আলু এমন একটা সবজি যা সব খাবার আইটেমের সাথেই যেন মিশে যায়। ইতিমধ্যে প্রথম লাইন পড়েই হয়ত আলু দিয়ে তৈরী অনেক পদের নাম আপনার মাথায় চলে এসেছে। আসলে বাঙালির দৈনিক খাবারের একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে এই আলু।
কারো হয়ত আলুর ভর্তা ছাড়া সকালের নাস্তাটাই জমে না! আবার কেউ দেশী ছোট আলু দিয়ে গরু বা মুরগীর মাংসের ঝোল বেশি ভালোবাসেন, অনেকে হয়ত আলু দিয়ে বড় মাছের ঝোল খাওয়ার কথা ভাবছেন।
আর যদি আপনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ হয়ে থাকেন তবে তো ছোট আলু দিয়ে মাছ বা গরুর মাংসের শুটকি ভুনার কথা শুনলে জীভে জল আসবেই ! আর রুটি, পরোটা বা লুচির সাথে আলুর দম বা আলুর ডাল হলে তো সকাল সন্ধ্যার নাস্তাটা একটু বেশিই তৃপ্ত করে!
এছাড়াও আরও হাজারটা পদের রান্না পাওয়া যাবে, আলু যেগুলোর স্বাদ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।
আর আমাদের দেশের খাঁটি দেশী আলুর স্বাদের কথা তো আর নতুন করে বলার নেই। বাজারে দেশী আলুর চাহিদা সব সময়ই বেশি বলে তাই দামটাও কিছু বেশিই গুনতে হয়। তারপরও খাবারে পরিতৃপ্তির জন্য দেশী আলুটাই বাজারে গিয়ে প্রথম চোখে পরে গৃহকর্তাদের।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর দেশের অন্যতম আলু উৎপাদনকারী এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের নানা প্রান্তে যাচ্ছে গৌরীপুরের আলু। এই অঞ্চলে উৎপন্ন দেশী ছোট আলুর রয়েছে অনেক জাত, তবে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে উৎপন্ন বিখ্যাত চল্লিশা আলু সারাদেশেই খুব বেশি জনপ্রিয়।
‘একই জমিতে অনেক চাষ- স্বল্প সময়ে অধিক লাভ’
এই শ্লোগানে কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় গৌরীপুরের কৃষকরা চল্লিশা জাতের আলু চাষ করে আসছে।
চল্লিশা আলুর বিশেষত্ব হচ্ছে, অন্যান্য জাতের আলু উৎপাদন করে ঘরে তুলে ৯০ দিন সময় লেগে গেলেও, চল্লিশা আলু মাত্র ৪০ দিনেই উত্তোলন করা যায়।
ডিসেম্বর ও জানুয়ারী মাসে যখন সবজির অভাব দেখা দেয় তখন ৪০দিনে উৎপাদিত চল্লিশা আলু এলাকার মানুষের সবজির ঘাটতি পুরন করে এবং সে সময় চাহিদা থাকায় বাজারে চল্লিশা আলু অনেক বেশি দামে বিক্রি করা যায়।
পুরোদমে মৌসুম শুরু হলে আলুর দর যখন নীচে নেমে যায় তারা তখন সেই আলু কম দামে বিক্রি না করে বীজের জন্য সংরক্ষন করে থাকেন। এক্ষেত্রে আলু বীজের পঁচনরোধ ও ইঁদুর বা পোকা-মাকড়ের আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য শুকনো এটেল মাটি গুড়া করে তার সাথে কাপ নামক কীট নাশক মিশিয়ে আলু বীজের উপর ছিটিয়ে দেয়া হয়ে থাকে।
আবাদ মৌসুম পুরোপুরি শুরু হওয়ার অনেক আগেই অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের ১ম সপ্তাহের মাঝেই এই এলাকার চাষীদের সংরক্ষিত আলু বীজ উপজেলার ১০ ইউনিয়নের কৃষকসহ মোহনগঞ্জ, পূর্বধলা, কেন্দুয়া. ঈশ্বরগঞ্জ, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলা থেকে আসা আলু চাষীরা কিনে নিয়ে যান।
জানা যায়, চল্লিশা আলুর ফলন বেশী হয়, অন্যান্য আলুর থেকে খেতে স্বাদ বেশি এবং সহজ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষন করা সম্ভব হয় বলে আলুচাষীরা এ জাত বেশী আবাদ করে থাকেন।
মৌসুমে চল্লিশা আলু চাষ করে প্রত্যেক আলু চাষীর ঘরে লাখ লাখ টাকা উঠে আসে, ঘরে ঘরে তখন থাকে উৎসবের আমেজ। পুরো গৌরীপুর জুড়ে শুধু এই আলু এবং আলুবীজ সারাদেশে সরবরাহ করেই কোটি কোটি টাকা আসে এই অঞ্চলের কৃষকদের মাধ্যমে।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সর্বাধিক উৎপন্ন হয়েছে গৌরীপুরের এই চল্লিশা জাতের আলু।
ই-কমার্সে চল্লিশা আলুর সম্ভাবনা
ছোট দেশী আলু সবার পছন্দ তালিকার শীর্ষে থাকলেও, বেশির ভাগ মানুষ আলুর নাম এবং জাতভেদে এর ভিন্নতা সম্পর্কে খুব বেশি অবগত নয়। চল্লিশা আলু যে তার নামের মতোই বিশেষ প্রজাতির দেশী আলু, এই ব্যাপারটাকে তুলে ধরা যায় ই-কমার্স ব্যবহারের মাধ্যমেই।
ই-কমার্স সেক্টর ব্যবহার করে চল্লিশা আলু নিয়ে কন্টেন্ট আর্টিকেল তৈরীর মাধ্যমে এ আলুকে সারাদেশে আরও বেশি জনপ্রিয় করা যায়।
আলু সবজী হলেও দ্রুত পচনশীল নয়, ৫-৬ মাস অনায়াসে ভালো থাকে সঠিক ভাবে সংরক্ষন করা হলে এবং খুব সহজেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া যায়। তাই চল্লিশা আলুকে কেন্দ্র করে কৃষি খাতে এ অঞ্চলে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা তৈরী হতে পারে, যাদের মাধ্যমে সারাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতে পারে চল্লিশা আলুর স্বাদ।
ই-কমার্স ব্যবহার করে যারা খাবার নিয়ে কাজ করছে, তারা চল্লিশা আলুর নানা পদ খাবার ম্যানুতে যুক্ত করতে পারেন। খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়ে এর আকর্ষনীয় উপস্থাপনার মাধ্যমে। রেস্টুরেন্টগুলোর ম্যানুতেও যুক্ত করতে পারে চল্লিশা আলুর তৈরী খাবার আইটেম। এভাবে অঞ্চলভিত্তিক একটা পন্যকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া যাবে দারুণ ভাবে।
যেহেতু আলু চিপস দেশ ও দেশের বাইরে সমান জনপ্রিয়, তাই চল্লিশা আলুর চিপস তৈরী করে, প্যাকেজিং করে উদ্যোক্তারা সারাদেশে পৌঁছে দিতে পারেন, এমনকি দেশের বাইরেও রপ্তানি করা যেতে পারে।
যেহেতু আলু বিশ্বের অন্যতম প্রধান ফসল এবং এদেশে আলু সর্বত্রই বিপুল পরিমাণে চাষ হয়ে থাকে, তাই প্রক্রিয়াজাত আলু বিদেশে রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। আলু একটি স্টার্চ প্রধান খাদ্য হওয়ায় ভাতের বিকল্প হিসেবে খাওয়া হয় পৃথিবীর অন্তত ৪০টি দেশে অন্যতম প্রধান খাদ্য।
তাই সরকারি বেসরকারি ওয়েবসাইট গুলোতে আমাদের অঞ্চলের এই বিশেষ জাতের চল্লিশা আলুর বিভিন্ন আকর্ষনীয় দেশি-বিদেশি রেসিপি ইংরেজিতে শেয়ার করলে, দেশের বাইরেও এর চাহিদা তৈরী করা সম্ভব খুব দ্রুত।
ই-কমার্সের মাধ্যমে এভাবেই দেশ ও বিশ্বে ছড়িয়ে যাক ময়মনসিংহের গৌরীপুরের চল্লিশা আলু, আর অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ হোক সমৃদ্ধ।