বাড়ির শোভা আসবাবপত্র৷ একটা বাড়ির সদর দরজা খুলেই যদি ছিমছাম গোছানো পরিপাটি পরিবেশ দেখতে পাওয়া যায় মন টা শান্তিতে ভরে যায়। বাড়ি ঘর, আকর্ষণীয়, সুন্দর হতে পারে অভ্যন্তরীণ ডেকোরেশন এবং নজড়কাড়া আসবাবপত্র দিয়ে৷ এত এত আসবাব সব কিছুর মূলে রয়েছে কাঠ। ভালো মানের কাঠ হলে নিশ্চিত বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। যেকোন বাসা বাড়ি সুন্দর পরিপাটি, করে তুলতে ভালো মানের কাঠের প্রয়োজনীয়তা তাই অপরিসীম।
টাংগাইল জেলা নিয়ে যত বেশি স্টাডি করছি কিংবা এর যত বেশি গভীরে ঢুকছি একটা বিষয় বারবার ই উপলব্ধি করছি যে সবকিছুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ আমাদের জেলা। এত এত পণ্যের ভীড়ে আসবারপত্রের মূল যে উপকরণ কাঠ তাতেও পিছিয়ে নেই টাঙ্গাইল জেলা। আমরা জানি যে মধুপুর এর শালবন আমাদের জেলাতেই অবস্থিত যা আমাদের অনেক বড় সম্পদ। সুন্দরবন এবং চট্টগ্রামের বনাঞ্চলের পর দেশের ৩য় বৃহত্তম বনভূমি মধুপুর বন। এক সময় এই বনে কখনোই কেউ একা প্রবেশ করতোনা। এখনো করেনা, তবে এখন বনের ঘনত্ত্ব আগের থেকে অনেক কমে গেছে৷ টাঙ্গাইল এর মধুপুর, ঘাটাইল, সখীপুর ও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়ার প্রায় ৬২, ৫৬৫ একর এর বনুভূমি ছিলো এটি৷ যার মধ্যে সার্টিফাইড পরিমাণ হলো ৪৫,৫৬৫ দশমিক ৩৮ একর। যদিও ১৯৮৮ সালে ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল এর এই বনুভূমি কে আলাদা করা হয়৷ তবে অবৈধ দখল, অবৈধভাবে কাঠ কাটা এবং বিক্রি এসব করতে করতে এখন এ বন অনেকটা ই বিলীন হয়ে গেছে, ফাঁকা ও হয়ে গেছে।
তারপর ও এখনো বেশ কয়েকটা এলাকা জুড়ে এ বনের বিস্তার। এখানের আশে পাশে আউশনাড়া, চাপাইদ, রামকৃষ্ণবাড়ি, হলদিয়া, চুনিয়া, শোলাকুড়ি, বেদবাড়ি, জয়নাতলী, বেরিবাইদ, অরণখোলা, ফুলবাগচালা, মহিষমারা, জুরাণগাছা, গাছাবাড়ি উত্যাদি বিভিন্ন এলাকা জুড়ে এ বনের বিস্তার।
সেই পাক-মুঘল সময় থেকে এই বন ছিলো দূর্ভেদ্য এবং এখানকার কাঠ ছিলো অনেক সুনামের ধারক এবং বাহক। এই বনের কাঠ তাজমহল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় এ বনের শাল ও গজারি কাঠ দিয়ে ভারতে বহু বড় বড় ইমারত তৈরি তে ব্যবহার করা হতো।
মধুপুরের শাল বন বা গজারির বন যেটাই বলি শুধু কি শাল বা গজারি না, এখানে আছে আজুলি, আমরা, আগর গাব, ছাতিয়ান, তালতা, সোনালু, কাইকা, তমাল, ডেকল, জিগা, জারুল, আওলাগোনা, কানসোনালু, শিরিষ, বাবলা, কাঠাল, বকুল অনেক অনেক প্রজাতির গাছ এখানে আছে যা দিয়ে যেমন উন্নতমানের আসবাব তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, পাশাপাশি ঔষধি সহ নানা কিছুতে ব্যবহার করা হয়।
শুধু এই বন ঘীরে ই না টাংগাইল এ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে ছোট ছোট বনাঞ্চল। এখানের মির্জাপুর, বাসাইল, সখীপুর, কালিহাতি, ঘাটাইল, সখিপুর, গোপালপুর, সাগরদিঘি এই এলাকাগুলোতে রয়েছে ছোট ছোট বন বা বিভিন্ন রকমের প্রচুর ব্যবহার যোগ্য গাছ। ইভেন এই এলাকাগুলো এমন যে রাত একটু গভীর হলে এখন ও এসব এলাকায় যাতায়াত মানুষ ভয় পায়। নির্জন একেবারে বন টাইপ এলাকা যেখানে বিদ্যুৎ এর আলো মেটাতে পারেনা সব চাহিদা যে এলাকা আলোকিত হবে এত ই গাছে ভরপুর।
যেকোন বনের ই প্রধান সম্পদ হলো তার উদ্ভিদ সম্পদ। এগুলো আমাদের পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ কিন্তু এর ব্যবহার এর প্রসারতা এর থেকেও অনেক বেশি তা আমরা সবাই জানি। নিত্যদিনের ব্যবহার্য্য বিভিন্ন আসবাবপত্র, জ্বালানীর প্রয়োজন তো মিটায় ই, এর সাথে খাদ্য, ঔষধ সব কিছুই পাওয়া যায় এই উদ্ভিদ থেকেই।
এমনকি আমাদের টাঙ্গাইল বনবিভাগ ও প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি কাঠ, আসবাবপত্রের কাঠ ঘরে খুঁটি, শন বিভিন্ন উপকরণ হিসেবে এগুলো আহোরণ করে৷
সেই প্রাচীণ যুগ থেকে শুরু করে এসব বনাঞ্চলের আধিপত্য থাকায় এখানে কাঠশিল্প ছিলো মাথা উঁচু করে৷ এখনো অবস্থাসম্পন্ন পরিবার এর দিকে তাকালে তাদের দরজা থেকে শুরু করে বাসার বিভিন্ন কোণাকুণি পর্যন্ত দেখা যায় নকশাখোচিত সূত্রধরদের শিল্পকর্ম। যারা এ শিল্পের সাথে জড়িত তাদের বলা হয় ছুতার বা সূত্রধর। এরা কিন্তু সেই সময় থেকেই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আসছে। আগে যেমন খুব বেশি পরিমাণে নৌকা, লাংগল, মই, গরুর গাড়ি, গৃহ নির্মাণের জিনিসপত্র, জলচৌকি, টুল, পিঁড়ি, কাঠের চামচ, হুকোর নলচে, চারপায়া, বেঞ্চ তৈরি করতো এখন তেমন আধুনিক কাঠের সব আসবাবপত্র ই এরা তৈরি করে। আধুনিক ডিজাইন এর খাট, আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল, শোকেজ, ডাইনিং টেবিল, দেয়ালে এটাচড বিভিন্ন আসবাব, বিভিন্ন ডিজাইন এর সোফাসেট, বিভিন্ন ধরণের র্যাক, কর্ণার, দেয়ালে সাজানো সৌখিন আসবাবপত্র বা প্রয়োজনীয় রুচিশীল যে কোন কিছু কাস্টমাইজড ডিজাইন এ তৈরি করে এই ছুতার রা। টাঙ্গাইল এর সূত্রধরদের কাজের এত সুনাম যে এখনো এ অঞ্চলের কাঠের সুন্দর কারুকার্যখচিত পালঙ্ক এখনো সমাদৃত আছে ঢাকার জাতীয় জাদুঘর এর কাষ্ঠশিল্প গ্যালারি তে৷
এই শিল্পের সাথেই জড়িয়ে আছে টাঙ্গাইল এর নৌশিল্প। সারা বাংলাতে ছিলো টাঙ্গাইল জেলার নৌকার সমাদর।
কাঠের এত আধিক্য থাকায় এবং ভালোমানের কাঠ হওয়ায় এখানে বিভিন্ন এলাকার কাঠের সুনাম ছড়িয়ে আছে সারা দেশ ব্যাপি। টাংগাইল এ সখীপুর উপজেলার এর তক্তারচালা বাজারে একটা ফার্নিচার এর হাট বসে। এ হাটের আসবাবপত্র এর সুনাম এর জন্য ই প্রতি হাটেই প্রায় কোটি টাকার আসবাবপত্র বিক্রি হয়। শুধু টাংগাইল না ঢাকা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর বিভিন্ন জেলার মানুষ এখানে আসে ফার্নিচার কিনতে। যদি ও দাম কম না কিন্তু ভালো মানের জন্য এখানে এত কেনাবেচার পসরা বসে। তবে একটা ব্যাপার এখানে আছে এ আসবাব গুলোর ডিজাইন এবং কাঠভেদে দামের ভ্যারিয়েশন এমন হয় যা নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবাই তাদের সাধ্যের মধ্যে ই কেনাকাটা করতে পারে৷
এখানে বিভিন্ন প্রকার খাট, সোফা, দরজা, শোকেজ, আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল, বক্স সোফা, কম দামী, বেশি দামী, নরমাল ডিজাইন থেকে গর্জিয়াস ডিজাইন সব ধরনের আসবাব পাওয়া যায়৷ এসবের পাশাপাশি কাঠে খোদাই করা ঘর সাজানোর উপকরণ, টিস্যু বক্স এর উপর কাঠের খোদাই ডিজাইন, বিভিন্ন সৌখিন র্যাক এরকম অনেক কিছু পাওয়া যায়।
সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে সব সময় কোয়ালিটি মেইনটেইন করে এখাককার ছুতার রা এবং এ কারণে ই এ হাট দেশের ফার্নিচার এর অন্যতম হাট হয়ে উঠতে পেরেছে।
শুধু এই হাট ই না, টাংগাইল এর ঘাটাইল উপজেলা র ধলাপারা এলাকা তে ও সপ্তাহে দুইবার সোমবার এবং বৃহস্পতিবার শুধু আসবাবপত্র এর হাট বসে। এখানেও বিভিন্ন ধরণের সৌখিন জিনিস থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় যত ফার্নিচার আমরা হরহামেশা ব্যবহার করি সব ধরণের আসবাবপত্র এখানে পাওয়া যায়। ইভেন সব সময় হাটের রেডি ফার্নিচার নিতে হয় এমন না, নিজেরা ডিজাইন কাঠ দেখিয়ে দিলেও তারা এসব করে দেয় নির্দিষ্ট সময় নিয়ে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতা আসে এই হাটগুলোতে। খুচরা যেমন নিজেদের বাসার জন্য পণ্য কিনে তেমনি আবার পাইকারি এখান থেকে নিয়ে ও নিজেরা ব্যবসা করে। হাটবার এর একদিন আগে থেকেই বিভিন্ন ব্যবসায়ী রা এখানে আসা শুরু করে, হাটবার শেষ হয়ে রাত অব্দি চলে এর পসরা। সুন্দর ডিজাইন, অনেক ধরণের ডিজাইন থেকে বেছে নিতে পারে ক্রেতা তাদের সাধ্যের মধ্যে পছন্দের ফার্নিচার টি৷
এ জেলার প্রতিটি উপজেলাতেই আছে আসবাবপত্র তৈরির অনেক কারখানা। এর মাঝে ঘাটাইল এ ই আসবাবপত্র তৈরির কারখানা আছে ১৪৫ টি।
বাংলাদেশ এর আসবাবপত্রের অনেক সুনাম রয়েছে বিশ্ববাজারে। অলরেডি মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি হচ্ছে আমাদের দেশের ফার্নিচার। অনেক বড় বড় কোম্পানি বিনিয়োগ করছে এ খাতে কেননা অনেক সম্ভাবনাময় একটি খাত আমাদের জন্য৷ আর একটু নজড় দিলে রপ্তানিতে এই সেক্টর অনেক ভালো করতে পারবে এবং রপ্তানি আয় বাড়বে বলেই ধারণা সংশ্লিষ্টদের৷
এত প্রসিদ্ধ একটা সেক্টর এবং যা সব সময় মানুষের প্রয়োজন,, সেই আসবাব পত্র ও এখন ই-কমার্স এ বড় একটা অংশ দখল করে নিচ্ছে। এমন হয় মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা ফার্নিচার পছন্দ হলো, একটু ভুলে ও যদি লাইক দিয়ে ফেলি সারাক্ষণ আসতে থাকে একটার পর একটা ফার্নিচার এর পেজ।। ইস কত কিছু করতে মন চায়, হয়ে উঠেনা।।। তাহলে ভাবা যায় ভালো মানের আসবাব এর ই-কমার্স এর কত সম্ভাবনা কেননা আমিই না শুধু আমার মত অনেকেই অবশ্যই ফার্নিচার এর ছবি দেখে বিভিন্ন পেজ এ। অথচ ঘরের কাছে এত ভালো সোর্সিং তাই হয়তো আমরা জানিনা কত মানুষ৷ অন্যান্য কত জায়গা থেকে বিদেশী কাঠ এর ফার্নিচার কিনতে ব্যস্ত হয়ে পরলেও আমরা জানিনা যে সাধ্যের মধ্যে দীর্ঘসময় স্থায়ী হওয়া আসবাবপত্র গুলো আমাদের নিজজেলাতেই কতটা প্রসিদ্ধ৷
এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যদি কোয়ালিটি ভালো দিয়ে ই-কমার্স এর মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায় তবে অবশ্যই আরো অনেক সম্ভাবনা আছে। কেননা ইন্টারনেট এর এ যুগে আমরা সব কিছুতে নেট নির্ভর হয়ে যাচ্ছি এবং দিন যত যাচ্ছে এই নির্ভরযোগ্যতা বাড়ছে। সবথেকে বেশি প্রয়োজন ভালো মানের অনেক কন্টেন্ট যেটাতে আমরা খুব বেশি পিছিয়ে আছি। টাংগাইল প্রসিদ্ধ, টাংগাইল এর কাঠ এর মানের দিকে এগিয়ে এসব সবাই তখন ই জানবে যখন আমরা অনেক লিখবো। এই আসবাবপত্রের বিশাল বাজার গড়ে উঠতে পারে ই-কমার্স এ ই। উদ্যোগ আমাদের ই নিতে হবে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এগিয়ে আসলেই এদিকের বাজার বড় হবে৷