খাতুনে জান্নাত আশা, ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি, টেকজুম টিভি// মাল্টা একটি অর্থকরী ফসল। এটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সুস্বাদু ফল, আমাদের দেশে এর জনপ্রিয়তা শীর্ষেই বলা যায়। মাল্টা সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় বেশি জন্মায় বলে জানলেও বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার সমতল ভূমিতেও এর চাষ হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে।
মাল্টার আদি উৎপত্তি স্থল আসলে ভিয়েতনাম, উত্তর পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ চীন, যা বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদিত সাইট্রাস ফসলের দুই তৃতীয়াংশ এবং এটি বিশ্বে সর্বাধিক জনপ্রিয় সাইট্রাস ফল। বর্তমানে এই ফলটি বিশ্বের উষ্ণ ও অব–উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় বেশী চাষ হচ্ছে। তাই বাংলাদেশে এই ফলটির চাষ এবং চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলছে। কমলার তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশী হওয়ায় এবং উন্নত জাত ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক এর চাষ করে সফল হচ্ছেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে উৎপাদিত এসব মাল্টা কৃষকদের থেকে সারাদেশে পৌঁছে দিতে পারে ই-কমার্স।
মাল্টা চাষে সাফল্যের গল্পঃ
ত্রিশালে সফল রফিকুল ইসলামঃ
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার মোক্ষপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল কৈতরবাড়ী গ্রামের নেয়ামোতুল্লাহর ছেলে রফিকুল ইসলাম পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ ১৪ বছর প্রবাসে কাটিয়েও যেন ব্যর্থ হয়েছিলেন নিজের ভাগ্য ফেরাতে। কিন্তু ৯ বছর মালেশিয়ায় তার বাগান পরচর্যার কাজ বিফলে যায় নি। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০১৪ সালে দেশে ফিরে বাড়ির পাশের ২ একর অনাবাদি বা অকৃষি চালার জমিতে গড়ে তুলেন “রফিক ফলজ ও কৃষি খামার”। বাগানে রোপন করেন মাল্টা, আমড়া, লিচু, আমলকি, উড়-বরই, আম, লেবু ও পেঁপেসহ নানা প্রজাতির ফলের চারা। কঠোর পরিশ্রম ও পরিচর্যার ফলে বছর দুই ঘুরতেই গাছগুলোতে ফল ধরতে শুরু করে। আর নিজের স্বচ্ছলতার পাশাপাশি এই দৃষ্টিনন্দন ও উৎপাদনশীল ফলজ বাগানের মাধ্যমে ৮/১০ জন বেকার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি।
রফিকুল ইসলাম জানান, গত বছর ১২কাঠা জমি থেকে মাল্টা বিক্রি করেছেন ৩লক্ষ টাকার । তার ফলজ ও কৃষি খামারে উৎপাদিত মাল্টা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে ও পুষ্টি চাহিদা পুরণে বিশেষ অবদান রাখায় কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি সম্মাননা ও প্রশংসাপত্র কুড়িয়েছেন তিনি। রফিকের উৎপাদনধর্মী ফলজ বাগান দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো বেশ কয়েকজন স্থানীয় কৃষক ফলজ বাগান করেছেন।
ফুলপুরের কৃষকদের সফলতাঃ
২০১৭ সালে ফুলপুর উপজেলার পয়ারী ইউনিয়নের গুপ্তেরগাঁও গ্রামসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে মোট ১০জন কৃষককে দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম মাল্টা চাষের শুরু হয়। প্রথমে সাহাপুর ব্লকের কৃষক নবী হোসেনের সাফল্য দেখে গ্রামের অন্যান্য কৃষকরাও মাল্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠে। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে মোট ১৫-১৬টি মাল্টা বাগান গড়ে উঠেছে সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে। তারা মূলত বারি মাল্টা-১ জাতের মাল্টা চাষ করছেন, যা আকারে বেশ বড়, দেখতে সুন্দর, খেতেও খুব সুস্বাদ। বাজারে এসব মাল্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আরেকটা সুবিধা হচ্ছে মাল্টা বাগানে সাথী ফসল হিসেবে মুখি কচুও করা যায়। তাই অধিক লাভের সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এ এলাকার মাল্টা চাষীদেরকে সরকারিভাবে সার, বিষ প্রদানসহ বিভিন্ন সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে।
গৌরীপুরে মাল্টা চাষে সাফল্যঃ
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকবিহীন মাল্টা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সাতুতী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সহকারি কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হাজী মো: আবুল মুনসুর আহম্মেদ। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন মাল্টা বাগান করবেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালের জুন মাসে তিনি ৯০টি বারি-১ জাতের মাল্টার চারা সংগ্রহ করে এক বিঘা সমতল ভূমিতে রোপন করেন। রোপনের এক বছরের মধ্যেই অর্ধেক চারাগুলোয় ফলন ধরে। দুই বছরের মাথায় এসে সবগুলো গাছেই আশানুরূপ মাল্টার ফলন হয়েছে এবং প্রতিটি গাছে গড়ে ৫০-৬০টি মাল্টা ধরে। সাথী ফসল হিসেবে তিনি মাল্টা বাগানে মূলা, বেগুন, পেঁপে ও মিষ্টি কুমড়া, ঢেড়ঁসসহ বিভিন্ন শাকসবজি¦ আবাদ করেও অর্থ উপার্জন করেছেন। আবুল মুনসুর আহম্মেদের এই মাল্টা চাষের সফলতা দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা। প্রতিদিন মাল্টা বাগান দেখতে আসা লোকজন তার কাছ থেকে চারা কেনার আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তাই স্থানীয় লোকজনকে মাল্টা চাষে উৎসাহিত করতে ও তাদের চাহিদা মেটাতে প্রথম পর্যায়ে এক হাজার মাল্টার চারা তৈরীর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি, যা স্থানীয় কৃষকদের মাঝে মাল্টা চাষে প্রেরণা জোগাচ্ছে।
ভালুকায় মাল্টা চাষে সফল মাজহারুল ইসলামঃ
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও চাকরির পাশাপাশি কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেছিলেন ভালুকার মাজহারুল ইসলাম। সেই প্রচেষ্টা থেকেই নিজের গ্রাম ময়মনসিংহের ভালুকায় উপজেলার কাদিগড়ে ৮ একর জমিতে বারি -১ জাতের মাল্টার চাষ শুরু করেন। বর্তমানে তার ৩টি মাল্টা বাগান রয়েছে। ২০১৯ সালে ১৭০০ টি মাল্টা গাছ থেকে ২.৫ টন, ২০২০ সালে ২৫৫০টি মাল্টা গাছে থেকে ১৮-২০ টন মাল্টা উত্তোলন করেছেন। মাল্টার চাষ করার পাশাপাশি এগুলোর চারা বিক্রি করে ও বিভিন্ন সাথী ফসলের চাষ করে বেশ ভালো অর্থ উপার্জন করেন তিনি।
গারো পাহাড়ে মাল্টা চাষে সফল শওকত আলমঃ
গাজীপুর থেকে শওকত আলম ২০১২ সালে বেড়াতে এসেছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বুরুঙ্গা গ্রামে। পাহাড়ি এ গ্রাম ঘুরে তার মনে হয়েছিল এখানে মাল্টা চাষ খুব ভালো হবে। আর তাই গারো পাহাড়ের উঁচু টিলায় তিন একর জমি কিনে ওই বছর থেকেই ময়মনসিংহে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ফলদ বৃক্ষের গবেষণা কেন্দ্র ‘জার্মপ্লাজম সেন্টার’ থেকে মাল্টার চারা এনে রোপণ করে মাল্টার আবাদ শুরু করেন শওকত। আর বছরখানেকের মধ্যেই গাছে মাল্টা ধরা শুরু হয়। তিনি মনে করেন, গারো পাহাড়ি এলাকায় ফলের আবাদ করলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও অনেক এগিয়ে যাবে। শুধু শওকত নন, গারো পাহাড়ে আরও অনেকে চাষী মাল্টার চাষ করছেন। বিভিন্ন টিলা ও টিলাঘেঁষা বিভিন্ন পতিত জমিতে এখন সারি সারি মাল্টা গাছ।
বারি-২ ও বারি-৪ জাতসহ অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতের মাল্টার চাষ হচ্ছে গারো পাহাড়ে। বিদেশি মাল্টা রঙিন হলেও গারো পাহাড়ের মাল্টা সবুজ, কিন্তু এর স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। রাসায়নিক ব্যবহার করলেই এর রং বিদেশি মাল্টার মতো হয়ে ওঠে, কিন্তু এ এলাকার চাষীরা সেটা করছেন না। তবে পাকা মাল্টার রং প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা হালকা কাঁচা হলুদের রং চলে আসে। শেরপুর জেলাসহ ঢাকায় এসব মাল্টার বেশ চাহিদা রয়েছে। এসব মাল্টা বিদেশি ও দেশে উৎপাদিত অন্যান্য জেলার মাল্টার চেয়ে অনেক গুণ বেশি সুস্বাদু। তাই আশা করা যাচ্ছে, এ জেলায় আগামীতে মাল্টার আবাদ আরও বাড়বে।
মাল্টার উপকারিতাঃ
- মাল্টা ভিটামিন ‘সি’সমৃদ্ধ ফল, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সম্পন্ন। এটি রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা বাড়ায়, যা দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই মাল্টা রক্তশূন্যতায় ভুগছে এমন মানুষের জন্য বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মাল্টায় পেকটিন নামের একধরনের ফাইবার আছে, যা কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- মাল্টা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, তাই ডায়াবেটিকস রোগীরা নির্দ্বিধায় এটি খেতে পারেন।
- মাল্টার হেসপেরিডিন এবং ম্যাগনেসিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
- মাল্টায় অতি সামান্য ক্যালরি থাকে, তাই খাওয়া যায় ইচ্ছামতো। চিনি দিয়ে বানানো শরবতের থেকে এটি একদিকে যেমন অধিক পুষ্টিকর, তেমনি সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর। শরীরের কোলেস্টেরল এবং মেদ কমাতেও সাহায্য করে এটি।
- নিয়মিত মাল্টা খেলে ত্বকে সজীবতা বজায় থাকে এবং এটি মুক্তি দিতে পারে ত্বকের বলিরেখা থেকে, যা ত্বকের লাবণ্যতা ধরে রাখতে সাহায্য করে থাকে।
দেশের অর্থনীতি এবং ই-কমার্সে এর সম্ভাবনাঃ
করোনা প্রকোপে স্থবির অর্থনীতির প্রাণ ফিরিয়ে আনছে দেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি। সংকটময় এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকেই। প্রায় দুবছর ধরে চলমান এই সংকটে যেমন অনেক পেশাজীবী চাকরীচ্যুত হয়েছেন, আবার অনেক শিক্ষিত বেকার চাকরির জন্য অপেক্ষামান, যারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশায় দিন গুনছেন। এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে না থেকে উপরোক্ত সাফল্যের গল্পগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে কাজে লাগাতে পারেন নিজেদের মেধা এবং শ্রম। মাল্টা চাষ এবং ই-কমার্স সেক্টরের মাধ্যমে এর প্রচার ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারেন।
একে কেন্দ্র করে তৈরী হতে পারে কিছু জেলাভিত্তিক উদ্যোক্তা, যারা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের উৎপন্ন নিরাপদ বিষ্মুক্ত দেশি মাল্টা ই-কমার্সকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশে পৌঁছে দিতে পারেন।