদারবাড়িটি এলাকায় নর্থহাউজ নামে ও পরিচিত।।
এ জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ফতেহদাদ খান গজনবী লোহানী, যার পূর্বপুরুষ রা এসেছিলেন আফগানিস্তান থেকে
ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর আদলে তৈরি একতলা বিশিষ্ট এই জমিদার বাড়ির সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। লাল সাদা রং এর একতলা বিশিষ্ট এই জমিদারবাড়ি দেখলেই যেন মনে হয় রংতুলি দিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছে কেউ৷ জমিদারবাড়িতে চারপাশের শিল্পকর্মতে ই মসজিদ টাইপ কারুকাজ দেখতে পাওয়া যায় যা সত্যিই মনে শান্তি এনে দেয়৷ এর ঠিক মাঝ বরাবর ছাদ টা একদম অন্যরকম। এই ছাদে ই বসতো বাড়ির মহিলাদের আড্ডার আসর।। এখনো এই বিশাল ছাদটায় উঠলে এক ধরণের ভালোলাগা কাজ করে যেন নির্জন নিরিবিলিতে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়া যাবে।
জমিদার বাড়িটির ঠিক পূর্ব পাশে আছে লোহার গার্ডেন চেয়ার, গোল টেবিল, পানির ফোয়ারা।পিছন দিকে আছে বাগান যেখানে সাড়ি সাড়ি বিভিন্ন প্রজাতির আমের গাছ।আম বাগানের মাঝে আছে টালির দোতলা শেড। পূর্ব দক্ষিণ কোণে রয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এবং মসজিদের সামনে একটি বিশাল পুকুর। মসজিদ অনেক বেশি সুন্দর। যার প্রতিটি পিলারে খোচিত আছে মসজিদ আকৃতির অপরূপ নকশা। রাজবাড়ির সামনে রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান যেখানে শায়িত আছেন জমিদারদের পূর্বপুরুষেরা। সবুজে ঘেরা এই রাজবাড়িটিতে রয়েছে অনেক ছোট বড় গাছপালা।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে যখন জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় তখন থেকে এই জমিদার বংশের সমাপ্তি ঘটলেও অন্যান্য জমিদার বাড়ির তুলনায় এটি বেশ ভালো অবস্থানে আছে কারণ এখানে এখনো একজন কেয়ারটেকার বহাল আছেন।
সন্তোষ জমিদার বাড়িঃ
টাংগাইল সদর উপজেলার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু জমিদার বাড়ি।তারমধ্যে সন্তোষ জমিদার বাড়ি অন্যতম।এটি অপরুপ কারুকার্য খচিত জমিদার বাড়ি।
শিক্ষানুরাগী এই জমিদার বাড়ির তিন কন্যাদের জন্য আজোও সন্তোষ জমিদার বাড়ির সুনাম রয়েছে। সেই তিনজন নারী জমিদার হলেন-
জাহ্নবী চৌধুরানী, দিনমণি চৌধুরানী, বিন্দুবাসিনী চৌধুরানী। এই জমিদার রা ই আনন্দমোহন কলেজ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
টাংগাইল সদর উপজেলা থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে সন্তোষ নামের ছায়াঘেরা,পাখিডাকা একটি ছোট গ্রাম আছে।গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে লৌহজং নদী। এই গ্রামেই ১৮০০ শতকে প্রায় দুইশত বছর আগে জমিদার মন্মথনাথ রায় সন্তোষ জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।
জমিদার বাড়িটি নির্মিত হয়েছিলো ইট,সুরকি ও রড দিয়ে।জমিদার বাড়িতে অন্যতম আকর্ষণের বস্তু ছিলো সোনার মূর্তি, কষ্ঠি পাথরের শিব মূর্তি যা দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করতো।জমিদার বাড়ির পাশেই রয়েছে একটি বিশাল দিঘি। দিঘির পাশেই আছে বিস্তীর্ণ মাঠ। এই মাঠের পরে আছে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।একসময় এই সম্পূর্ণ জায়গা ছিলো জমিদারদের দখলে। কিন্তু জমিদাররা দেশত্যাগের পর অনেক জায়গা বাজেয়াপ্ত হয়।সেখানে গড়ে উঠে নানা স্থাপনা।
উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে এই জমিদার বাড়িটি আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। দালানগুলোর ইট,রড যেন খসে খসে পড়ছে। কতৃপক্ষ দৃষ্টি আকর্ষণে এই জমিদার বাড়ি হতে পারে একটি সুন্দর ও সুসজ্জিত পর্যটন কেন্দ্র।
ধলাপাড়া চৌধুরীবাড়িঃ
একটা সময় ছিলো যখন বাংলায় চৌধুরী পরিবার ছিলো। শিক্ষা সংস্কৃতি, রীতিনীতিতে ছিলো তারা আদর্শ।। টঙ্গাইল এ ও অনেক আগে ছিলেন চৌধুরী পরিবার। তাদের ই একটি নিদর্শন ধলাপাড়া চৌধুরীবাড়ি।।
মুসলিম এই চৌধুরী পরিবার ছিলেন ছিলেন আরব থেকে আগত কামেল পুরুষ শাহ একিন এর বংশধর। তবু তাদের এই আগমন সে ও কয়েকশ বছর আগের কথা।। ঠিক সেই সময়ে শুরু হয় এই চৌধুরী বাড়ির কাজ। তাও প্রায় ১২২৩ সাল। এতটা বছর পূর্বের সাক্ষী ই বহন করে আসছে এই চৌধুরীবাড়ি। প্রথমে ছনের ছাউনি, পরে টিনের ঘর, এরপর পাকা দালান। ঠিক যেমনটি আমরা শুরু করি ছোট ছোট কিছু থেকে বড় কিছু তেমনি।
এখনো এখানে আছে আটচালা পুরনো টীনের ঘর, যা এই চৌধুরীবাড়ির ঐতিহ্যের বাহক।। ভেতরে একটা সময় মহিলাদের গোসলের জন্য হাম্মাম খানা ছিলো যদিও সব ই এখন অতীত কেননা মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে সব ই। সেই সময়টায় এখানের মুসাফিরখানা ছিলো সুপরিচিত। অকাতরে মানবতার সেবায় অর্থ ব্যয় করে গেছে এই চৌধুরী বংশধর।।। আর অস্তিত্ব পুরনো হয়ে গেলেও বিলীন হয়ে যায়নি কিছুই। এত এত বছর পর ও এই ৮ একর জায়গা বিশিষ্ট এই চৌধুরীবাড়ি এখনো তাদের প্রতি সন্মান কেড়ে নেয়।।।।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়িঃ
টাংগাইল সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে নাগরপুর উপজেলার লৌহজং নদীর তীরে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি অবস্থিত। ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব কারুকাজ খচিত বিশাল অট্টালিকাগুলো।
ইংরেজ আমলের শেষ দিকে নাগরপুর আর কলকাতার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠলে ধনাঢ্য ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা নাগরপুর আসেন।উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি স্থাপন করেন। ১৫ একর জায়গা জুড়ে ৩ টি প্যালেস বা অট্টালিকা নির্মাণ করেন যার প্রতিটি তাদের সৌন্দর্য নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ।এজন্য এটি তিন মহলা বা তিন তরখ নামে ও পরিচিত। অট্টালিকা গুলো আকারের দিক থেকে বড়,মেঝো,ছোট হলেও একই রকম দেখতে।
বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে ৩ টি নাট মন্দির।৩ টি নাট মন্দির স্থাপন করা হয়েছে ৩টি অট্টালিকাকে কেন্দ্র করে। এখানকার অট্টালিকাগুলো শিল্প সংস্কৃতির এক অনন্য সৃষ্টি।রেলিং টপ কিংবা কার্নিশ যেদিকেই চোখ যায় শুধু ছোট ছোট নারী মূর্তি। দেখে মনে হয় পরীর মত নারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা অট্টালিকাজুড়ে । এছাড়াও প্রতিটি অট্টালিকার মাঝে আছে দুটি সুন্দর নারী মূর্তি যেগুলো লতা ও ফুলের অলংকরণে কারুকার্যময়।নারী মূর্তি গুলো দেখতেই মনে হয় এগুলো যেন জীবন্ত এক একটি যুবতী সুন্দরী নারী। তারপাশে আছে একটি করে ময়ূর যেনো স্বাদরে সম্ভাষণ জানাচ্ছে অতিথিদেরকে। অট্টালিকাগুলো যেন পরতে পরতে কালের নিদর্শন বয়ে বেড়াচ্ছে।
বাড়ির পেছনে আছে ১ টি দিঘি এবং ২ টি পরিত্যক্ত কূপ।বর্তমানে জমিদার বাড়িটি বিসিআরজি ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অট্টালিকা গুলোর কারুকাজ সমৃদ্ধ স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি মালিকের সৌখিনতাও প্রকাশ করছে। ১০০ বছরের পুরনো ছায়াঘেরা সুনিবিড় পরিবেশ জমিদারদের আমেজটা আজও ধরে রেখেছে।জমিদারবাড়িটি ভ্রমণপিপাসু ও ইতিহাস প্রেমীদের তৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি মনের খোরাক জুগিয়ে হারিয়ে দিবে অন্যভুবনে।
নাগরপুর চৌধুরীবাড়ীঃ
টাংগাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় ঠায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক অট্টালিকা এটাই নাগরপুর চৌধুরীবাড়ী। ৫৪ একর জায়গা জুড়ে এই স্থাপত্যশৈলি নিমার্নের মধ্য দিয়ে যদুনাথ চৌধুরী নাগরপুরে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন।পাশ্চাত্য ও মোঘল সংস্কৃতির মিশ্রণে নির্মিত এই অট্টালিকার সৌন্দর্য দেখার মত।
অট্টালিকার ভেতরের অংশ শ্বেতপাথর দিয়ে করা যা এখনক জ্বলজ্বল করছে।দেয়ালগুলোর সৌন্দর্য দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় কতটা অতীতে কি পরিমাণ নাম কুড়িয়েছে এ প্রাসাদ।অট্টালিকাটির অপরুপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। এক অপূর্ব নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মাণ করা হয়েছে বৈঠকখানা ও নাচঘর।লোক মুখে শোনা যায়,সেখান থেকে প্রতিদিন সকালবেলা সানাইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙতো গ্রামবাসীদের।এর পাশেই ছিলো চিড়িয়াখানা যেখানে হরিণ,ময়না,কাকাতোয়া, সিংহ, নীল বাঘ দেখা যেত।
চৌধুরী বাড়িটির দক্ষিণে রয়েছে একটি বিশাল দিঘি। দিঘিটির নাম উপেন্দ্র সরোবর। এটি আরেকটি দর্শনীয় স্থান যা ১১ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। এটি স্থানীয়দের কাছে “১২ ঘাটলা দিঘি” নামে পরিচিত।
এ এক দারুণ সুযোগ ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য জমিদার বাড়ির সাথে সাথে দীঘির সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারবে।
পূজা পার্বণের জন্য ছিলো ঝুলন দালান। যেখানে পরিবারের সকল ধরনের পূজা করা হতো। তবে বিশেষ দিবস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্রাবণের জ্যোৎস্না তিথিতে নাটক, যাত্রা পালার আয়োজন করা হতো এই দালানটিতে।
ব্যবসায়িক কাজের জন্য জমিদাদের ছিলো বেশ কিছু সুঠাম, সুদৃশ্য ঘোড়া। ঘোড়ার দেখাশোনা করার লোকের থাকা এবং ঘোড়াগুলোর জন্য ছিলো আরেকটি দালান। দালানটির নাম ছিলো ঘোড়ার দালান।দালানটি ছিলো শৈল্পিক কারুকার্য খচিত শ্বেত পাথরের।
বর্তমানে চৌধুরীবাড়িটি নাগরপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।স্থানীয়দের দাবি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই জমিদার বাড়িটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচালনা করা হোক। যাতে করে শত শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য কালের পরিক্রমায় হারিয়ে না যায়।
ধনবাড়ী নওয়াব বাড়িঃ
টাংগাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলার বংশাই ও বৈরান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই নওয়াব বাড়ি অবস্থিত। এটি স্থানীয়দের কাছে নবাব প্যালেস, নবাব বাড়ি,নবাব মঞ্জিল নামেও পরিচিত। আনুমানিক ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এই রাজবাড়ী স্থাপন করেন।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে কাচারিবাড়ি। কাচারি বাড়িটি বিচার,বৈচক কিংবা সভা অনুষ্ঠিত হলে তখন ব্যবহার করা হতো।পাশেই আছে সুসজ্জিত বাগানে হরেকরকম ফুলের মেলা। কয়েক পা এগুতেই দেখা মেলে নওয়াব আলীর মূল বাসভবন।এই স্থাপনাটি আজও সুন্দর আছে কেননা লাইটহাউজ নামক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এর দেখাশোনা করছেন। এ বাড়ির আকর্ষণীয় একটা দিক হলো এর আমবাগান যেখানে আছে বহু প্রজাতির আম। বৃক্ষপ্রেমী নওয়াব যখন এদেশ ওদেশ বেড়াতে যেত সব জায়গা থেকেই আম গাছ এনে এখানে লাগিয়েছিলো।
নওয়াব বাড়ির কাছেই রয়েছে সাতশত বছরের পুরোনো মসজিদ যা মোগল আদলে তৈরি।যার নাম ধনবাড়ি নওয়াব শাহে মসজিদ। দশ কাঠা জমির উপর কালের স্বাক্ষী হিসেবে সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি।যার বাহিরের দেয়ালে সিমেন্ট ও কড়ির ট্যারাকোটা নিদর্শন এবং ভিতরের দেয়ালে কড়ি পাথরের লতাপাতা আঁকা, মোজাইক দ্বারা অসংখ্য নকশা পরিলক্ষিত হয়।এখানে নবাব আলী চৌধুরীর সমাধিসৌধ ফলে ২৪ ঘণ্টা অনবরত কোরআন তেলাওয়াত করা হয়।এছাড়াও আছে পারিবারিক কবরস্থান, গোমস্তা, নায়েব,পাইকপেয়াদারদের বসতি ঘর, কাচারিঘর,দাস-দাসীদের চত্বর।
বর্তমানে এটি রির্সোট হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার নাম দেয়া হয়েছে রয়্যাল রিসোর্ট।বাড়িটির বারান্দায় নানা সময়ের নবাব বংশের জমিদারদের অবদান, ইতিহাস,পারিবারিক স্মৃতিবিজড়িত কাহিনী নিয়ে লেখা ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে। দর্শনার্থীরা সহজেই সেগুলো পড়ে সেখান থেকে নবাব বংশের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। যেকেউ রিসোর্ট কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে সম্পূর্ণ বাড়ি ঘোড়ায় করে পরিভ্রমণ করতে পারে এবং এখানে লাঠি খেলা অনুষ্ঠিত হয় আজ ও।
মোকনা জমিদার বাড়িঃ
টাঙ্গাইল আমাদের জমিদারবাড়ির জন্য প্রসিদ্ধ৷ প্রতিটি জমিদারবাড়ি যেন একেকটি শিল্পকর্মে সমৃদ্ধ৷ সেই সময়ের রাজমিস্ত্রীরা বা যারাই এই পেশায় ছিলেন তারা যে কতটা মেধাবী ছিলেন তার পরিচয় মেলে রাজবাড়ির প্রত্যেক প্রতে পরতে।
তেমনি একটি রাজবাড়ি হলো আমাদের নাগরপুর উপজেলার মোকনা জমিদারবাড়ি। প্রাচীন সময়ের অন্যতম নিদর্শন। প্রায় ১০০ বছরের ও বেশি পুরনো এই জমিদারবাড়ি আজ ও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে মামুদনগর ইউনিয়ন এর পাশ দিয়ে ধ্বলেশ্বরী নদীর ওপারে। একটা ব্যাপার খুব ই লক্ষণীয় যে ঐ সময় গুলোতে জমিদার রা তাদের বাড়ি গুলো এমন জায়গাতে ই করতেন যেখানে থেকে নদী বন্দর গুলো কাছে হয়।
মোকনা জমিদারবাড়ি তে ঢুকতে ই সেকেলে একটা ভাব বিদ্যমান। এত সুন্দর দরজার উপরের কারুকাজ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়না। সেই সাথে দারুন ফুল লতা পাতার কারুকাজ দেয়ালজুড়ে।।। যদিও সৌন্দর্য অনেকটা ই বিলীনের পথে যথোপযুক্ত সংস্কার এর অভাবে৷ এই জমিদারবাড়ি গুলো এখনো টিকিয়ে রাখার উপায় একটা ই সরকারিভাবে সংস্করন।
চারু চন্দ্র রায় জমিদারবাড়ি, বাসাইলঃ
টাঙ্গাইল এর বাসাইল একটি অত্যন্ত সুন্দর উপজেলা। এর মাঝ বরাবর বয়ে গেছে মরাগাঙ্গী।। এর ই পাড়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার চারুচন্দ্র রায় এর বাড়ি।
প্রজাহিতৈষি জমিদার হিসেবে অনেকের দাপট ছিলো অনেক বেশি তেমনি ছিলেন চারুচন্দ্র। তার বাড়ি টা ও দেখার মত দর্শনীয় একটি স্থান।
বাধানো পুকুর পাড় বাড়ির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। বাড়ির দালান গুলোতে একের পর এক চিত্রকর্ম যেন সৌন্দর্যমনা জমিদার এর রুচির প্রকাশ পায়। বাড়ির সামনের অংশটকুই মন কেড়ে নেয়। দূর থেকেও যেন বোঝা যায় যে চাকচিক্যময় একটি প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে।।।
অলোয়া জমিদার বাড়ীঃ
জমিদার বাড়ি মানেই চাকচিক্য, সুন্দর নকশা খচিত দেয়াল, বিশাল দালান। অনেএএএক জায়গা জুড়ে যেন তাদের অস্তিত্ব।।। অলোয়া জমিদার বাড়ী ও এর ব্যতিক্রম না। ১৩২ শতাংশ জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছিলো এই রাজবাড়ী প্রায় ১৮০০ সালে একদম টাঙ্গাইল সদর উপজেলাতেই। জমীদার শচীনাথ চৌধুরী ময়মনসিংহ থেকে এখানে চলে এসে এই জমিদারবাড়ি তৈরি করেন।
সময়ের পরিক্রমায় বদলে যায় অনেক কিছুই। বদলে গেছে এখানেও। সেই চকচকে ভাব টা বিদ্যমান নেই। কেননা ১৯৫০ সালে এ বাড়ির শেষ কর্ণধার কনক লতা রায় পাড়ি জমান ভারতে। এরপর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে থেকে এখন তার জীর্ণ অবস্থা। এতকিছুর পর ও বাড়িতে ঢুকতেই বুঝা যায় কি সুন্দর ই না ছিলো একটা সময়। এখন ও এত অবহেলাতে ও সিমেন্ট এর নকশাখচিত দেয়াল গুলো তাদের রূপ ধরে রেখেছে।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে বাড়ির স্থাপনায় মুগ্ধ হতেই হয়। এ বাড়ির জমিদার যে পাখিপ্রেমিক ছিলো তার চিহ্ন আছে বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে। পাখিদের জন্য ছোট ছোট খোপ করা আছে। এখনো নেই জমিদার কিন্তু আছে পাখপাখালির কলোরব।।।
আগেকার যুগে ছিলো না এত রড এর কারসাজি। তাই দেয়ালগুলো সব সময় ই এত চ্যাপ্টা হয় যে বাড়ি গুলো একদম আলাদা একটা সৌন্দর্য বহন করে। সেই সময় ছিলোনা বিদ্যুৎ তাই বাড়ির ভেতরের দেয়াল বরাবর একটু ফাঁকা জায়গা আছে যা দিয়ে বাতাস প্রবেশ করতে পারে৷ প্রতিটা রুমেই আছে বেশ কয়েকটি কূপিবাতি রাখার জন্য সুন্দর দেয়ালের সাথেই খোপ।। ইভেন জানালা দরজা গুলো কতটা মজবুত কাঠ দিয়ে তৈরি যে এখনো তা আছে। কিছু কিছু জানালায় আমরা এখন যেমন বাতাস ভেতর বাহিরের জন্য এক্সহস্ট ফ্যান ব্যবহার করি, কাঠা দিয়েই সেভাবে করা যাতে টান দিয়েই বন্ধ বা খোলা যায়।
সত্যিই ছিলোনা আর্টিফিশিয়াল ব্যবস্থা কিন্তু জীবন জমিদারবাড়িতে আলোশান ই ছিলো বোঝা যায়।। তবে খারাপ লাগা কাজ করে এটা ভাবলেই যে এই ঐতিহ্য গুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কোন সংস্কার করা হচ্ছেনা৷ এগুলো সংস্কার করা হলে অবশ্যই তা অনেক বড় সম্পদ হতে পারে৷
এত সৌন্দর্যের বাহার আমাদের এ প্রতিটি জমিদারবাড়ি কিন্তু এর মাঝে বেশিরভাগ গুলোই অবহেলিত। অথচ প্রতিটি জমিদারবাড়ি হতে পারে একেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। একটু যত্ন এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে পুননির্মাণ করা হলে প্রতিটা জমিদারবাড়ি হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। আমাদের এ জেনারেশন এবং আমাদের পরবর্তী জেনারেশন এর জন্য, তাদের কে আমাদের এ ইতিহাস গুলো জানানোর জন্য অবশ্যই এদিকে যথাযথ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
ইন্টারনেট এর মাধ্যমে আমাদের এ জমিদারবাড়ি গুলো সম্পর্কে জানবে সবাই এবং এখানে এগুলোকে ঘীরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে ইন শা আল্লাহ। ই-কমার্স এর হাত ধরে পর্যটন কেন্দ্রগুলো সকলের হাতের নাগালে চলে আসবে এশুধু সময়ের অপেক্ষা।এখন যেহেতু টাঙ্গাইল সদর থেকে প্রতিটি জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ই ভালো তাই অবশ্যই ভ্রমণপিপাসু বিশেষ করে যারা পুরণো ঐতিহ্য, আগেকার সেই ইট পাথর, দেয়ালে হাড়িয়ে যেতে চান তাদের জন্য বেস্ট জায়গা আমাদের রাজবাড়িগুলো৷
লেখক
ইসরাত জাহান জীম ও রোখসানা আক্তার পপি