ক্লাস টু বা থ্রি তে থাকতে স্কুলের একটা প্রোগ্রামে কথা ছিলো আমরা বেত নিয়ে যাবো স্কুলে জমা দেওয়ার জন্য। যাওয়ার সময় একটা পুকুরে অনেক গুলো হাঁস দেখে দাড়িয়ে তাদের সাঁতার কাটা দেখছিলাম। যার ফলাফল হিসেবে স্যার ওই বেত দিয়ে আমাদেরকেই পিটাইছিলো। আজ বাঁশ শিল্প নিয়ে লিখতে এসে প্রথমেই এই গল্পটা মাথায় এসেছে।
বাঁশ একটি লোকশিল্প । গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে যে শিল্প উৎপ্রোত ভাবে জড়িত। গ্রামে একটা সময় ভোর হতো বাঁশ পাতার সাথে। কারণ গ্রামের মানুষ রান্নার লাকড়ি হিসেবে বাঁশপাতা ব্যবহার করে থাকে এছাড়াও বাঁশের পাতা দিয়ে বাসন মাজার কাজ করে থাকে।
মৃত দেহের সৎকার থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার যাবতীয় কাজ করা হয় বাশেঁর তৈরি জিনিস দিয়ে। নিত্য ব্যবহার্য এই বাশঁকে লোকসংস্কৃতি ও কারুশিল্পের প্রধান উপকরণ ও বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ২৬ প্রজাতির বাশঁ পাওয়া গেলেও টাংগাইল জেলার পুরোটা জুড়েই দেখা যায় তিন ধরনের বাঁশ। তল্লা, বইরা ও তাড়াই বাশেঁর ঝাড় দেখা যায় প্রতি টা নদী ও বনের ধার ঘেঁষে।
ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীদের শিল্পী জীবন আমাদের টাংগাইলের কারুশিল্পের বিশাল এক অংশ জুড়ে রয়েছে। বাশেঁর তৈরি শিল্প দীর্ঘস্থায়ী না হলেও এটা লোকজীবনের ব্যাবহারের জন্য ধরে রেখেছে তার জনপ্রিয়তা।
ভাওয়ালের আনাচে কানাচে একটা সময় খুব বেশি দেখা যেতো তাড়াই বাশঁ। যা দিয়ে তেমন কিছু করা না গেলেও মাছ মারার জাল, বরশি ও চাটাই তৈরি করা হতো। পাটির পরিবর্তে অনেকেই খাবারের সময় চাটাই ব্যাবহার করে থাকতো।
সময় পরিবর্তন হয়ে আস্তে আস্তে এলো তল্লা ও বরাক বাঁশের আবাদ। যে জমিতে ফসল কম হতো সেই জমিগুলো ব্যবহার করা হতো বাশঁ চাষের জন্য। এভাবেই টাংগাইলের বাশঁ ব্যাবসা শুরু। একদমই বিনা খরচে বছর বছর মোটা অংকের বাশ বিক্রি করতে থাকেন একসময় চাষীরা।
নিজস্ব বাশ বাগান থেকে যখন নিয়ম করে বাশ বিক্রি শুরু হলো কারুশিল্পী রাও তখন একযুগে শুরু করলেন তাদের কারুশিল্প। ভোর থেকে সন্ধ্যা গ্রামের প্রতি টি বাড়িতে কাজ চলতো তখন। প্রথম দিকে শিল্পীরা খুব ভালো করলেও পরবর্তীকালে তারা এই স্বল্প টাকায় জীবন চালাতে না পেরে চলে যায় টাংগাইলের জমজমাট শিল্প তাঁতশিল্পের কাজে।
আমরা সবসময় বলে থাকি সময় আমাদের দ্বিতীয় সুযোগ দেয়। বাঁশ শিল্পের অবস্থা যখন খুবই খারাপ তখন টাংগাইলের দেলদুয়ার উপজেলার শাহ আলম মিয়া নামে একজন চিন্তা করেন এতো সুন্দর কাজের চাহিদা না থাকার কারণ কি, কারণ খুঁজতে গিয়েই তিনি বুঝতে পারেন প্লাস্টিক শিল্পের কথা। প্লাস্টিক আসার পরই বাঁশ শিল্পের ব্যবহার কমে যায়
তারপর তিনি ঢাকায় গিয়ে একটা কারুশিল্পের দোকানে কথা বলেন কারুশিল্প নিয়ে এবং কিছু স্যাম্পল দেখান। যা দোকানি খুবই পছন্দ করেন, এবং আইডিয়া দেন এ থেকে নতুন অনেক কিছুই করা সম্ভব বলে। অল্প একটু সময় লাগলেও ফিরে আসে টাংগাইলের সেই জমজমাট কারুশিল্প।
বর্তমানে শুধুমাত্র টাংগাইলের দেলদুয়ার না, সাথে কালিহাতি, ঘাটাইল, ধনবাড়ী, সখিপুর সহ মধুপুর ও জমিয়ে কাজ করে যাচ্ছে কারুশিল্পের। আভিজাত্যের অন্য এক অংশ জুড়ে রয়েছে বর্তমানে বাঁশের তৈরি তৈজসপত্র।
আজ থেকে বছর দশেক আগে যদি একটা গ্রামের চিএ লক্ষ্য করা হয় দেখা যাবে বাঁশ পণ্যের জয়জয়কার। নবান্নের প্রতিটা কাজ যেনো বাঁশ ছাড়া একদমই অচল। ধানের জন্য বাঁশের তৈরি কুলা, ডুলি, চালনি, ঝাড়ু ছাড়া একদমই চলে না। অন্যদিকে খড়ের মাড়াই করতে ব্যবহার করা হতো বাশেঁর তৈরি মই।
বর্তমান চিএ একটু ভিন্ন হলেও কোনো অংশে কম না। আমরা বিলাসিতা বলি আর প্রয়োজন যাই বলি না কেনো এখন সকালের কফি বা চা অনেকেই বাশেঁর মগ কে প্রেফার করে। রাতের ঘুমানোর খাট বাশেঁর, সোফা বাশেঁর। টাংগাইলের বেশ কিছু ক্যাফে এখন তাদের কাজে পরিবর্তন এনে তৈরি করছে বাঁশ দিয়ে। যেখানে প্রতি টা জিনিস বাঁশের। ক্লায়েন্ট বাঁশের পাএে খাবারের জন্যই বেশি সময় ভীড় করে থাকছে ক্যাফেতে।
টাংগাইলের দেলদুয়ারের সেই বর্ণি গ্রামের চিএ এখন পুরোটাই অচেনা লাগে। গ্রামের এমন কোনো পরিবার নেই যে বাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত না। মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া বর্ণি গ্রামই আজ টাংগাইল জেলার কারুশিল্পের সেরা। আমরা বরাবরই খারাপ কিছুর ফ্লেশ ব্যাক হিসেবে খুব ভালো কিছু পাই, এই গ্রাম হয়তো তারই উদাহরণ।
ইতিহাসের সেরা সাক্ষি হতে পারে এই শিল্প। কখনো প্রয়োজন, কখনো শখ কিন্তু বরাবরই কাজে লেগে আসছে বাঁশের তৈরি জিনিস। এই ব্যাবহারের দিক চিন্তা করেই আমরা আশা করতে পারি ই কমার্সে টাংগাইলের বাঁশশিল্প সেরা হতে পারে।
লেখক
আমিনা
স্বত্বাধিকারী- অপরাজিতা