লাওস দক্ষিন এশিয়ার একটি দেশ। মূলত তিব্বত ও মাঙ্গোলিয়ার সমভূমি থেকে আসা লাওসের কিছু নারী বাটিকের কাজ শুরু করেন৷ আমরা জানি বাটিক হলো নির্দিষ্ট রঞ্জনবিদ্যা। এই সকল নারীরা জঙ্গল থেকে মৌমাছি থেকে মোম সংগ্রহ করে তা শণ কাপড়ে ধাতব মুখ লাগিয়ে বাঁশের কলমের মাধ্যমে ডিজাইন তুলতেন৷ এটি সম্পূর্ণ হাতে আঁকা বাটিক পদ্ধতি। এ সকল নারীরা সিল্ক, রেশম, তুলা সহ নানান ধরনের কাপড়ে এই নকশা তুলে তা রং চুবিয়ে কাপড়ে বাটিক নকশা তুলতেন৷ এটি অত্যন্ত সুক্ষ্ম, নিবিড় এবং সময় সাপেক্ষ কাজ। তবুও তারা খুবই ধৈর্যের সাথে নিজের কাজ শুরু করলেন।
বাটিক লাওসের ঐতিহ্যকে বহন করে। এরা বাটিকের স্কার্ট তৈরী করে এটি ঐতিহ্যবাহিক পোশাক। বিয়ে এবং মৃত্যুর মত বিশেষ দিনে তারা বাটিকের তৈরী স্কার্ট পরে থাকে।
দক্ষিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা থেকে পর্যন্ত কয়েকবছরের বেশী সময় ধরে বাটিকের ব্যবহার হয়ে আসছে। ডাচ ব্যবসার কারনে ইন্দোনেশিয়া উৎপত্তি স্থল হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও অন্যান্য দেশের বাটিক সমান ভাবে জনপ্রিয়।
ঐতিহ্যগত ভাবে হমং গ্রামের লোকেরা শণ কাপড়ে নিখুঁত বাটিক করেন৷ এখানে প্রতিটি পরিবার নিজের কাপড়ের ব্যবস্থা নিজেরাই করেন।
উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লাওসের এলাকায় শণ (Hemp) গাছ জন্মে। শণ গাছ থেকে সুতা তৈরীর পুরো প্রকৃয়া হাতে তৈরী হতো। শণ গাছের ডালপালা থেকে ছাল ছাড়িয়ে ফাইবার বের করে, সেগুলো একটি বান্ডেলে একসাথে করে তা দিয়ে সুতা তৈরী করে তারপর ব্লিচিং এবং স্পিনিং করে কাপড় তৈরী হতো। এই কাপড়ের উপর মোম দিয়ে ডিজাইন তুলে তা রাঙ্গানো হতো।
হমংদের বাটিকের মোটিভগুলো হতো শাস, ফুল, প্রাকৃতিক পরিবেশ,শামুকের খোল, পশুর দাঁত, শসা, কুমড়ার বিচি, মুদ্রা, বিড়ালের থাবা, বীজ এবং পাহাড়ের প্রতীক। এই ডিজাইনগুলো যখন একসাথে করা হতো তা হমং দের পূর্ব পুরুষদের গল্পগুলো উঠে আসে যা এর পিছনের কারিগররা জানেই না। বাটিকের সঠিক আনতে কাপড়কে কয়েক ঘন্টা রং এ চুবিয়ে রাখা হয়।
বাটিক করার পর সেই কাপড়ের উপর এমব্রয়ডারি, এপ্লিক করার হয়। এর জন্য কাপড়ের কিছু অংশ ফাঁকা রাখা হয়।
প্রায় সব দেশেই বাটিকের ডিজাইন সেই দেশের ঐতিহ্য এবং নির্দিষ্ট মোটিফ তৈরী করা হয়। লাওসের বাটিক ও তার ব্যতিক্রম নয়।
Luang prabang এর নাইট মার্কেটে বিভিন্ন ধরনের নকশার বাটিক পাওয়া যায়। শিশুদের পোশাকে প্রতিরক্ষামূলক নকশার বাটিক করা হয়। লাওসের লোকেরা বিশ্বাস করে নক্ষত্র মোটিফগুলো হলো তারা যখন পশুর মোটিফ শিশুদের জন্মের পশুর প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যবহৃত হয় এক ব্যক্তির জন্মের উপর নির্ভর করে এই প্রাণীটি তাদের জীবনের মাধ্যমে রক্ষা করে।
অক্টোবরে শণ ফসল শেষ হওয়ার সাথে সাথে সুতা তৈরী ও বুননের কাজ শুরু করা হয়। লাওসের সব টেক্সটাইল উৎপাদকেরা মনে করেন, শণ গাছ হতে তৈরীকৃত কাপড় টেকসই এবং লিলেনের মতই আরামদায়ক। যদিও এই শণ কাপড় তৈরী করা কষ্টসাধ্য। ভৌগলিক কারনে বর্তমানে হমং এর লোকেরা উচ্চভূমি থেকে নিচে চলে যাচ্ছে এর ফলে তারা তুলো বা সিন্থেটিক কাপড় ব্যবহার করছে বাটিকের জন্য।
শণ হতে তৈরী বাটিক কাপড় ট্রাউজার, শার্ট, জ্যাকেট, মাথার স্কার্ফ, টুপি, প্রতিরক্ষা লেগিংস, বেল্ট, জুতা, কম্বল, ব্যাগ, অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার পোশাক, নতুন বছরের পোশাক, শামানিক ( শামান অর্থ- ওঝা) অনুশীলনে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
১২০০ বছরের বেশী সময় ধরে বিশ্বজুড়ে চাষ করা হয়েছে শণ। জ্বালানি, কাগজ, খাদ্য, তেল, দড়ি, পালের ক্যানভাস এবং অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে ব্যবহৃত করা হয় শণ৷ তুলার চাইতেও তিনগুণ কাঁচা ফাইবার দেয়। বীজ থেকে তৈরী তেল জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হয় এবং পেট্রোলিয়ামের চেয়ে কম নির্গমন হয়।
বন থেকে মৌমাছির মোম সংগ্রহ করা হয়,ছোট ধাতব পাত্রে গরম করে নীল পেস্টের সাথে মিশিয়ে ( যা মোমকে রঙ করে এবং কাপড়ে দিতে সাহায্য করে)। ধাতব নিব সহ বাঁশের কলমগুলো শণের উপর মোম দিয়ে ডিজাইন আঁকার জন্য ব্যবহৃত হয়। তারপর নীল রং এ ডোবানো হয়। এমন হয় একটি কাপড় দুই সপ্তাহের মধ্যে ৪০ বারের বেশী রঙ এ ডোবানো হয়। এমন ভাবে রোদে শুকানো হয় যেন মোম গলে না যায়। একদম শেষে রং এ দেওয়ার কাজ শেষ করে মোম তোলার কাজ করা হয়।
স্কার্ট তৈরী করতে হলে দুই টুকরো শাঁস একত্রে জোড়া দিয়ে স্কার্টের দৈর্ঘ্যের করা হয়। একটি স্কার্ট তৈরী করতে ৫-৬ মাস সময় লেগে যায়। প্রায় ৪০ বছর আগে একজন মহিলা ৩-৪ টি রূপার মুদ্রায় একটি স্কার্ট বিক্রি করেন।
বাটিকের এই কাজ বংশানুক্রমে মা থেকে মেয়ের কাছে চলে যায়। মেয়েরা প্রথমে সেলাই,এপ্লিক ও শেষে বাটিকের কাজ শেখে। লাওসে একজন নারীর বিয়েতে তার দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সেই দক্ষতাগুলো হলো বাটিক, সেলাই এগুলোই। ১৩ বছরে একজন মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয় এবং তার শিক্ষার দ্বায়িত্ব তার শাশুড়ীকে দেওয়া হয়।
লাওসে Ock Pop Tok( East meets Wast) নামক একটি সংস্থা আছে তারা দেশজুড়ে এসব ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে। শুধু ঐতিহ্য রক্ষাই উদ্দেশ্য নয় এই সংস্থার।তারা আয়ের উৎস খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করে। যাতে করে এই জনগোষ্ঠী আফিম উৎপাদনের দিকে না ঝুঁকে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের লোকেরা।
Ock Pop Tok এর দুটি দোকান রয়েছে যা স্টুডিও ও গ্যালারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখানে প্রশিক্ষণ, সেমিনার লাওসের টেক্সটাইল এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করা হয়। একে লিভিং আর্টস সেন্টার বলা হয়। এটি শুধুমাত্র লাওসের ঐতিহ্যকে প্রচার করে না এটি তাদের আর্থিকভাবে সহায়তাও করে।
লাওসের এই বাটিকগুলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ। এই বাটিক সমগ্র লাওসের ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।