আমাদের দেশে কাউন নামটা এখনো খুব বেশি মানুষের পরিচিত নয়, বর্তমান প্রজন্মের কাছে তো এই নাম আরও বেশি অচেনা। অথচ এটি অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর শস্যদানা, যা এক সময় ময়মনসিংহ জেলায় প্রচুর পরিমাণে জন্মাত। কাউন প্রাচীনকাল থেকেই মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠির ক্ষুধা নিবারণে প্রধান খাদ্য উপাদান হিসেবে গণ্য ছিল। কাউন দানা সুস্বাদু হওয়ায় একে ভাতের মতো সেদ্ধ করে, তরকারি ছাড়াই তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যেত বলে দুর্ভিক্ষকালে এই শস্যই ছিল বহু মানুষের জীবন বাঁচাবার উপকরণ।
কাউনের অন্য বাংলা নামগুলো হচ্ছে কাঙ্গুই বা কাঙ্গু, কোরা, কান্তি, দানা ও শ্যামধাত। এটি কুইনোয়া এবং আরও অনেক নামে বিশ্বে পরিচিত। ইংরেজিতে একে বলা হয় ফক্সটেইল মিলেট (Foxtail Millet)। কাউন হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন দেশে চাষ হয়ে আসছে, এটি এক ধরনের শস্যবীজ। একে উচ্চারিত করা হয় “কীন-ওয়াহ” রূপে। ইতিহাস বলে যে, প্রায় ৫,০০০ বছর আগে ইনকারা এটির নাম কুইনোয়া দিয়েছিল কারণ তারা বিশ্বাস করত যে এগুলো তাদের ভাল স্বাস্থ্য এবং বহু বছরের দীর্ঘ জীবন দিতে পারে। একে পূত ও পবিত্র উদ্ভিদ হিসেবে জানত তারা।
যদিও কাউনকে চাল বলা যায় না, কিন্তু বিভিন্ন খাবার তৈরীতে এটা চালের বিকল্প হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ একে এক প্রকার চাল বলেই গণ্য করে থাকে। এক সময় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে কাউন শস্যের চাষ করা হত। প্রবীণদের সাথে কথা বললে জানা যায়, এক সময় এটি ময়মনসিংহের সর্বত্র পাওয়া যেতো । প্রতি গ্রামেই চাষ হতো কাউন ধানের । কিন্তু ধীরে ধীরে উন্নত জাতের ধান চাষ শুরু হলে আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে এর চাষ এবং চাহিদা। আর এটি দরিদ্রের খাবার উপাদান থেকে অবসর নিয়ে পৌঁছে যায় অভিজাত দের ডাইনিং এ। ততদিনে দরিদ্ররা হয়ত এই খাবারে ক্লান্ত, আর তাই কাউন এখন বিলুপ্তপ্রায় একটি খাদ্যশস্য। স্বল্প পরিমাণে যা উৎপাদন হয় সেগুলো বিলাসীদের সুস্বাদু খাবারের আইটেম হিসেবে যুক্ত হয়। মিষ্টান্ন পায়েস, ক্ষির ও ঝাল খাবার হিসাবে খিচুরি , পোলাও রান্নায় কাউন চাল এখন অভিজাতদের প্রিয় খাবার। সত্যি বলতে হলদে রং এর এই শস্য দানায় তৈরী খাবারের স্বাদ একবার যে পেয়েছে, সেই বার বার পেতে চেয়েছে, স্পেশালি কাউনের পায়েস তো অমৃত!
প্রায় সব ধরণের মাটিতেই কাউনের চাষ করা যায়। তবে পানি জমে না এরকম বেলে দো-আঁশ মাটিতে এর ফলন ভালো হয়। ময়মনসিংহসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ মাস (মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত কাউনের বীজ বপন করা যায় আর দক্ষিণাঞ্চলে সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে বীজ বপন করা হয়। কাউন হচ্ছে একটি খরা সহিষ্ণু ফসল। তবে রবি মৌসুমে খরা দেখা দিলে ১-২টি হালকা সেচের ব্যবস্থা করলে ফলন বেশি হয়। সেচের পানি যাতে জমে না থাকে সেজন্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয় জমিতে। প্রতি বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি থেকে প্রায় ৩৫০ কেজি কাউন পাওয়া যায়, এর জন্য মাত্র ১ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। আর এই পরিমাণ কাউন উৎপাদন করতে ৫০০০-৭০০০ টাকার বেশি খরচ হয় না।
কাউনের স্থানীয় জাত ছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘তিতাস’ নামের একটি জাত আছে। কাউনের এ জাতটি শিবনগর নামে ১৯৮০ সালে কুমিল্লা জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং দেশি-বিদেশি জাতের সাথে তুলনামূলক মূল্যায়নের পর ১৯৮৯ সালে তিতাস নামে অনুমোদন করা হয়। তিতাস জাত উচ্চ ফলনশীল, আগাম রোগ ও পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন। তিতাস জাতের গাছ মাঝারি লম্বা, পাতা সবুজ, কাণ্ড শক্ত । গাছ সহজে নুয়ে পড়ে না । শীষ বেশ লম্বা, মোটা এবং রেশমী। বীজ মাঝারি আকারের এবং ঘিয়ে রংয়ের । হাজার বীজের ওজন ২.৩-২.৫ গ্রাম । স্থানীয় জাতের চেয়ে ফলন প্রায় ৩০-৩৫% বেশী । জাতটি রবি মৌসুমে ১০৫-১১৫ দিনে এবং খরিফ মৌসুমে ৮৫-৯৫ দিনে পাকে । তিতাস জাতটি গোড়া পচা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন । রবি মৌসুমে তিতাসের ফলন হেক্টর প্রতি ২.০-২.৫ টন। খরিফ মৌসুমে এর ফলন একটু কম হয়। উন্নতজাতের এই কাউন বীজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ কৃষক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে কৃষকরা আবার কাউন চাষে আগ্রহী হত।
কোথাও তেমন কাউন চাষাবাদ চোখে পরে না বর্তমানে। কেউ কেউ শখের বশে ৫/১০ শতক জমিতে কাউন চাষ করেন। চরাঞ্চলের কৃষকরা এখন কাউনের পরিবর্তে ধান, গম, ভুট্টা, বাদাম ইত্যাদি চাষের দিকেই বেশি মনোযোগী। কারণ কাউনের সম্ভাবনা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। কৃষকরা কাউন বিক্রি করে উপযুক্ত দাম পায় না বলেই চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। অথচ কাউনের মতো সুস্বাদু একটি খাদ্য উপকরণের সঠিক প্রচার করে এর চাহিদা এবং দাম বাড়ানো সম্ভব ই-কমার্স সেক্টরের মাধ্যমে। কাউন চাষে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ে এবং কাউন গাছ থেকে জমির ভালো সার তৈরি হয়। স্বল্প পরিশ্রম ও অল্প খরচে কাউন চাষ করা যায়, চাষের ঝামেলাও কম। তাই কৃষকদের উন্নত কাউন বীজ সরবরাহ করে সঠিক দাম পাওয়ার আশ্বাস দিলে কাউন চাষ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
কাউনের উপকারিতাঃ
১০০ গ্রামে কাউনে ৩৫০ ক্যালরি, ১২ গ্রাম ময়েশ্চার, ১২ গ্রাম প্রোটিন, ৪ গ্রাম ফ্যাট, ৬৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৭ গ্রাম অশোধিত ফাইবার বা আঁশ বিদ্যমান। এছাড়াও ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি স্বাস্থ্যকর উপাদান বিদ্যমান কাউন বীজে।
এটি পুষ্টিতে সমৃদ্ধশালী একটি শস্য। দেহে শক্তি সঞ্চয় করে থাকে এবং আমাদের দৈন্দদিন কাজকে আরো সহজ করতে দারুন ভুমিকা পালন করে থাকে। ডায়েট হিসেবে কাউনের চালকে এখন সবচেয়ে কার্যকারি খাবার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
শিশুদের জন্য কাউন একটি শক্তিশালী সুপার খাদ্য এবং এটি তাদের সঠিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর যোগান দিয়ে থাকে। এর পর্যাপ্ত পুষ্টিগুনের জন্য শিশুদের আদর্শ খাদ্য হিসেবে বিবেচ্য।
মধ্য-বয়সী এবং বৃদ্ধ হয়ে গেলে মানুষের স্মৃতি শক্তি হারাতে থাকে, যাকে বলে অ্যালজেইমার। ভিটামিন-বি১ এই অ্যালজেইমার হ্রাস করে থাকে। কাউনের চালে থাকে ভিটামিন-বি১, যা স্মৃতি শক্তিকে ধরে রাখে এবং আসন্ন অ্যালজেইমার থেকে নিজেকে রক্ষা করে থাকে। তাই অ্যালজেইমার প্রতিরোধে ১০০ গ্রাম কাউন প্রতিদিনের ডায়েটে রাখা উচিত চিকিৎসকদের মতে।
কাউন পেশীর দুর্বলতা নিরাময় করে, হার্টের সমস্যা দূর করে, এতে থাকা আয়রন মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে।
কাউন একটি আঁশযুক্ত শস্যদানা। ফলে এটা খাবার হিসাবে খেলে ধীরে ধীরে হজম হতে থাকে। শর্করা রক্তের সাথে ধীরে ধীরে সঞ্চালিত হয়। ফলে রক্তে অতিরিক্ত কোন সুগার জমা থাকে না। ফলে শরীর থেকে বাড়তি সুগার বা চিনি নিঃসৃত হয়। এই কারনে ডায়াবেটিক রোগী কাউনের চাল ডায়েট হিসাবে গ্রহন করলে ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রনে থাকে।
দেহের সুগঠন, ক্ষয়পূরণ এবং পানিতে দ্রবনীয় ভিটামিন জাতীয় পদার্থ থাকার কারণে স্বাভাবিক চালের চেয়ে প্রায় ১৮ থেকে ২০ গুন শক্তি দিয়ে থাকে কাউন। ফলে দেহকে রাখে সতেজ এবং প্রানবন্ত। কাউন ত্বক ও চুলের সুরক্ষায়ও সাহায্য করে বলে গবেষনায় প্রমাণিত।
কাউন দিয়ে তৈরী বিভিন্ন খাবারের রেসিপি দেশ এবং অঞ্চলভেদে ভিন্ন, তবে সবই বেশ সুস্বাদু। সর্বোপরি শারীরিক বৃদ্ধি, কোলাজেনের উপস্থিতি বৃদ্ধিসহ, তরুন্য ধরে রাখতে শক্তি সরবরাহ করে থাকে কাউনের তৈরী খাবার। কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি সহ চিকিৎসায় কাউন চালের ব্যবহার অপরিসীম। এই কারনে একে “সুপারফুড” বলা হয়ে থাকে।
আরামদায়ক বালিশ তৈরীতে কাউনঃ
মজার ব্যাপার হলেও সত্যি যে, কাউন শুধু খাবার হিসেবেই নয়, আরামদায়ক ঘুমের অনষঙ্গ হিসেবেও বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়।
কাউনের বালিশ ব্যবহারে এর ছোট ছোট দানার ফলে মাথার ম্যাসাজ হয় ও রক্তচলাচল ভালো থাকে , মাথা ব্যথা, অবসাদ দূর করে , ঘাড় ও মেরুদণ্ডের অবস্থান ঠিক রাখে , বাতাস চলাচল করে ও ভালো ঘুম হয়।
এর বালিশ তৈরি করতে এক কেজির মতো কাউন ব্যবহার করতে হবে আর বালিশে দিতে হবে সুতি কাপড়ের আরামদায়ক কভার। মাঝে মাঝেই রোদে দিয়ে ব্যবহার করতে হবে স্বাস্থ্যকর কাউনের বালিশ, তবে ঘুমটাও হবে স্বাস্থ্যকর।
ময়মনসিংহে বিলুপ্তপ্রায় কাউন শস্য ফিরিয়ে আনতে ই-কমার্সের ভূমিকাঃ
প্রথমত বলে নেই, কাউন চরাঞ্চলে সবচেয়ে ভালো জন্মায়, আর ব্রক্ষ্মপুত্র নদী বিধৌত ময়মনসিংহে কাউন চাষের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। পূর্বে এই অঞ্চল এই শস্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হত, যা এখন বিলুপ্তপ্রায় কাউনের সম্ভাবনাগুলো মানুষ না জানার কারণে, কাউন এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ও প্রচারের অভাবে। তাই ই-কমার্স এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করতে পারে।
কন্টেন্টের মাধ্যমে মানুষকে জানাতে হবে কাউন একটা সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার যা চালের বিকল্প হিসেবে যে কোনো খাবার তৈরীতে ব্যবহার করা যায়, যেমন- ভাত, পোলাও, খিচুড়ি, পোলাও, পায়েস, ক্ষীর, আটা, বিস্কিট-কুকিজ, পিঠা ইত্যাদি দেশী বিদেশি এমন হাজার রকমের খাবার তৈরী করা যায়।
কাউনের বিভিন্ন রেসিপি তৈরী করে ই-কমার্সে কন্টেন্ট আর্টিকেলের মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। রেস্টুরেন্টগুলোতে কাউনে তৈরী বিভিন্ন আইটেম রিপ্রেজেন্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। শুধু কাউনের তৈরী খাবার নিয়ে ফুড এক্সিবিশন হতে পারে।
কাউন চাষ এবং বিপণনের উপর নির্ভর করে তৈরী হতে পারে নতুন ই-কমার্স উদ্যোক্তা, যারা কৃষকদেরকে কাউনের সম্ভাবনা জানিয়ে চাষে আগ্রহী করতে পারে এবং ন্যায্য দামে কৃষকদের থেকে কাউন সংগ্রহ করে সারাদেশে ই-কমার্সের মাধ্যমে সরবরাহ করতে পারে।
কাউনে তৈরী আটা, বিস্কিট ইত্যাদি বিভিন্ন শুকনো খাবার তৈরী করেও উদ্যোক্তারা সারাদেশে সহজে ডেলিভারি করতে পারে।
কাউন ডায়েটের জন্য সেরা খাবার হওয়ায় স্বাস্থ্য সচেতন মানুষরা সহজেই এটাকে গ্রহণ করবে যদি একে সঠিকভাবে প্রেজেন্ট করা যায়।
কাউনের বালিশ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ নতুন এবং ইনোভেটিব একটা পণ্য হিসেবে প্রেজেন্ট করা যেতে পারে, ই-কমার্স সেক্টরে যার ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরী করা সম্ভব।
এছাড়াও আমাদের দেশের চেয়ে বহিঃবিশ্বের অন্যান্য দেশে কাউনের চাহিদা বেশি থাকায়, এটা অন্যতম প্রধান রপ্তানীযোগ্য খাদ্যশস্য হতে পারে।
সর্বোপরি, কাউনের মতো সম্ভাবনাময় একটি খাদ্যশস্যকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতে কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকেই। ই-কমার্স সেক্টরের ব্যবহারে এর যত বেশি প্রচার আমরা করতে পারব, এই শস্য উৎপাদন এবং সমৃদ্ধির সম্ভাবনা তত বাড়বে।