সূর্যমুখী, নামটার মাঝেই মিশে আছে একটা রহস্য যে সূর্যের সাথেই আবর্তিত হয়। সাইন্টিফিক গবেষণাও তাই বলে৷ সূর্য যেদিকে থাকে এই ফুল ও সেদিকেই থাকে, এমনকি সূর্য যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তখন তারাও পশ্চিমে ঝুকে পরে এবং সারারাত ধরে সার্কুলেশন হয়ে আবারো পূর্ব দিকে ফিরে থাকে সূর্যের অপেক্ষায়। একদম বয়স শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত এই চক্র চলতেই থাকে। এর পিছনের রহস্য জানতে অনেকেই আগ্রহী। বিজ্ঞানীরা এই রহস্যের উদঘাটন করেছেন এবং এই চক্রকে তারা সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ঘড়ির সাথে তুলনা করেছেন, যার আরেকটি নাম দেহঘড়ি। এটা এমন একটি চক্র যা মানুষের মাঝেও বিদ্যমান, কেননা যখন আমরা মানুষেরা একটি নির্দিষ্ট রুটিন ফলো করি বা একটা নির্দিষ্ট টাইম এ ঘুমাই, বাসার ঘড়িটা নষ্ট হলেও কিন্তু আমাদের এই একই সময়ে ঘুম পায়৷ সূর্যমুখীর ব্যাপারটা ও তেমনি। খুব সীমিত সংখ্যক উদ্ভিদ এর মাঝে এই চক্র উপস্থিত, যার মাঝে একটি হলো সূর্যমুখী।
বাংলাদেশে রান্নায় ছয় ধরণের ভোজ্যতেল ব্যবহার করা হয়৷ চার দশক আগের আমাদের দেশে সরিষা প্রধান ব্যবহৃত ভোজ্যতেল হলেও দাম, সহজলোভ্যতা সব মিলিয়ে নব্বই এর দশক থেকে সরিষার তেল এর জায়গা করে নেয় সয়াবিন ও পামতেল। এর মাঝে সবথেকে বেশি ব্যবহার করা হয় পামতেল, প্রায় ৫২ শতাংশ। এর পরের অবস্থানেই আছে সয়াবিন তেল ৩৮ শতাংশ৷ সরিষার তেল এবং ধানের কুঁড়ার তেল মিলে ৯ শতাংশ। পঞ্চম অবস্থান দখল করে আছে সূর্যমুখীর তেল৷ পারসেনটেজ এর পরিমাণে খুব কম হলেও সূর্যমুখীর ব্যবহার দিন দিন বেড়ে ই চলছে৷
সেই ফুল চাষ হচ্ছে এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, আমাদের টাংগাইল এ। টাংগাইল এর মাটি কৃষিতে ভরপুর। এ মাটি তে অন্যান্য ফসল যেমন খুব ভালো ফলন হয়, তেমনি সূর্যমুখী। তাইতো এ জেলার ১২ টি উপজেলাতে ই সূর্যমুখী চাষে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে নেয়া হয়েছে উদ্যোগ।।৷ চাষীরা ও খুব খুশি এর চাষাবাদে এবং পর্যাপ্ত সুফল পেয়ে।।
টাংগাইল এর মির্জাপুর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়ন এর ত্রিমোহন এলাকায় বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে সূর্যমুখীর চাষ হচ্ছে। এখানে চাষী রা ভীষণ আশাবাদি। সাধারণত মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর এ বীজ বপন করলে এর ফলন ভালো হয়। বারি সূর্যমুখী ২ (উপসী জাত) বীজ নরমালি এ এলাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে যার ফলন মাত্রা অত্যধিক।। খরচ কম এবং লাভজনক জন্য চাষীরা খুব আগ্রহ প্রকাশ করছে সূর্যমুখীর চাষে।
মির্জাপুর সদর থেকে ২ কি.মি. দূরে সবার পরিচিত বংশাই ব্রীজ এর উত্তর পাশে তরফপুর পাথরঘাটা সড়ক ঘেঁষেও য়য়েছে আরেকটি সূর্যমুখীর বাগান। পুরো উপজেলার ৫ বিঘার ও বেশি জায়গা জুড়ে করা হয়েছে সূর্যমুখীর চাষ।
এছাড়া ও টাংগাইল এর নাগরপুর যা মধ্যচর হিসেবে বিবেচিত, এখানে ধলেশ্বরী র পলল সমতল মাঠঘাটে চাষ হচ্ছে অনেক বড় পরিসরে সূর্যমুখী৷ এখানে উপেন্দ্র সরোবর, যা প্রাচীণ ঐতিহ্যের একটি নদর্শন এর পাশে বিস্তীর্ণ জমি জুড়ে সূর্যমুখীর ক্ষেত একদম দেখার মত একটি জায়গা হয়েছে, যেখানে উপচে পরে মানুষের ভীড় ও।
সখীপুর এর কচুয়া গ্রাম এ ও চাষ হয়েছে এই সূর্যমুখীর। এখানে একজন গৃহবধূ হাসিনা বেগম চাষ করেছেন এক বিঘা জমিতে সূর্যমুখী, এই বীজ তাকে সরবরাহ করেছিলেন এলাকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ফলন ই খুব ই ভালো।
টাঙ্গাইল এর দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি, স্বল্পলাড়ুগ্রাম, ভবানিপুর, এলাসিন, প্রতিটি গ্রামেই চাষ হচ্ছে সূর্যমুখীর, এখানেও কৃষকরা পেয়েছে সরকারি সহযোগীতা এবং প্রশিক্ষণ ও।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাসাইল উপজেলায় ৩৫০ জন কৃষকের মাঝে সূর্যমুখীর বীজ ও সার বিতরণ করা হয়। বাসাইল এর সদর ইউনিয়ন থেকে প্রতিটি ইউনিয়ন এর কৃষক পর্যায়ের প্রায় ৪৭ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর বীজ বপন করা হয়েছে।
গত মৌসুমে মধুপুর উপজেলাতেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ৬৫ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী চাষের জন্য দেয়া হয়েছে বীজ ও সার৷ খুব ই আশা জাগানো কথা হচ্ছে যে সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল করার শিল্পের চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে এ এলাকায়।
এরকম প্রতিটি উপজেলাতেই চাষ হচ্ছে সূর্যমুখীর।
সূর্যমুখীর ব্যাপক ফলন সম্ভব, আর এজন্যই টাঙ্গাইল এ প্রতিটি উপজেলাতেই উপজেলা সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে সূর্যমুখীর বীজ, সার, সব ই বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে এলাকার সেলেকটেড কিছু কৃৃষক কে। একটি বিষয় খুব ভালো লাগলো জেনে যে কৃষকরা এক বিঘা জমি থেকে লক্ষ টাকা আয় করতে পারবেন বলেই আশা রেখেছেন এই সূর্যমুখী থেকে।
সেই ১৯৭৫ সাল থেকে সূর্যমুখী আমাদের দেশে চাষ হয়৷ যদিও অন্য দেশের তুলনায় এ উৎপাদন খুব কম এবং প্রসার তো একেবারেই কম। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ও এটি ভোজ্য তেল হসবে অনেক এলাকা তে ব্যবহার করা হয়। এর বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল এর জন্য ই এটি চাষে জোড় দেয়া হচ্ছে। খুব বড় পরিসরে সূর্যমুখী বারি-২ জাতের চাষ হলেও বাংলাদেশ কৃশহি গবেষণা কেন্দ্রের তৈলবীজ কেন্দ্র থেকে ২০১৯ সালে উন্নত জাতের বারি ৩ নামে আরেকটি জাত অবমুক্ত করা হয়। এ জাতের গাছ বেশ খাটো এবং আরো বেশি রোগ প্রতিশেধক ক্ষমতাসম্পন্ন। এছাড়া ও ব্যবহার করা হয় প্যাসিফিক হাইসান-৩৩ নামে একটি জাত। এর জীবনকাল কিছুটা বেশি এবং ফলন ও কিছুটা বেশি।
৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে ই সূর্যমুখী গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা যায় এবং প্রতি বিঘায় প্রায় ৮ থেকে ১০ মন সূর্যমুখীর বীজ পাওয়া যায় ।৷ ১ মন বীজ থেকে পাওয়া যায় ১৭ কেজি তেল যার বাজারদর বেশ। শুধু যে তেল এ ই সীমাবদ্ধ তা না, সূর্যমুখীর খৈল মাছের জন্য খুব উপকারী খাবার। গাছগুলো ও ফেলনা না, জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয় এসব গাছ।
৩ মিটার লম্বা এ গাছটি একবর্ষজীবী। পৃথিবীর বহুদেশে শুধু তেল উৎপাদন এর জন্যই এই গাছের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। সমভূমি এলাকায় শীত ও বসন্তকালে এবং সমুদ্র কূলবর্তী এলাকায় শীতকালীন শস্য হিসেবে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে৷
এই তেল কিন্তু ঘি এর বিকল্প হিসেবে ও ব্যবহৃত হয়, যাকে বলা হয় বনস্পতি।
অনেক উপকারী তা এ তেল এর। যেমনঃ
◑অন্যান্য যে কোন তেল এর থেকে বেশি পুষ্টিগুণ এ সমৃদ্ধ এ তেল এ কোলেস্টেরল এর মাত্র খুব ই কম, নেই বললে ই চলে যা হৃদরোগের জন্য খুব বেশি উপকারি। এছাড়া ও এতে রয়েছে ভিটামিন এ, ডি ও ই।
◑সূর্যমুখীর বীজ খনিজ পদার্থের খুব ভালো উৎস। হাড় গঠনে খুব বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
◑এর তেল এ বিদ্যমান লিনোলিক এসিড যা হার্ট এর জন্য খুব ই ভালো।
◑এতে রয়েছে ভিটামিন ই যা এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং নিয়মিত খেলে অ্যাজমা ও বাতরোগ সেরে যায়।
◑সূর্যমুখীর বীজে উপস্থিত ভিটামিন বি-৬ এর জন্য চুল পরা কমে এবং নতুন চুল ও গজায়।
◑গ্যস্ট্রিক, আলসার এ অনেক উপকারী এ তেল।
◑চামড়ায় জ্বালা পোড়া সারাতে সক্ষম এ তেল।
◑হাঁপানি তে খুব ই উপকারী ।
◑শরীর কে কার্যক্ষম করে তোলে, শরীরেরর দূর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।
বহু স্বাস্থ্য গুণে গুণান্বিত এই তেল কিন্তু এর প্রসার কম। জনগণ জানে ই না এ তেল সম্পর্কে৷ প্রতি বছর এত রিফাইন্ড ওয়েল আমদানি করতে হয় যে খাতে অনেক টাকা চলে যায় কিন্তু সূর্যমুখীর উৎপাদন বাড়াতে পারলে যেমন সয়াবীন এর মত ক্ষতিকারক একটা তেল খাওয়া লাগতোনা, তেমনি স্বাস্থ্যঝুকি ও কমতো৷
তবে এটা ঠিক যে এক সময় শুধু উচ্চবিত্তরা এ তেলের কথা ভাবলেও এখন মধ্যবিত্ত মহলের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এ তেলের আমদানি বাড়ছে৷ এবং গত পাঁচ বছরের তথ্য অনুযায়ী বছরে গড়ে ৩৭ শতাংশ হারে বাড়ছে সূর্যমুখী তেল এর আমদানি, বিপরীতে সায়বিন ও পাম ওয়েলের আমদানি পরিমাণ বেড়েছে ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে তেল আমদানি হয়েছে ৫৪ লাখ কেজি যার বাজারদর ১৩০ কোটি। অবশ্যই স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণেই খাদ্যাভ্যাস এ এই পরিবর্তন আসছে।
বন্দরগুলো থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, বাজারে বোতলজাত সূর্যমুখী তেল আসছে মূলত আটটি দেশ থেকে। এর মধ্যে সবথেকে বেশি আমদানী করা হচ্ছে ইতালি, মালয়েশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক, স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাস ও রাশিয়া থেকে।
বিশ্বে এ ফুলের চাষ এত বেড়েছে এবং এর তেল এর চাহিদা ও এত বাড়ছে যে সয়াবিন এর পরেই এই তেল নিজের জায়গা করে নিয়েছে। রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রে সূর্যমুখীর আবাদ হয় সবথেকে বেশি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে ও এর চাষাবাদ দিন দিন বেড়েও চলছে।
ঢাকার মত বড় শহর গুলোতে বোতলজাত হিসেবে এ তেল পাওয়া যায়। শহরের দিকে মুদি দোকানেও এই তেল গুলো পাওয়া গেলে ও গ্রামের দিকে এর কোন প্রচলন নাই। স্বাস্থ্যের জন্য এতটা উপকারী এ তেল কিন্তু এখনো লোকচক্ষুর আড়ালে ই রয়ে গেছে শুধুমাত্র এর দাম এর জন্য৷
কিন্তু দাম টা এত বেশি যে সবাই নাগাল ই পায়না এই তেল রান্নার কাজে ব্যবহার করতে। একজনে বা একদিনে এই সমস্যা নিরোধন সম্ভব না তবে অনেকেই উদ্যোগ নিলে তা অবশই সম্ভব। এখন দিন পরিবর্তন হচ্ছে, সামনে আরো অনেক বেশি পরিবর্তন আসবে নিঃসন্দেহে।
বাংলাদেশ এর আবহাওয়া, জল, মাটি সব ই সূর্যমুখী চাষের অনুকুলে শুধু স্বদিচ্ছা থাকাটা জরুরী । প্রয়োজন অনেক বেশি প্রচারণার, সচেতনতা বৃদ্ধি করার। এর জন্য ই-কমার্স সবথেকে বেস্ট মাধ্যম। কম সময়ের মাঝে ব্যপক পরিসরে প্রচারে ই-কমার্স এর বিকল্প নেই।