গুড়ের কথা আসার সাথে সাথেই মনে পরে যায় ছোট্ট বেলার সকালবেলা একটুকরো আখের গুড় ও একবাটি মুড়ি খেয়ে পড়তে বসার কথা। আখের গুড় একসময় মানুষের ঘরে সারাবছর থাকতো। কারন সারাবছর পিঠাপুলি, সন্দেশ পায়েস কত কি তৈরি হতো। কিন্তু এখন অনেকের ঘরে দিন যায়, বছর যায় খাঁটি গুড় পায়না বলে অনেকে সংরক্ষণ করতেও চেষ্টা করে না।
আঁখ থেকে গুড়,লুচা ও চিনি হয়, তবে এটি বাঁশ বা ঘাসের এক ধরনের জাত।গুড় ও চিনি তৈরির জন্যই মূলত আখের চাষ করা হয়।আমাদের দেশেও বিভিন্ন জেলায় আখ চাষ হতো প্রচুর পরিমানে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে আখের চাষাবাদ কমছে।আমাদের দেশে সরকারী ১৫ টি চিনির কল আছে। তারপরও আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রচুর পরিমানে চিনি আমদানি করতে হয়।বাংলাদেশ চিনি আমদানিতে বিশ্বের ৪র্থ দেশ হিসেবে পরিচিত।
আমাদের দেশের প্রতিটা ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে পরিচিত চিনি।কিন্তু একযুগ আগেও আমাদের দেশে আখের গুড়ের পরিচিতি ও চাহিদা যেমন ছিলো এখন তেমন একটা দেখা যায় না। আমাদের দেশে পাটের পরেই অর্থকারী ফসল হিসেবে আখের অবস্থান।
আখের রস থেকে তৈরি করা গুড় মানব দেহের জন্য খুব উপকারী।সারাবছর শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে আখের গুড়ের উপকারীতা অনেক, আবার এটি মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।এছাড়া পিঠা,পায়েশ ও অন্যান্য মিষ্টান্ন তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় আখের গুড়। আখের রস থেকে যে চিনি উৎপাদন করা হয় তা শরীরের জন্য ভালো। কারন প্রতিদিন মানব দেহের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ চিনির প্রয়োজন হয়।
আখের গুড় ও চিনির চাহিদা অনেক বেশী থাকায় এটি একটি সম্ভাবনা ময় খাত।আমাদের ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায়ও একসময় প্রচুর পরিমানে আখ চাষ করা হলো, কিন্তু বর্তমানে আখ চাষের জমির পরিমান কমছে। ময়মনসিংহের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে আখের গুড় ও চিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় একসময় প্রধান কৃষিকাজ ছিলো আখচাষ। এ অঞ্চলে একসময় ধান চাষের চেয়ে বেশী চাষ করা হতো আখ। এখনো নান্দাইলের ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদ হিসেবে আখ চাষ পরিচিত। এখানকার কৃষকরা আখ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই নিজেদের ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদকে ধরে রাখার জন্য হলেও আখ চাষ করছেন।এই অঞ্চলে আখ চাষের উপযোগী জমি রয়েছে তাই সম্ভাবনাময় পণ্য হিসেবে আখের ও চিনি উৎপাদনে এগিয়ে আসতে পারে কিছু কৃষক ও উদ্যোক্তা। যারা ই-কমার্সের মাধ্যমে প্রচার করতে পারে এই সম্ভাবনাময় পণ্যকে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা লালচিনির জন্য বিখ্যাত। লাল চিনি তৈরি হয় আখ থেকে। ফুলবাড়িয়ার ব্যান্ডিং পণ্য হিসেবে পরিচিতি থাকলেও সাদা ক্যামিক্যাল যুক্ত চিনির দাপটে হাতে তৈরি লালচিনির চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে।কিন্তু ই-কমার্সের মাধ্যমে প্রচারের ফলেই এই অঞ্চলের লাল চিনির চাহিদা বাড়তে পারে। চাহিদা কমে যাওয়ার কারনে এখন কৃষকরা হাতে চিনি তৈরিতে খুব একটা আগ্রহী হয় না।যদি শিক্ষিত উদ্যোগক্তা ও এই এলাকার কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করে তাহলে দেশ সহ সারাবিশ্বে এই এলাকার চিনিকে পরিচিত করা ও চাহিদা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
গফরগাঁও উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী এলাকায় যতদূর পর্যন্ত দেখা যেতো শুধু আখের জমি দেখা যেতো।যেহেতু আখ চাষের জন্য বেলে দোঁয়াশ মাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তাই এই অঞ্চল ছিলো একসময় আখের রাজ্য আর আখ তৈরির সময় নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলো আখের মিষ্টি ঘ্রাণে মম হয়ে থাকতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়েই গিয়েছে এই অঞ্চলগুলোর আখ চাষ।তবে সম্ভাবনাময় আখ চাষকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এই অঞ্চলের ইয়ং জেনারেশন ও কৃষকরা। ইয়ং ও শিক্ষিত উদ্যোক্তারা ডেডিকেটেড ভাবে চেষ্টা করলে আখ চাষ ও আখের গুড়,লুচা,চিনি সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।গফরগাঁওয়ের দওেরবাজার,লামকাইন,চরশাখচূরা,এলাক সহ চরাঞ্চল গুলোতে একসময় প্রচুর আখ চাষ হতো।
ভালুকা উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামের আখের চাষ হয়, এরমধ্যে পালগাঁও,বড়চালা,কাচিনা,তামাট,হবিরবাড়ী,চানপুর, নয়নপুর সহ আরো কয়েকটি গ্রামে আখ চাষ হয় হয় প্রতিবছর।এসব এলাকার কৃষকরা প্রতিবছর এক থেকে দেড় লাখ টাকারও আখ বিক্রি করেন। ভালুকা এসব গ্রামে আখ চাষ করেন হরিদাস মন্ডল,আব্দুর রহমান,মোফাজ্জল হোসেন,দুলাল সহ আরো অমেকেই। দুলাল গুড়ও তৈরি করেন এবং তার মতামত হলো ভালুকার মাটির গুনাগুন ভালো হওয়ায় এখানকার আখ থেকে তৈরি গুড়ও খুব মিষ্টি হয়।
তবে এসব এলাকার কৃষকরা কেউ কেউ গুড় তৈরি করেন আবার কেউ কেউ আখ পাইকারি বিক্রি করে দেন। ভালুকার মাটির অম্লতা বেশী বলে এখানকার আখের চাহিদা অনেক বেশী আবার আখ বা গুড় মিষ্টি বেশী হয়।
ময়মনসিংহের ত্রিশালের কয়েকটি গ্রামেও আখ চাষ করা হয়। আর সেসব আখ ঢাকা সহ সারাদেশে পাইকারি সেল হয়ে যায়।
আখ চাষের জন্য ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষি জমি অনেক বেশী উপযোগী।তবে কিটনাশক,সারের মূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ন্যায় মূল্য না পাওয়া, গুড় তৈরি অনেকটা সময় সাপেক্ষ হওয়ায় কৃষকরা দিন দিন আখ চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের একটি অর্থকারী ফসল হিসেবে পরিচিত আখ, অথচ বিশ্বের টপটেন আখ চাষকারী দেশের মতো আমাদের দেশে আখের চাষ হচ্ছে না।দুই তিন যুগ আগেও এই আমাদের দেশে অনেক বেশী আখের চাষ হলো এবং গুড় ও লাল চিনি তৈরি করা হতো। কিন্তু এখন চাহিদা বাড়ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে শুধু বাড়ছে না আখের চাষ। ফলে প্রতিবছর দেশের মানুষের চাহিদা পূরন করার জন্য চিনি আমদানি করতে হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশী আখ চাষ হয় ব্রাজিল,চিন, থাইল্যান্ড, চিন, ভারত ও পাকিস্তানে।
আমাদের ময়মনসিংহের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা ডেডিকেটেড ভাবে উদ্যোগ শুরু করলে আখ চাষে যেমন কৃষকরা আগ্রহী হবে তেমনি সরকারি বেসরকারি পর্যায় থেকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে বিশাল সম্ভাবনা ময় এই পণ্য দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে,ফলে কৃষি উদ্যোক্তারা আখ চাষের মাধ্যমে এদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে ।প্রয়োজন শুধু দক্ষ উদ্যোক্তা তৈরি, যারা অডিও কনটেন্ট, ভিডিও কনটেন্ট ও কনটেন্ট রাইটিং এর মাধ্যমে প্রচার ও প্রসার করতে পারবে সম্ভাবনাময় এই পণ্যকে।ময়মনসিংহের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে অর্থকারী ফসল আখ।