❝মিষ্টি❞ শব্দটা শুনলেই জিভে জল আসে। এমনকি আদিকাল থেকেই বাঙালির যেকোন অনুষ্ঠান পালা- পার্বণে মিষ্টি না হলে চলে না। মিষ্টি নিয়ে বাঙালি জাতি যতটা আহ্লাদ করে বোধকরি আর কোন জাতিই হয়ত করেনা। আজ এমন একটি মিষ্টির কথা বলব যা ফেনী জেলার নাম উজ্জ্বল করে রেখেছে গত ৫০ বছর ধরে৷
বাংলাদেশের একটি ছোট্ট ছিমছাম জেলা ফেনী। যেখানে অবর্ননীয় সুন্দর সব ঐতিহাসিক স্থান, বিখ্যাত ব্যাক্তি ,বিখ্যাত খাবার থাকলেও একটি মিষ্টি সবার মুখে মুখে পরিচিত যার নাম ❝খন্ডলের মিষ্টি❞। এই মিষ্টি স্বাদে ও বৈচিত্রে এককথায় অনন্য। শুধু তাই নয় এর অসাধারণ স্বাদ একে করেছে অতুলনীয় যা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও পৌছে গেছে ।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য চুলা থেকে গরম কড়াই নামানো মাত্রই শুরু হয়ে যায় মিষ্টি প্রেমিদের ভীড়। মিষ্টি সাধারণত ঠান্ডা খাওয়ার প্রচলন হলেও ফেনীর খন্ডল মিষ্টি গরম গরম খেতেও দারুন সুস্বাদু । এমনকি দূর- দূরান্ত থেকে বহু মানুষ ছুটে আসে সিরায় ডুবানো খন্ডলের ধোয়া উঠা মিষ্টি খেতে। এটি মূলত রসগোল্লার একটি ভিন্ন সংস্করণ। কিছু সাধারণ উপকরনে তৈরি মিষ্টিটির সুনাম শুধু ফেনী জেলা নয় তার আশে পাশের জেলায় ছড়িয়ে গেছে শুধুমাত্র এর অনন্য স্বাদের কারনে।
ঠিক একারনেই ফেনীর বিখ্যাত কোন কিছুর নাম কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই সবার আগে খন্ডলের মিষ্টির কথা শোনা যায়।
তবে এই সুস্বাদু মিষ্টির নাম কেন খন্ডল হল সেই ইতিহাসটি একদিকে ভারি মজার অন্যদিকে জ্ঞানগর্ভেরও বলতে হয়। কারন এর ইতিহাস জানতে হলে ৫০ বছর আগে ফিরে যেতে হয়। এই মিষ্টি ১৯৭০ দশকের হলেও এটির সুনাম ও স্বাদ আজও অম্লান।
কারন প্রায় গত ৫০ বছর ঐতিহ্য ধরে রেখে তৈরি হচ্ছে পরশুরাম উপজেলার এই “খন্ডলের মিষ্টি”। যা এখনও খুবই জনপ্রিয় ও বিখ্যাত।
বাংলাদেশের ফেনী অঞ্চলের “খন্ডল” নামক স্থানে এটি উৎপন্ন। মূলত খন্ডল নামটি হল ফেনীর পরশুরাম উপজেলায় অবস্থিত একটি স্থানের নাম। যার অবস্থান ফেনীর উত্তরে ঠিক ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের কাছাকাছি। পরশুরাম উপজেলারএকটি ইউনিয়নের নাম বক্সমাহমুদ। যেখানে একটি প্রাচীন হাট রয়েছে –
যার নাম ❝খন্ডল হাই❞।
এই “‘খন্ডল হাই'”নামটি মূলত বাজারের পাশে অবস্থিত খন্ডল হাই স্কুল এন্ড কলেজ এর নামে নামকরণ ।এবং ইতিহাস বলে খন্ডল হাই বাজারের একটি মিষ্টির দোকান থেকেই পরিচিতি পায় এই মিষ্টি।দোকানটির পূর্ব নাম পাটোয়ারী মিষ্টি মেলা । খন্ডলের মিষ্টির জনপ্রিয়তার কারনে নামে বেনামে বহু দোকানের জন্ম হলেও আসল দোকান এই নামে আজও বহাল আছে যথেষ্ট খ্যাতি ও সুনামের সাথে।
অতীতের গর্ভে থাকা তথ্য আমাদের জানায় স্বাধীনতার পর পরই স্থানীয় কবির আহাম্মদ পাটোয়ারী বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের খন্ডল হাই স্কুলের পাশে একটি মিষ্টির দোকান দেন। তিনি তার দোকানে একজন ময়রাকে নিযুক্ত করেন যার নাম “যোগল চন্দ্র দাস”। ৬২ রকমের মিষ্টি তৈরি করতে পারতেন এই কারিগর।এবং তার বানানো মিষ্টির দৃশ্য দেখার জন্য ভীড় লেগে যেত দোকানে।
অল্পদিনেই তার তৈরি মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এবং এলাকার নামেই মিষ্টির নাম পরিচিতি পেয়ে যায় “খন্ডলের মিষ্টি” নামে। এবং যোগলের ভাঙা দোকানের সামনে নামী দামি গাড়ির বহর দেখা যেত মিষ্টি কেনার ধুমে।
নানা জায়গা থেকে লোকজন ছুটে আসত এই মিষ্টি গরম গরম খেতে। অসংখ্য দোকান গড়ে উঠলেও মিষ্টির আদি স্বাদ ধরে রেখেছে কবির আহাম্মদ পাটোয়ারী ও “খন্ডলের মিষ্টি মেলা”।
বর্তমানে যোগল চন্দ্র বয়সের ভারে নুজ্য। দোকানি পাটোয়ারী সাহেবও আর নেই তার জায়গায় পরিচালনা করেন তার ছেলে বেলাল হোসেন ও আমীর হোসেন।
এবং অন্য কারিগররা যারা সরাসরি যোগল চন্দ্র থেকে হাতেখরি নিয়েছেন তারাই মূলত বর্তমানে সব মিষ্টির যোগান দেয়।
তিনি জানান , ঈদ-পূজা- পার্বণ- পরীক্ষা সবসময় তার বিক্রি ভাল হয়৷ তখন দৈনিক ৯০ থেকে ১০০ কেজি মিষ্টি তৈরি করা হয়। অন্যসময় প্রায় ৫০-৬০ কেজি মিষ্টি তৈরি হয়। বলা যায় একজন মানুষ এক কেজি মিষ্টিও অনায়াসে খেয়েখেয়ে ফেলতে পারে। কারন এটি অল্প মিষ্টিযুক্ত যা ডায়াবেটিস রোগিরাও চেখে দেখতে পারেন।
খন্ডলের মিষ্টির সুনাম দিক বেদিক ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে এখানে মিষ্টি খেতে জেলার বাইরে থেকেও গাড়ি নিয়ে অনেকেই চলে আসেন। এবং খন্ডল মিষ্টি তৈরি করে জেলার প্রায় শতাধিক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন। অন্যদিকে বাজারে অনেক নামিদামি মিষ্টি থাকা স্বত্তেও রাতদিন দূর – দুরান্ত থেকে বহু লোক এই মিষ্টি খেতে তার দোকানে আসেন। তারাও পরম আতিথেয়তায় গরম গরম মিষ্টি খাওয়ান। কেউ আবার খন্ডল মিষ্টি গরম গরম বাড়ি নিয়ে যেতেই পছন্দ করেন।
আজকাল বাজারের নামি দামি অনেক মিষ্টিতেই ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রনের কথা শুনতে পাই আমরা। কিন্তু খন্ডলের মিষ্টিতে নেই কোন ক্ষতিকারক রাসায়নিক । যার কারনে এই মিষ্টির এত প্রসার যা ঐতিহ্য ধরে রেখেছে যুগের পর যুগ।
খন্ডলের মিষ্টি তৈরি প্রণালী জানা যায় বেলাল হোসেনের কাছ থেকে। মিষ্টি তৈরিতে গরুর খাটি দুধ, সামান্য ময়দা ও চিনি ব্যাবহার করা হয়। দুধের সঙগে সামান্য ময়দা ব্যবহার করা হয় ছানাকে গাঢ় করার জন্য। সর্বপ্রথম দুধ ও ময়দার মিশ্রনে ছানা তৈরি হয়। ছানা থেকে তৈরি হয় মরু, মরু থেকে খণ গোলাকার মিষ্টি। তারপর তেল ভেজে চিনির তৈরি সিরায় ডুবিয়ে রাখা হয়।
ছোট একটি মিষ্টির দোকান দেশে বিদশে এত সুনাম কুড়িয়েছে যে হয়ে গেছে একটি জেলা ব্র্যান্ড। তাই ❝খন্ডলের মিষ্টি❞ যদি ই- কমার্সে আসে তাহলে এর প্রসার ও প্রচার দুটিই বাড়বে। অন্যদিকে এমন একটি ঐতিহ্যবাহি খাবার অনলাইনে বিক্রির উদ্যোগ গ্রহন করা গেলে দেশের সুনাম বাড়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে ও ভূমিকা রাখতে পারবে। কারন এই মিষ্টি উদ্যোক্তার সৎভাবে পরিশ্রমের ফলেই আজ এটি ফেনী জেলার সুনাম বয়ে এনেছে। তাই বলতে হয় সৎ ভাবে নেওয়া ছোট একটি উদ্যোগ ও অনেকসময় বড় আর বিখ্যাত হয়ে যেতে পারে। এবং ফেনীর খন্ডলের মিষ্টি তার একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।