মারাংতন বান্দরবানের বুকে যেন এক টুকরো স্বর্গরাজ্যে। যে রাজ্যটা সবাইকে টানে। রাতের আধারে মখমলের মতো মেঘ ছুঁয়ে দেখার অনন্য এক অনুভুতি যা শুধু মারায়ংতং-এ পাওয়া। চুপিচুপি মেঘের সাথে রুপকথার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া যায়। মেঘের স্পর্শ-আলিংগনের নিবিড় বন্ধন রচিত হয় মারায়ংতং-এর সুখ পালকে। হতবিহ্বল মনের আকুতির ডাকে সাড়া দিয়ে আসুন আজ ঘুরে আসি বান্দরবানের এক সুখপাখির স্বর্গরাজ্যে। মারায়ন তং নামক পর্বতটি ছুঁয়ে দেখতে…
মারায়ংতং পাহাড় বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায় অবস্থিত। এই পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ১৬৬০ ফুট। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বিশাল একটি জাদি সবার প্রথমে চোখে পড়বে। জাদি মানে বৌদ্ধদের পূজা-অর্চনার জন্য বানানো বুদ্ধমূর্তি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬৬০ ফুট ওপরে দাঁড়িয়ে অন্যরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়, শুধু অনুভূতি নয় কিছু চ্যালেঞ্জ ও থাকে পাহাড় জুড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় ছুঁয়ে দেখার তীব্র লালসায় ও যাওয়া যায় বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার মারাইংতং-এ।
মারায়ংতং-এর সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে গেলে হাঁটতে হবে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পাহড়ি রাস্তা। যেখানে কোথাও এক ফুটের জন্য রাস্তা নিচের দিকে নামেনি! শুরু থেকে শেষ অব্দি একদম পুরোটাই রাস্তা খাড়া।
মারায়ংতং-এর চূড়ায় ক্যাম্পিং করাটা অনেকটা দুঃসাহসিক ব্যাপার। ‘মারায়ংতং’, ‘মারাইংতং’, ‘মেরাইথং’ বিভিন্ন নামেই ও ডাকা হয় এই পাহাড়কে। চূড়ায় উঠেই সবার প্রথমে চোখে পড়ে বিশাল এক জাদি। জাদি হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মীদের এক পূণ্যস্হান। এমনভাবে জাদিটি বানানো যেন সে দূর কোনো প্রান্তের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির রহস্য নিয়ে ভাবছে আর স্মিত হাসি ফুটে উঠছে তার ঠোঁটে। জাদির চারদিকে খোলা ও ওপরের দিকে চালা।
পাহাড়টির ওপরের অংশটুকু সমতল। যত দূর দৃষ্টি যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে জনবসতি। নিচে এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে মাতামুহুরী নদী। নদীর দুই কূলে দেখা যায় ফসলের ক্ষেত। এ পাহাড়ে রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসীদের বসবাস। এদের মধ্যে ত্রিপুরা, মারমা ও মুরং অন্যতম।
এই পাহাড়ের নিচে থাকে মারমারা। আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে মুরংদের পাড়া। এরা পাহাড়ের ঢালে বাড়ি বানিয়ে তারা বসবাস করে। মাটি থেকে সামান্য ওপরে এদের টংঘর।টং ঘরের নিচে থাকে বিভিন্ন গবাদি পশু যেমন-গরু, ছাগল, শূকর ও মুরগি। গবাদি পশুর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জ্বালানি কাঠও রাখা হয় স্তূপ করে রাখা হয়।
বিকেল বেলা সূর্য যখন পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে প্রকৃতির অনন্য একটা রূপের দেখা পাওয়া যায় এখানে। মনে হবে পাহাড় নিজের ছায়াতলে খুব সযত্নে আলতো করে সূর্যটাকে লুকিয়ে রেখে দিচ্ছে। বিকেলের স্নিগ্ধ আলো আর সন্ধ্যার রক্তিম আকাশের মিষ্টি একটা পরিবেশ পাহাড়ের চূড়ায় থাকা সবাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে নেয়। চারিদিক স্তব্ধ হয়ে গেলে চূড়ায় থাকা সবকিছুকে খুব গভীরভাবে অনুভব করা যায়, খুব কাছ থেকে প্রকৃতির হিংস্র রূপ দেখে আসা যায় আবার প্রকৃতির করুণা ও উপভোগ করা যায়। ক্ষনিকের জন্য মনে হবে সাজেকের চেয়েও সুন্দর মারায়ংতং!
রাতের আকাশে সুবিন্যস্ত তারকারাজির অমায়িক একটা দৃশ্য ক্রমশই ভুলিয়ে দেয় দিনের বেলার সকল পরিশ্রম, ভয়াবহতা, ক্লান্তি–গ্লানিকে। রাত কাটালে স্রষ্টার নিকট আপন মনে চাওয়া হয় এই রাত যেন শেষ না হয়।
প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ঘুরে আসতে হবে মারায়ংতং।
মারায়ংতং যেতে হলে প্রথমেই চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায় আসতে হবে। রাজধানী ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহন বাস সরাসরি আলীকদম আসে। হানিফ, শ্যামলী উল্লেখযোগ্য। রাতের বাসে রওনা দিলে সকালেই পৌঁছে যায় আলীকদম।
কক্সবাজারগামী যেকোন বাসে করে চকরিয়া নেমে সেখান থেকে যাওয়া যায় আলীকদম। চকরিয়া থেকে আলীকদম যাওয়ার ও লোকাল বাস আছে। প্রতিদিন সকাল ৭ টা থেকে সন্ধ্যা ৬.৩০ পর্যন্ত ৩০ মিনিট পর পর আলীকদমের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
লোকাল জীপ বা চান্দের গাড়িতে করে চকরিয়া থেকে আলীকদম যাওয়া যায় । লোকাল ভাড়া নিবে ৬০/৬৫ টাকা। পুরা রিজার্ভ নিলে ভাড়া বাড়বে অবশ্যই
সাথে অবশ্যই প্রয়োজনীয় খাবার, পানি, তাবু, শুকনা খাবার রাখতে হবে। জিপ গাড়ি ভাড়া করে আবাসিক বাজার হয়ে চলে আসবেন মারায়ংতং পাহাড়ের কাছে। গাড়ি একদম মারায়ংতং পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত আসে।
রাহাত সোলতানা