ড্রাগন- এটি ডিজনি ওয়ার্ল্ডের ফ্যান্টাসি মুভি থেকে নেমে আসা কোনো কাল্পনিক ড্রাগন নয়; এটি বেশ জনপ্রিয় ও সুস্বাদু একটি ফলের নাম। ড্রাগন ফ্রুট সাধারণত বিদেশী ফল বলে পরিচিত হলেও, এদেশের মাটিতে এটি বেশ ভালোই খাপ খাইয়ে নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি ময়মনসিংহের কয়েকটি উপজেলায়ও ড্রাগন ফ্রুট বেশ সাড়া ফেলেছে। সাধারণ কৃষক এবং অনেক সৌখিন উদ্যোক্তারাও এই ফল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
ড্রাগন ফলের উৎপত্তিস্থল সেন্ট্রাল আমেরিকা। আমাদের দেশে এর প্রথম আগমন ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে। কৃষি গবেষনা উদ্যোগে এ ফলটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বংশ বিস্তার করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত গবেষণার মাধ্যমে আমাদের দেশে ড্রাগন ফলের ৫টি জাত বাউ ড্রাগন ফল-১; বাউ ড্রাগন ফল-২; বাউ ড্রাগন ফল-৩ ও বাউ ড্রাগন ফল-৪ এবং বারি ড্রাগন ফল -১ সম্প্রসারণ এবং চাষাবাদ করা হচ্ছে।
এই ফলের গাছ দেখতে একদম ক্যাকটাসের মতো। গাছ ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার লম্বা হয়। অনেকে গাছ দেখে তাই একে চির সবুজ ক্যাকটাস বলে ভুল করেন। এই ফলের খোসা নরম, কাটলে ভিতরটা দেখতে লাল বা সাদা রঙের হয়ে থাকে। ফলের মধ্যে কালজিরার মতো ছোট ছোট নরম বীজ আছে। নরম শাঁস ও মিষ্ট গন্ধ যুক্ত গোলাপি বর্ণের এই ফল খেতে সুস্বাদু।
ড্রাগন ফ্রুট রেড পিটায়া, স্ট্রবেরি পিয়ার, কনডেরেলা প্ল্যান্ট ইত্যাদি নামেও পরিচিত। পাকা ফল না ধুয়ে পাঁচ দিন পর্যন্ত ফ্রিজে ভালো রাখা যায়।
চার রকমের ড্রাগন ফলই বেশি দেখা যায়— লাল বাকল, লাল শাঁস; হলুদ বাকল, সাদা শাঁস; লাল বাকল, সাদা শাঁস; লাল বাকল ও নীলচে লাল শাঁস।
রঙের ভিন্নতা অনুযায়ী স্বাদের ক্ষেত্রেও তারতম্য লক্ষ করা যায়। শাঁসের ভেতর ছোট ছোট অজস্র কালো বীজ থাকে। এর ফুল লম্বাটে সাদা এবং অনেকটা নাইট কুইনের মতো দেখতে।
ময়মনসিংহে ড্রাগন ফ্রুট চাষ
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের দত্তগ্রামে ড্রাগন ফল চাষ করছেন কৃষক জিয়াউর রহমান। বিটিভিতে মাটি ও মানুষের অনুষ্ঠানে ড্রাগন চাষের প্রতিবেদন দেখে তিনি প্রথম এই ফল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
২০১৯ সালে ময়মনসিংহ জার্ম প্লাজম সেন্টার থেকে চারা সংগ্রহ করে ২৮ শতক জমিতে ১শ ৬০টি মাদায় পিলার স্থাপন করেন এবং প্রতি পিলারে ৪টি করে ড্রাগন ফলের চারা রোপন করেন। চাষকৃত জায়গায় বাগান করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৫লক্ষ টাকা। আর রোপনের ১ বছর পর গত মে মাস থেকে গাছে ফুল ও ফল ধরতে শুরু করেছিল।
লাল ও সাদা দুধরনের ড্রাগন ফল রয়েছে বাগানে। প্রতিটি ড্রাগন গাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ কেজি ফল পাওয়া যায়। ভালো ফলন হলে বাগান থেকে বছরে ১০ লক্ষ টাকারও বেশি ফল বিক্রি করা সম্ভব। ফল বিক্রির পাশাপাশি বাগানে তিন হাজার চারা উৎপাদন করেছেন তিনি। স্থানীয় বাজারে চারারও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
উপজেলায় একমাত্র ড্রাগন বাগান হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার মানুষ ড্রাগন গাছ ও ফল দেখার জন্য বাগানে ভীড় করে। জিয়াউর রহমানের বাগান দেখে এলাকার অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক ড্রাগন চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তার ড্রাগন বাগানই যেন এখন এলাকার মানুষের আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু, অনেকে দূর থেকেও আসেন বাগান দেখতে।
ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। উপজেলার মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের মোখলেছুর রহমান খান ও তার ভাতিজা মুরাদ খান দীর্ঘদিন ধরে ড্রাগন ফল চাষ করছেন।
নিজ বাড়ির সামনে ৪০ শতাংশ জমির ওপর ১ হাজার ৫৬টি ড্রাগন চারা রোপণ করার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল তাদের ড্রাগন চাষ। চার ইঞ্চি স্কয়ার ছয় ফুটের কংক্রিট-সিমেন্টের পিলারের চারদিক ঘিরে চারটি করে চারা রোপণ করে ২৫৬টি পিলারের মাধ্যমে এর বাগান তৈরি করা হয়েছে।
দীর্ঘদিনের টেকসই মাচা হিসেবে বাঁশের পরিবর্তে গাড়ির পুরোনো টায়ার ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে তাদের শুরুটা শখের বশে হলেও পরবর্তীতে এর বানিজ্যিক সম্ভাবনা দেখে চাষের পরিধি বৃদ্ধি করেন। তাদের দেখে আরও অনেকে এখন ড্রাগন চাষে আগ্রহী হচ্ছে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স গড়ে তুলেছেন “কিষাণ সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ” নামের একটি কৃষি খামার যেখানে বিভিন্ন দেশী বিদেশী ফলের ভীড়ে জায়গা পেয়েছে ড্রাগন ফল। তার এই ড্রাগন বাগানে তিন প্রজাতির পাঁচ হাজার গাছ আছে।
আশপাশের অনেক জায়গা থেকে ফলগাছপ্রেমীরা আসেন নয়নাভিরাম এই বাগানটি দেখতে। মুগ্ধ হন বিষমুক্ত ফলের এই বিশাল বাগান দেখে। শখের বাগানটি এখন বাণিজ্যিক একটি বাগানে পরিণত হয়েছে, যা থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা উপার্জন হচ্ছে।
ড্রাগন বাগান করা অনেক বেশি ব্যায়বহুল হলেও এর অন্যতম সুবিধা হল-
একবার বাগান গড়ে তুলতে পারলে ২০ বছর থেকে ৩৫ বছর পর্যন্তও টানা ফলন পাওয়া যায়। আর ড্রাগন ফলের গাছ অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও টিকে থাকতে পারে, রোগবালাইও কম হয়। তাই বেশ লাভজনক।
চারা রোপণের দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যেই গাছে ফল দেখা দেয়। বছরে একবার ফলন হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি গাছে ফুল দেখা দেয়। তবে সেই ফুল রাতে ফুটে আবার বৃষ্টি হলে নষ্ট হয়ে যায়। তাই সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়।
জুলাই-আগস্ট মাস হচ্ছে ফল মৌসুম। প্রতি মৌসুমে প্রতিটি গাছে ২০ থেকে ৩০টি ফল দেয়। প্রতি পিলারের চারটি গাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ কেজি ফল সংগ্রহ করেন। এই ড্রাগন ফল অনেকটা বিল-ঝিলের শাপলার ভেটের মতো হয়। তবে অনেকটা লাল রঙের। এর ফল খুব সুস্বাদু, তবে ওষুধি গুণও রয়েছে।
বাজারে এর ভালো দাম রয়েছে। প্রতি কেজি ড্রাগন ফল ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। চারা উৎপাদন ও ফল রফতানির বিষয়ে মুরাদ খান বলেন, গাছের কা- থেকেই এর চারা সহজেই রোপণ করা যায়। বিদেশে এই ফলের বেশ চাহিদা আছে। বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি এই ফল বিদেশে বিক্রি হয়।
ড্রাগন ফ্রুটের উপকারিতা
ড্রাগন ক্যাকটাস প্রজাতির ফল। ডিম্বাকৃতির উজ্জ্বল গোলাপি রঙের ড্রাগন ফলের দাম বেশি হলেও এর স্বাস্থ্য উপকারিতা চমকে ওঠার মতো।
ড্রাগন ফলে ৬০ ক্যালরি এবং প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন সি, ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৯ থাকে। এই ফলে বিটা ক্যারোটিন ও লাইকোপিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টও রয়েছে। বিটা ক্যারোটিন শরীরে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়ে ত্বক, চোখ ও ইমিউনিটি সিস্টেমের উন্নতি করে।
ড্রাগন ফ্রুট অন্ত্রের বর্জ্য দূরীকরণে সহায়তা করে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
ড্রাগন ফলের বীজে হার্টের জন্য উপকারী ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৯ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। নিউ ইয়র্কের পুষ্টিবিদ ও দ্য স্মল চেঞ্জ ডায়েটের লেখক কেরি গানস বলেন, ‘ড্রাগন ফলের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে,তাই এটি খেলে হার্টের রোগের ঝুঁকি ও জয়েন্টের ব্যথা কমে যায়।
ড্রাগন ফলে ম্যাগনেসিয়াম বেশি থাকে। এটা হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে ও অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করে।
উচ্চ পরিমাণে আয়রন পাওয়া যায় এমন সব ফলের একটি হলো ড্রাগন। ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ১.৯ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে, যা দৈনিক সুপারিশকৃত মাত্রার ১০ শতাংশেরও বেশি। হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের জন্য আয়রন প্রয়োজন, যা শরীরের টিস্যুতে অক্সিজেন পৌঁছাতে লোহিত রক্তকণিকাকে সাহায্য করে। বেশির ভাগ নারীদের শরীরেও আয়রনের ঘাটতি দেখা যায়, তাই নিয়মিত ড্রাগন ফল খাওয়া নারীদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন।
এছাড়াও শরীরের ভিটামিন সি এর অভাব পূরণ করে এবং চুল পরা কমাতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে ড্রাগন ফল।
লাল রং এর এই ড্রাগন ফলের রস বিভিন্ন খাবারে ফুড কালার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
ড্রাগন ফ্রুটের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে, তাই বাড়ছে সম্ভাবনা। ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক পরিসরে এই ফলের চাষ হওয়ায়, একে ঘিরে কৃষি পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রী সম্প্রসারিত হতে পারে।
সারাদেশেই এই ফলের চাহিদা রয়েছে, তবে এখনো অনেক মানুষেরই এই ফল সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা নেই। তাই ড্রাগন ফলের প্রচার বাড়াতে হবে, যেহেতু এদেশের মাটি এটি চাষে পুরোপুরি উপযোগী, তাই একে সাধারণ দেশীয় ফল হিসেবেই মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কন্টেন্ট আর্টিকেল লেখার মাধ্যমে এর পুষ্টিগুন সম্পর্কেও সবাইকে সচেতন করতে হবে।
এভাবে এই কৃষিপন্যকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হলে শুধু দেশেই না, দেশের বাইরে ড্রাগন ফ্রুট রপ্তানি করেও এ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
আর বর্তমানে বিশাল পরিসরে ড্রাগন বাগান করা ব্যয়বহুল বলে সবার জন্য সম্ভব না হলেও, অনেকে শখ করে বাসার ছাদে ড্রাগন ফল চাষ করছেন। তাই ড্রাগন চারার চাহিদা অনেক বাড়ছে।
ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির কৃষিখাতে একে ঘিরে তাই উদ্যোক্তা তৈরী হতে পারে ময়মনসিংহ অঞ্চলে, যারা ড্রাগন ফল সরাসরি চাষ করে ফল এবং চারা উভয়ই সরবরাহ করে লাভবান হতে পারে। আবার যে সব বাগান আছে, সেগুলো থেকে ফল সংগ্রহ করেও পৌঁছে দিতে পারে মানুষের দোরগোড়ায় আর গোচাতে পারে বেকারত্ব।