খেজুর মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য পবিত্র খাবার হিসেবে বিবেচ্য। খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত বলে, সারা বিশ্বেই রমজান মাস এলে ইফতারের মূল অনুষঙ্গ হিসেবে বহুগুন বেড়ে যায় খেজুরের চাহিদা। তবে ড্রাই ফ্রুট হিসেবে এর পুষ্টিগুন বিবেচনায় সারাবছর ধরেই খেজুরের কদর রয়েছে সব ধর্মের মানুষদের কাছেই এবং এ চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
প্রেক্ষাপটঃ
আমাদের দেশে মূলত জন্মায় বুনো বা জংলি খেজুর, যার ফল খাবার হিসেবে খুব জনপ্রিয় নয়। এদেশে খেজুর গাছ বনে জঙ্গলে জন্মায় প্রকৃতির খেয়ালে, যার রস ব্যবহৃত হয় খাবার হিসেবে। খেজুরের রসের চাহিদা তাই এদেশে প্রচুর, আর সেই রস থেকে তৈরী হয় গুড়পাটালি।
খেজুরের গুড় আর রসের চাহিদা মেটাতেই মূলত আমাদের দেশে এই জংলি জাতের খেজুর ক্ষুদ্র পরিসরে চাষ হয়ে থাকে। তবে শীতকালীন আমাদের দেশীয় এই খেজুর রস, গুড় গভীরভাবে মিশে আছে এদেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতির সাথে। এছাড়া খেজুর গাছের পাতা ব্যবহৃত হয় রকমারি হাত পাখা, ঝাড়ু, ঝুড়ি, থলে, ছিকা, পাটি, চাটাই ও নানা রকম খেলনা তৈরীতে।
তবে ফল হিসেবে খেজুরের চাহিদা মেটাতে হয় দেশে আরবি খেজুর আমদানী করার মাধ্যমে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশে খেজুর চাহিদা মেটাতে আমদানী করা হয়েছে ৫০ হাজার টন আরবি খেজুর। তবে এইবার করোনার কারণে চাহিদা হঠাৎ কমে যাওয়ায় এবং চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আমদানী করে ফেলায় অনেক টাকা লস গুনতে হয়েছে আমদানীকারকদের। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে এদেশে আসে আরবি খেজুর, যার সিংহভাগ আসে মিশর থেকে। দুবাই এবং সৌদি আরব থেকেও আসে প্রচুর খেজুর। এর মধ্যে সৌদি আরবের আজুয়া খেজুর সবচেয়ে দামী, এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি হলেও অধিক দামের কারণে সর্বসাধারণের সাধ্যের বাইরে। তবে পবিত্র এই আজুয়া খেজুর মহানবী (সঃ) মুজেযা ও সর্বাধিক প্রিয় বলে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, স্বাদে গন্ধেও এটা সর্বসেরা বলেই এর প্রতি মানুষের রয়েছে তীব্র আকর্ষন। তাই পবিত্র হজ্ব থেকে ফেরার পথে কেউ আজুয়া খেজুর না নিয়ে দেশে ফিরেন না।
কেমন হয়, যদি সৌদি আরবের আজুয়া সহ পবিত্র সব খেজুর এদেশের মাটিতে চাষ করে সারাবছরের খাবার চাহিদা মিটিয়ে আবার বিদেশে রপ্তানিও করার সুযোগ তৈরী করা যায়!
অবশ্যই এটা দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। আর মরুর দেশের খেজুর চাষের এই স্বপ্নটা প্রথম সাফল্যের সাথে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছিলেন ময়মনসিংহের ভালুকার আবদুল মোতালেব। বর্তমানে তার হাত ধরেই সারাদেশে সৌদি খেজুর চাষ বিস্তৃত হতে চলেছে।
ময়মনসিংহের ভালুকায় বাংলাদেশের প্রথম সৌদি খেজুর বাগান
ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার পাড়াগাঁও গ্রামের আবদুল মোতালেব বাংলাদেশে প্রথম সৌদি খেজুর চাষ করে এদেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
মোতালেব সৌদি আরবে ১৯৯৮-২০০০ সাল পর্যন্ত তিন বছর একটা খেজুর বাগানে কাজ করেছিলেন। সেখান থেকেই খেজুর চাষে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি এবং বিখ্যাত আজুয়া খেজুর বীজ এদেশে এনে চাষ করার পরিকল্পনা করেন।
২০০০ সালে তিনি ছুটিতে দেশে ফেরার সময় ৬ মাসের ৩৬০০ রিয়েল বেতনের বিনিময়ে সৌদির বিভিন্ন জাতের ৩৫ কেজি খেজুর বীজ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। সেই থেকে শুরু হয় তার বাংলাদেশের মাটিতে খেজুর চাষ নিয়ে গবেষনা আর পারিপার্শ্বিকতার সাথে লড়াই। এই লড়াইয়ে বিজেতা তিনিই। তার নিয়ে আসা সেই ৩৫ কেজি বীজ থেকে উৎপন্ন হয় ২শত ৭৫ টি চারা, আর সারাদেশকে বিস্মিত করে মাথা তুলে দাঁড়ায় মোতালেবের সৌদি খেজুরের বাগান। আজুয়া খেজুর ছাড়াও আমবাগ, বকরি খেজুর সহ আরও কয়েক জাতের সৌদি খেজুরের গাছ রয়েছে তার বাগানে। বর্তমানে মোতালেবের বাগানের হাজার হাজার চারা ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, সৌদি খেজুর চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনেক মানুষ।
এদেশে সৌদি খেজুর চাষ হতে পারে এটা যেন কল্পনাতীত ছিল সবার কাছে, যাকে সত্যি করে দেখিয়েছেন মোতালেব তার আত্মবিশ্বাস, চেষ্টা আর পরিশ্রমের বিনিময়ে।
প্রতিদিন মোতালেবের খেজুর বাগান দেখতে ভীড় করে অনেক মানুষ। কেউ আসে শুধু দেখার জন্য, কেউ নিতে আসে খেজুর, আবার কেউ হয়ত শখ করে নিয়ে যায় চারা। শুধু যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই আসে মানুষ তা নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও অনেকেই আসেন মোতালেবের খেজুর বাগানে, আর মরুর দেশের খেজুর দেখে বিস্মিত হয়ে আবেগ প্রকাশ করেন বলে জানান আবদুল মোতালেব।
মোতালেব জানান, ফল ধরা কোনো খেজুরের চারা গাছের দাম সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্তও হতে পারে! একটা গাছের দাম এতো বেশি কেন, এর বিশেষত্ব কি জানতে চাইলে তিনি জানান, এমনও হয় একটা ফলবতী খেজুর গাছ পাওয়া যায় কয়েকশ বীজ বোনার পর। যেহেতু পুরুষ খেজুর গাছ ফল দেয় না, তাই ফলবতী গাছের দাম অনেক বেশি। তাছাড়া প্রায় দুই’শ বছর পর্যন্ত ফল দেয় একটা খেজুর গাছ। এর দাম এতো বেশি হবে নাই বা কেন!
ই-কমার্স ও দেশের অর্থনীতিতে সৌদি খেজুরের সম্ভাবনা
মোতালেবের এই খেজুর বাগান শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলের জন্যই নয়, সারাদেশের জন্যই এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যেহেতু দেশে খেজুরের চাহিদা কখনো কমার সুযোগ নেই, বরং পুষ্টিকর ড্রাই ফ্রুট হিসেবে এর চাহিদা উর্ধবমুখী, তাই দেশে উৎপন্ন সৌদি খেজুর অর্থনীতির উন্নয়নে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে।
আর ই-কমার্সের ব্যবহার এই কৃষিপণ্যকে দ্রুত সমৃদ্ধি লাভে সাহায্য করতে পারে।
ই-কমার্সে লেখালেখি ও প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সৌদি খেজুর চাষে উদ্ভুদ্ধ করার পাশাপাশি, এর বাজারজাত, ব্যবহার ও পুষ্টিগুন সম্পর্কে জানিয়ে চাহিদা যেমন বাড়ানো সম্ভব, তেমনি নতুন উদ্যোক্তা তৈরীর সুযোগ সৃষ্টি করাও সম্ভব হবে।
সুবিধা হচ্ছে- কেউ খেজুর চাষে আগ্রহী হলে খেজুর চাষী মোতালেব তাকে মাটি তৈরী সহ চাষ পদ্ধতি বিষয়ক সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে সাহায্য করেন। তাই খেজুর চাষ নিয়ে সংশয় থাকে না কোনো।
কেউ খেজুর বাগান করে কৃষি উদ্যোক্তারা শুধু চারা বিক্রি করেও লাখ লাখ টাকা উপার্জন করতে পারে। এছাড়া শুকনো খেজুরের চাহিদা এখন সারাবছরই আছে। বর্তমানে মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা ড্রাই ফ্রুটসের চাহিদা বাড়িয়েছে।
অনেকে যে কোনো মিষ্টি খাবার আইটেমে স্বাদ বাড়াতে ড্রাই ফ্রুটস ব্যবহার করেন, যার অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। আবার এখন খেজুরের আচারও খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
খেজুরে রয়েছে ভিটামিন, আঁশ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও জিঙ্ক। খেজুর একজন সুস্থ মানুষের শরীরে আয়রনের চাহিদার প্রায় ১১ ভাগই পূরণ করে। খেজুরের পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে বলা হয় চারটি বা ৩০ গ্রাম পরিমাণ খেজুরে আছে ৯০ ক্যালোরি, এক গ্রাম প্রোটিন, ১৩ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম, ২.৮ গ্রাম ফাইবার এবং আরও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান।
খেজুর শক্তির একটি ভালো উৎস। তাই খেজুর খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের ক্লান্তিভাব দূর হয়। আছে প্রচুর ভিটামিন বি, যা ভিটামিন বিসিক্স মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। অন্তত দুটি খেজুর প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি মেলে বলে বিশেষজ্ঞ রা বলে থাকেন। এছাড়াও খেজুরের রয়েছে হাজারো উপকারিতা, যা ছড়িয়ে দিতে হবে ই-কমার্স এর ব্যবহারে।
ই-কমার্সে কাজ করেন অনেকে বেবি ফুড নিয়ে। আর বাচ্চাদের খাবারে চিনির বদলে খেজুরের গুড়ো মিশিয়ে দিয়ে খাবার তৈরী করলে যেমন সাদাচিনির ক্ষতিকর দিক থেকে বাচ্চাদের মুক্ত রাখা যায়, তেমনি শরীরের পুষ্টিচাহিদাও পূরণ করা যায়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও চিনির বিকল্প হতে পারে খেজুরের গুড়ো।
খেজুর গাছের পাতা কে কেন্দ্র করে আবার গড়ে উঠতে পারে কুটির শিল্প! রাসুল (স) খেজুর পাতার চাটাই এ নামাজ পড়তেন। আমাদের দেশেও খেজুর পাতা দিয়ে পাটি, চাটাই, পাখা ইত্যাদি বিভিন্ন সৌখিন জিনিস তৈরীর প্রচলন রয়েছে।
এই শিল্পকে আধুনিকীকরণ সম্ভব। খেজুর পাতা দিয়ে বিভিন্ন ঘর সাজানোর শৈল্পিক জিনিস তৈরী করে সেগুলোকে ই-কমার্সের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে সারাদেশে। এমনকি দেশের বাইরেও রপ্তানীর সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে।
খেজুরের অন্যতম সুবিধা, এটি সহজে পচনশীল দ্রব্য নয়, নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় নেই। তাই ডেলিভারি জনিত সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে, খুব সহজে ই-কমার্স ব্যবহারে সারাদেশে পৌঁছে দেয়া যাবে একে।
আমাদের দেশের সরকার, কৃষি মন্ত্রনালয় এবং অভিজ্ঞ খেজুর চাষী আবদুল মোতালেবের সহযোগিতায় বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে আরবি খেজুরের অন্যতম তীর্থস্থান। দেশে খেজুরের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও খেজুর ও এ থেকে তৈরী বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানী করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। আর ই-কমার্স অবশ্যই এই কৃষি সম্ভাবনাকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারবে।