“জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে হেইও লাখো মানুষের কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত হয় এমন বাণী আর চলে ৪০ কেজি বা এক মণ ওজনের একটি পিতলের বল নিয়ে কাড়াকাড়ি, এটাই ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া অঞ্চলের প্রায় তিন’শ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী হুমগুটি খেলা। আর্শ্চয ব্যাপার হল, এই খেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলের গ্রামগুলোতে একটা আলাদা সংস্কৃতি, অত্রাঞ্চলের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুতেই রয়েছে যেন এই খেলার রেশ। সারাবছর ধরেই যেন সেই অঞ্চলের মানুষগুলো অপেক্ষমাণ থাকে, নানান জল্পনা কল্পনা আর প্রস্তুতি চলতে থাকে তাদের এই হুমগুটি খেলার উ সবকে ঘিরে। খুব অবাক লাগছে তাই না? ফুলবাড়িয়া উপজেলা নিয়ে স্টাডি করতে গিয়ে প্রথম
এই খেলার কথা জেনে আমিও প্রথম ভীষন অবাক হয়েছিলাম, একি সাথে খুব আর্কষন বোধ করছিলাম। তাই এটা নিয়ে স্টাডি করতে শুরু করলাম আর জানতে পারলাম অনেক ইন্টারেস্টিং তথ্য। সবই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি এই লেখার মাধ্যমে।
হুমগুটি খেলার ইতিহাসঃ
ইতিহাসের দিক দিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল বেশ সমৃদ্ধ। প্রতাপশালী জমিদারদের শাসনে এই অঞ্চলের জনপদ প্রাচীনকাল থেকেই অনেক ঐতিহ্য বহন করে
এসেছে। এই হুমগুটি খেলার জন্মও হয়েছিল তেমনিভাবে দুই জমিদারের জমি নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত থেকে। তালুক-পরগনার সীমানার জমি নিয়ে মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশীকান্তের সঙ্গে ত্রিশাল উপজেলার বৈলরের হেমচন্দ্র রায় জমিদারের বিরোধ
হয়েছিল প্রায় তিন’শ বছর আগে।
যতদূর জানা যায় ঘটনাটা ছিল এমন, তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল তখন ১০ শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাডে় ৬ শতাংশে। একই জমিদারের জমিতে দুই নীতির কারণেই প্রথম দুই
এলাকাবাসীর মাঝে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই বিরোধ মীমাংসা করার জন্য লক্ষ্ণীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে ‘তালুক-পরগনার সীমানায়’ এই গুটি খেলার
আয়োজন করা হয়েছিল জমিদারদের তত্ত্বাবধানে। ফুলবাড়িযা উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষ্মীপুর ও ১০ মাইলের মাঝামাঝি “বড়ই আটাবন্ধ” নামক বড়
মাঠ হলো খেলার কেদ্রস্থল। স্থানটি মুক্তাগাছা-ত্রিশাল জমিদার আমলে তালুক (৯ শতাংশে ১ কাঠা) বনাম পরগনার (সাড়ে ৬ শতাংশে ১ কাঠা) সীমানা ছিল। গুটি খেলার র্শত ছিল, গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’।
মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্তের প্রজারা বিজয়ী হয়েছিল জমিদার আমলের সেই ঐতিহাসিক গুটি খেলায়। আবার জনশ্রুতি আছে, প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য নাকি
জমিদাররা এ খেলাটির প্রচলন করেছিলেন।
সেই থেকেই এলাকার মোড়ল পরিবার আর প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা প্রতিবছর আয়োজন করে আসছে এই খেলার আর ধরে রেখেছে এলাকার ঐতিহ্য, বাঁচিয়ে রেখেছে ইতিহাস।
হুমগুটি কি?
খেলার মূল উপকরণ হুমগুটি হল একটা বৃহদাকার পিতলের কলসির গলার নিচের গোলাকার অংশের মতো দেখতে একটি অংশ, যার ভিতরে এমনভাবে মাটি ঠেসে ভরা হয় যে, মুখ বন্ধের পর তাতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েও মাটি বের করা যায় না। যার ওজন হয় প্রায় ৪০ কেজি বা এক মণ।
খেলার সময়কালঃ
হুমগুটি খেলার দিন র্নিধারণ করা হয় বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি বাংলা র্বষের পৌষের শেষ দিনে। সাধাররণত ফাল্গুনে আমন ধান ও ত পরর্বতী রবিশস্য তোলার পর
চৈত্রের শেষে অথবা প্রথমে ফসলবিহীন দিগন্ত বি¯র্তৃণ খোলা প্রান্তরে এ খেলা জমে উঠে । পৌষ মাসের শেষ দিনকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় “পুহুরা”। এই পুহুরার দিনে যুগ যুগ ধরে একি জায়গায় একি সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে
আসছে এই ঐতিহ্যবাহী খেলা! এই বছরও একইভাবে একইসময়ে একইস্থানে অনুষ্ঠিত হবে ২৬২ তম হুমগুটি খেলা।
হুমগুটি খেলার নিয়মঃ
প্রতি বছর পৌষের শেষ বিকেল সোয়া ৪টায় ফুলবাড়িয়ার লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটা নামক স্থানে স্থানীয় “হুমগুটি স্মৃতি সংসদের” কমিটি উদ্ভোদন করেন হুমগুটি খেলার।
প্রথমে এ খেলায় দুই দল থাকলেও, র্বতমানে চার এলাকা র্অথা উত্তর, দক্ষিণ, র্পূব ও পশ্চিম দিক হিসেবে ভাগ করে চার দলের মাঝে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলা শুরু হয়ে গেলে আর কোন দল কোন দিকের এটার কোনো হদিস থাকেনা এতো লোকের ভীড়ে, তবে চারটা দিকের আলাকা অনুযায়ী নিশানা দিয়ে সীমানা র্নিধারিত থাকে আর সেদিকে গুটিকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা দেখেই বোঝা যায় কোন দল কোন এলাকার হয়ে খেলছে।
প্রতিযোগী গ্রামগুলোর সমদূরত্বে অবস্থিত একাধিক গ্রাম অতিক্রম করে ভিন্ন একটি গ্রামের র্নিদিষ্ট জায়গায় হুমগুটি রাখা হয়।উভয় দলের মনোনীত নেতার র্নিদেশ
পাওয়া মাত্র শুরু হয় খেলা। হুমগুটি নামক পিতলের বস্তুটিকে মাঝখানে রেখে চারদিক থেকে আসা খেলোয়াড়রা র্পযায়ক্রমে খেলতে থাকে। অনেকটা কেড়ে নেওয়ার মতো। তবে এই কাড়াকাড়ি হয় লক্ষ মানুষের ভিড়ে চেনা-অচেনা মানুষের মাঝে। এই হুমগুটি খেলায়
কোনো বিচারক থাকে না, খেলোয়াড়রা নিজেরাই বিচারকের ভূমিকা পালন করে। এমনকি বিজেতা দল কোনো পুরষ্কারও পায় না। খেলে নিতান্তই নিজ এলাকার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করতে আর মনের আনন্দে। ঢাল-তলোয়ার,হাতী-ঘোড়া বিহীন যুদ্ধ এটি। একেক
জন জীবনপণ কাড়াকাড়ি করে। কেবলই এটি প্রাণবন্ত ও চিত্তার্কষক র্নিমল প্রতিযোগীতা আর আঞ্চলিক ঐতিহ্য রক্ষার নিরন্তর প্রয়াস। এক পক্ষ ১শ গজ টেনে নিয়ে গেলে , আবার অপর পক্ষ নিয়ে গেল দুইশ গজ। এটা দারুক এক উত্তেজনাকর দৃশ্য। একটি গুটির উপর পরস্পর বিরোধী বহু সংখ্যক লোক ঝাঁপিয়ে পরে , কিন্তু নিয়ম
ভেঙ্গে কেউ কাউকে আঘাত করে না। এটি সত্যিই বিরল এক অভিজ্ঞতা।খেলোয়াড়দের মনকে উ ফুল্ল রাখার জন্য ঢোল, সানাইয়ের ব্যবস্থা থাকে। বাদ্যের
তালে তালে একসঙ্গে জড়ো হয়ে হাততালি দিতে দিতে সবার মধ্যে একজন ডাক ভাঙে, ‘জিতই আমাদের রে… (সবাই একস্বরে ডিও…)/ গুডি… নিলো… গা… রে… (সবাই
একস্বরে ডিও…)’ বলতে বলতে গুটির ওপড় ঝাঁপিয়ে পড়ে। যতক্ষণ না ক্লান্ত হয় ততক্ষণ ঠেলতে থাকে। এভাবে ঠেলতে ঠেলতে সে দলটি বেরিয়ে আসে। আবার অন্যদল
একইভাবে আবার বেরিয়ে আসে। প্রত্যেক দিক থেকে এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলা চলতে থাকে। চারদিক থেকে ঘিরে ধরা লোক খেলাটিকে উপভোগ করতে থাকে।
খেলতে খেলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এলে খেলার পরিবেশ হয়সর্ম্পূণ ভিন্ন। ইচাইল বিলের পাশের একটি বন্দে খেলা আরম্ভ হয়। কোনো কোনো সময় সেই বিলের মাঝখানেও চলে যায় খেলাটি। কোনো বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। খেলা দেখতে আসা হাজার হাজার মানুষ র্টচ লাইট নিয়ে আসে। খেলাকে ঘিরে নিজ নিজ দিকের লোকেরা সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নেয়। দলকে সাহায্য করার জন্য র্টচ লাইট জ্বালিয়ে হাত নেড়ে ইশারা করতে থাকে। খেলার
জন্য র্নিদিষ্ট জায়গা বরাদ্দ থাকে না। ফাঁকা জায়গার দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। কখনো কখনো বিপদের মুখেও পড়তে হয়। ঝোঁপ-ঝাঁড় উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।
র্দশকরা সবচেয়ে বেশি মজা উপভোগ করে যখন গুটিটি কোনো পুকুর বা খালে গিয়ে পড়ে।
অমনি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গুটির ওপর। পৌষের শীতের রাতে পানি থেকে গুটি উদ্ধারের যুদ্ধ ভাবা যায়! অল্প পানি হলে চেষ্টা করা হয় গুটিকে কাঁদার নিচে লুকিয়ে ফেলার।
এছাড়া ঠেলতে ঠেলতে যখন কোনো রাস্তার ধারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন প্রাণপণে চেষ্টা করা হয় রাস্তা পার করে নিয়ে যেতে। সে সুযোগটি হাতছাড়া করে না প্রতিপক্ষ। যখন গুটিকে ঠেলে উঠাতে চায়; তখন উপর থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেওয়া হয়।
এভাবে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগে চলতে থাকে এই খেলা। বিজয় র্অজিত না হওয়া র্পযন্ত শেষ হয়না। খেলা শুরু হওয়ার পর সময়সীমা বাঁধা থাকে না। কোনো কোনো বছর সারা রাত খেলা চলে, এমনকি পরদিন র্পযন্তও চলতে থাকে। র্সবোচ্চ ৩দিন র্পযন্তও এই খেলা চলার রের্কড রয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম ভেঙ্গে হুমগুটি নিয়ে নিজ গ্রামের সীমানার ভেতর প্রবেশ করার সাথে সাথে খেলার সমাপ্তি।
হুমগুটি খেলা কেন্দ্রীক উ সবঃ
উপজেলার লক্ষ্মীপুর, বড়ই আটা, বাটিপাড়া, বালাশ্বর, চরকালিবাজাইল, তেলিগ্রাম, সাড়ুটিয়া, ইচাইল, কাতলাসেনসহ অন্তত ১৫-২০টি গ্রামের মানুষ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে। ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল, মুক্তাগাছা, ভালুকাসহ আশে পাশের উপজেলাগুলো থেকেও প্রচুর লোক জমায়েত হয় খেলার জন্য।
ঘরে ঘরে চলে নতুন আমন ধানের পিঠা-পুলির উ সব। পিঠার মধ্যে অন্যতম নুন-মরিচের পিঠা, গুটা পিঠা, তেলের পিঠা, দুধ চিতই পিঠা, কলার পিঠা। গ্রামগুলোতে খেলার কয়েকদিন আগেই আসতে থাকে দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজন, গ্রামের বিবাহিত মেয়েরা বাবার বাড়ি নাইয়র চলে আসে। খেলা উপলক্ষ্যে কেনা হয় নতুন পোশাক। গরু-খাসি জবাই করে আয়োজন করা হয় ভুরিভোজের। বিজেতা দল গ্রামের প্রভাবশালী পরিবারে এসে ভুরিভোজে অংশ নেয়। গ্রামের সবার বাড়িতেই সেদিন অনেক খাবারের আয়োজন করা হয় আর মন খুলে খেলার অংশগ্রহণকারী খেলোয়ার আর র্দশকদের খাওয়ানো হয়।