বিদেশী নাকি দেশী ফল? স্থানে কিছুই এসে যায়না কেননা কালের বিবর্তনে বিদেশী ফল গুলোই হয়ে যায় আমাদের দেশী ফল৷ সময়ের পরিবর্তন এর সাথে সাথে আমাদের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে কত কত বিদেশী ফল যে আমাদের দেশী হয়ে গিয়েছে তার সংখ্যা আমাদের অজানা। ঠিক তেমনি একটি বিদেশী ফল নিয়ে আজকের আলোচনা। “ড্রাগন ফল” যা বিদেশী ফল হলেও দেশের মাটিতে হচ্ছে এর বাণিজ্যিক চাষ এবং ফলন ও হচ্ছে বাম্পার৷ টাঙ্গাইল এর মাটি তে ও চাষ হচ্ছে এই ফলের যা হয়ে উঠতে পারে ই-কমার্স এর একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পণ্য।
বাংলাদেশ কৃষিতে ভরপুর। আমাদের দেশের মাটি সোনার চেয়ে ও খাঁটি তা আমরা সবাই জানি। সত্যি বলতে এ দেশের মাটিও যেমন সোনা, তেমনি কৃষিবীদরা ও। অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের জন্য দিনের পর দিন নানান জাতের ফল, মূল, সবজি, কৃষিজ পণ্যের সম্ভার তুলে দেন আমাদের হাতে। যা পরবর্তীতে হয়ে উঠে আমাদের আবাদযোগ্য।
ক্যাকটাস জাতীয় এক ধরণের গাছ থেকেই আমরা পাই ড্রাগন ফ্রুটস বা ড্রাগন ফল, অন্য আরেকটি নাম পিটাইয়া।।। আসলে বিভিন্ন দেশে এর বিভিন্ন নাম। চীনে এই ফলের নাম হুয়ো লং, থাইল্যান্ড এ বলা হয় ড্রাগন ক্রিস্টাল, ভিয়েতনাম এ থানহু লং বা সুইট ড্রাগন বলা হয়। ভয় পাবার কোন কারণ নেই পিঠে ড্রাগনেরঅত অবায়ব এর কারণেই এর নাম ড্রাগন অন্য কোন কারণ ই নেই।
হালকা মিষ্টি মিষ্টি, হালকা টক টক, টক মিষ্টি স্বাদের এ ফল টা এখন সবার পছন্দের লিস্ট এ আছে। আসলে দেশ বললে ভুল হবে বাহিরে ও অনেক বেশি জনপ্রিয় একটি ফল। শুরুতে সেন্ট্রাল আমেরিকা তে এ ফল আসলে ও দক্ষিণ এশিয়ার মালেশিয়াতে আসে বিংশ শতাব্দীতে। এখন এ ফলের বাণিজ্যিক চাষ হয় বেশ কয়েকটি দেশে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, চীন, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। ভিয়েতনাম এ সবথেকে বেশি বাণিজ্যিক ভাবে এ ফলের চাষ করা হলে ও বর্তমানে বাংলাদেশে ও কিন্তু বেশ সাড়া ফেলেছে এই ফলের বাণিজ্যিক চাষ।
বাংলাদেশ এ প্রথম এ ফল প্রবর্তন করা হয় ২০০৭ সালে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর জার্মপ্লাজম সেন্টারে৷ প্রফেসর ড. এম এ রহিম স্যার গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রথম কয়েকটি জাত আনেন থাইল্যান্ড থেকে৷ সেসব গাছগুলো দিব্যি ফল দিতে থাকে। জার্মপ্লাজম সেন্টারে বিভিন্ন পরীক্ষা নীরীক্ষার পর এ সেন্টার থেকে এর বিস্তার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া হয়। আর এখন তো ফলাফল আমাদের সামনে পতিত জমি থেকে শুরু করে ছাদ বাগান এবং বর্তমানে বাণিজ্যিক ফলন হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায়৷
বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করার জন্য বাউ ড্রাগন ফল ১ সাদা এবং বাউ ড্রাগন ফল ২ লাল এই দুইটি খুব বেশি উপযোগী। লাল ড্রাগন ফল কে বলা হয় পিটাইয়া। তাছাড়া ও হলুদ প্রজাতিও আমাদের দেশে ভালো ফলন হয়৷ হলুদ প্রজাতিকে কোস্টারিকা ও বলা হয়৷ এছাড়াও কালচে, গোলাপি আভার ড্রাগন চাষ করা হচ্ছে।।
পাতাবিহীন গাছ, ডাল পালা লম্বা হয়ে ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার লম্বা হয়৷ কি যে সুন্দর ফুল ফোটে এই গাছটিতে৷ অন্ধকার রাতে গাছে গাছে সাদা ফুল সত্যিই একদম নাইট কুইন এর মত দেখতে কিন্তু নাইট কুইন না। এ ফুলের ও নাম আছে “মুন ফ্লাওয়ার”। অনেকেই আবার ড্রাগন এর ফুল কে কুইন “অব দ্যা নাইট” ও বলে থাকেন।
বীজ থেকে ফল হলেও তা খুব সময় স্বাপেক্ষ, ফল আসে কম। অপরদিকে কান্ড থেকে চারা করলে দ্রুত ফলন আসে আর সুবিধা ও। তাইতো এ গাছের বীজ থেকে কান্ড কে ই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় পরবর্তী চারা করার ক্ষেত্রে৷ সাধারণত ১২ থেকে ১৮ মাস কিংবা তার আগে ই ফল দেয়া শুরু করে। তবে ২য় বছর থেকে অনেক বেশি ফল দেয়, এমনকি বছরে একটা গাছ থেকে ৬-৭ কেজির বেশি ফল আসে প্রথম বছরেই। গাছ ম্যাচুরড হলে একটা গাছে ই ৪০-৫০ কেজির মত ফল আসে। এবং যেহেতু দীর্ঘজীবী গাছ তাই বাঁচে ও ত্রিশ বছরের উপর।
পানি কম লাগে, পাহাড়ি মাটি এর জন্য উপযোগী,এর ই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় চাষ করা হয় এই ফলের এবং সাফল্যের মুখ দেখেন চাষীরা। টাঙ্গাইল এ মধুপুর, সখীপুর, ঘাটাইল এর পাহাড়ি এলাকায় অসাধারণ সাফল্য পেয়েছেন অনেক চাষীরা। সত্যি বলতে কৃষির উপর আমাদের ডিপেনডেন্সি সব সময় ই। আর এখন দিন বদলের সাথে উন্নতমানের চাষে জড়িয়ে যাচ্ছে শিক্ষিত উদ্যোক্তা রা যার ই ফলশ্রুতিতে ড্রাগন চাষে উদবুগ্ধ হচ্ছেন বেশিরভাগ ই শিক্ষিত সমাজ। সাফল্যের হার ও পাচ্ছেন অনেক বেশি।
প্রায় সারা বছর এর চাষ করা যায় তবে ফল পাওয়া যায় গরম কালে মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। এরপর কিছুদিন ফল দেয়া বন্ধ থাকে। অধিক বৃষ্টি এ ফলের জন্য ভালো না। তাই অবশ্যই ফলের জমিতে পানি যেন না জমে এভাবেই প্রিপেয়ার করতে হবে৷ একটা উপায় জেনে খুব ভালো লাগলো যে এই ড্রাগন ফল আর্টিফিশিয়াল উপায়ে চাইলে শীত সিজনে ও পাওয়া যেতে পারে, লাইটিং করে৷ কেননা এটা গরমের ফল এবং গরম এর তাপমাত্রাতে ই এর ভালো ফলন হয়৷ ছাদে চাষ করতে হলে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে কাটিং কান্ড লাগালে সুফল পাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ছাদে টব বা বালতি কিংবা ড্রাম এ ও ভালো ফলন পাওয়া যায়। জৈব সার এর প্রধান খাদ্য।
ড্রাগন ফল যে শুধু কেটে খায় তা না, খাওয়া হয় জ্যুস করে, ফ্রুট সালাদ হিসেবে কিংবা মিল্ক শেক করে, পাঁকা বা কাঁচা দুই অবস্থাতে ই। যাই খাওয়া হোক ফ্রিজ এ রেখে খেলে অনেক বেশি মজা। তবে হ্যা, বীচি চিবিয়ে না খেলে সহজে হজম হয়না।
ড্রাগন ফল খুব খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ এবং এর সুফল অনেক বেশি। যেমনঃ
◑এতে ক্যালরীর পরিমাণ খুব কম থাকায় তা ডায়বেটিস এবং হৃদরোগীরা খেতে পারছেন যা খুব উপকারী তাদের জন্য। নিয়মিত এই ফল মেন্যু তে থাকলে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে যা ডায়বেটিস দের জন্য খুব ফলপ্রসূ।
◑ডায়েট হিসেবে অত্যন্ত উপকারী একটি ফল এই ড্রাগন। তাইওয়ান এ ডাক্তাররা এ ফল কে ভাতের পরিবর্তে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
◑এতে প্রচুর ভিটামিন সি আছে।
◑আয়রন সমৃদ্ধএকটি ফল এই ড্রাগন। যার ফলে দেহের আয়রন এর ঘাটতি পুরণ হয়৷
◑কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
◑চুল পড়া ও কমে যায়।
◑রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এ ফল।
স্বাস্থ্য উপকারিতা ই বলি এবং বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ, দুই দিকে ই এই ফল অনেক লাভবান একটি ব্যাবসা।।
টাংগাইল এর কিছু এলাকার মাটি এবং আবহাওয়া এ ফলের অনুকূলে থাকায় প্রচুর পরিমাণে এ ফলের চাষ হচ্ছে।ঘাটাইল, মধুপুর, সখীপুর উপজেলার অনেক চাষীরা এ ফলের বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ শুরু করেছে। শুধু শুরু করেছে বললে ভুল, চাষীরা খুব খুশি এর চাষাবাদে এবং ফল পেয়ে।।।
যেহেতু টাংগাইল এর পাহাড়ি এলাকার মাটিগুলো কৃষির জন্য খুব ই সম্ভাবনাময় এবং এখানে ড্রাগন চাষে সফল অনেক চাষী, তাই দিন দিন এর প্রতি আগ্রহ অনেক বাড়ছে। ভীনদেশি বলতে কোন কথা নেই, একেবারেই নিজেদের দেশীয় ফলের মত একে আকড়ে ধরেছেন কৃষক রা। ঘাটাইল উপজেলাতে ই শত শত একর এর উপর জমিতে শুধুমাত্র ড্রাগন চাষ করা হচ্ছে।৷ সবাই খুব লাভবান হচ্ছে এবং প্রচুর ফলন আসছে এ এলাকায় তাই তারা খুব বেশি ইন্সপায়ার হচ্ছে।
ঘাটাইল এর চাম্বলতলা গ্রামে, কাজলা গ্রামে, করিমগঞ্জ গ্রাম, মুরাইদ গ্রাম, বাসাবাইদ গ্রাম, মধুপুরচালা ও রসুলপুর ইউনিয়ন এর চাপরী গ্রাম, বিভিন্ন জায়গায় ছোট বড় বিভিন্ন পরিসরে প্রচুর ড্রাগন এর চাষ হচ্ছে।
এক জমিতে প্রায় ৬-৭ ফুট পর পর ই একেক টা পিলার এ চারটা করে গাছ লাগানো যায়। এভাবে প্রতি বিঘা জমিতে ২০০ র বেশি গাছ লাগানো যায়। প্রতিটা গাছে এত ফল, এত দিন বাঁচে, একেবারেই কীটনাশক মুক্ত ই বলা চলে, জৈব সার যার প্রধান উপকরণ, ফলের প্রাইস ও তুলনামূলক ভাবে বেশি, সব মিলিয়ে যারা ই এ উদ্যোগ এর সাথে জড়িতে সবাই খুব আশাবাদী এবং ফল ও পাচ্ছেন আশানুরূপ ।।।
তাই এটাকে সবাই খুব সম্ভাবনাময় দেখছেন উদ্যোক্তারা। অনেকেই জমি লীজ নিয়ে শুরু করেছেন ড্রাগন ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ। ছোট বড়, একক ভাবে, দলগত ভাবে এই চাষ করছেন এই পাহাড়ি এলাকার অনেক উদ্যোক্তা রা, তবে তাদের গন্ডি মূলত অফলাইন এ।।।এমন ও হয়েছে অনেকেই চাকরীর পাশাপাশি কিংবা চাকরী ছেড়ে ও ড্রাগন চাষে চলে এসেছেন। কেননা কম পুঁজিতে অধিক লাভের মুখ দেখছেন এখানে উদ্যোক্তারা৷
টাংগাইল থেকে ইতিমধ্যেই ড্রাগন ফলের উদ্যোক্তা রয়েছে ই-কমার্স সেক্টর এ। তবে হ্যা শুধু একজন দুইজন না, চাইলে অনেক জন মিলে এই সম্ভাবনাকে ই-কমার্স এর সাথে জড়িত করা যেতে পারে কেননা ক্ষেত্রটি অনেক বড় এবং অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত এ ফল, তাছাড়া পুরোপুরি অর্গানিক কেননা এ ফলে পোকামাকড় এর অত্যাচার কম জন্য জৈব সার ই এর প্রধান খাদ্য।।। এখন শুধু প্রচার করার অপেক্ষা, অবশ্যই প্রচারের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দ্বারে দ্বারে পৌছে যেতে পারে এ ফল।
যেহেতু পাকা ফল বেশিদিন রাখা যায় না ফ্রিজিং ছাড়া এবং ডেলিভারিতে ফল পুরো প্যাকিং থাকে তাই ডেলিভারি টা অনেক বড় সমস্যা । তবে হ্যা পাকা ফল এর পূর্বমূহূর্তে তা ডেলিভারি হতে পারে। যেহেতু স্বাস্থ্যের জন্য খুব বেশি উপকারে ফল তাই এ ফলের প্রচারণায় সচেতনতা এড করলে তা ভীন্ন মাত্রা পাবে বলে আশা রাখি।
হতে পারে এলাকাভিত্তিক অনেক ই-কমার্স এর ক্ষেত্র এই ড্রাগন ফল নিয়ে। যেখানে বিভিন্ন এলাকায় কন্ডিশনের উপর ভিত্তি করে অর্ডার নেয়া যাবে এবং সময় নিয়ে তা তুলে দেয়া যাবে ক্রেতার হাতে তাহলে টাংগাইল থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে এটা বিভিন্ন শহরে৷ যারা হাতের নাগালে পায়না জন্য এ ফল খেতে পান না তারাও ই-কমার্স এর মাধ্যমে এই ফল কে নিজেদের খাবার মেন্যুতে যোগ করে নিতে পারবেন।
ইন শা আল্লাহ সম্ভাবনাময় এ খাত উঠে আসবে এবং নিজের জায়গা করে নিবে ই-কমার্স এ অনেক উদ্যোক্তার মাধ্যমে।