চোখজুড়ানো ভুট্টার আবাদ নজর কাড়ছে গ্রামবাসীর। দক্ষিণ চট্টগ্রামে সম্ভাবনাময় ভুট্টা আবাদ বেড়েই চলছে।আর চাহিদা মেটাতে দক্ষিণ চট্টগ্রামে পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে, নদী উপকূলের বিস্তীর্ণ চরে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সম্ভাবনাময় ভুট্টার আবাদ বেড়েই চলেছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে পুনর্বাসন কর্মসূচির অধীনে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ, বোয়ালখালী, বাঁশখালী, মিরেশ্বরাই, সীতাকুন্ড, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় ৩৩ শতকের ১০টি করে মোট ১০০টি এবং উল্লিখিত উপজেলাসহ সাতকানিয়া, আনোয়ারা ও লোহাগাড়া উপজেলায় রাজস্ব খাতে ৩৩ শতক করে আরো ৮০টি প্রদর্শনী প্লটে ভুট্টার আবাদ করা হয়।
শুরুতে ভুট্টার ফলন ও বিপণন নিয়ে কৃষকগণ বিপাকে পড়লেও মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মধ্য দিয়ে ভুট্টা আবাদে এলাকার চাষিদের মাঝে বেশ সাড়া পড়েছে। ফলে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে উৎপাদন ও চাষের পরিধি দুটোই প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামেও চট্টগ্রামে ভুট্টা চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মাঝে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভুট্টার ফলন ভাল হয়েছে।
বর্তমানে দেশে গম ও ভুট্টা গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক উদ্ভাবিত জাত ছাড়াও বিদেশী হাইব্রিড এন এইচ ৭৭২০, কোহিনুর পি-৩৩৯২ ছাড়াও বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। এতে গড়ে প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় ১২ থেকে ১৪ মেট্রিক টন পর্যন্ত।
যেখানে গত ১৫-১৬ অর্থবছরে ২৮ লাখ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপন্ন হয়েছে সেখানে গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে ভুট্টার উৎপাদন বেড়ে এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪৯ লাখ মেট্রিক টন । এ পরিসংখ্যান থেকেই বুঝা যায় গত পাঁচ বছেরের ব্যবধানে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
ধান গমের তুলনায় ভুট্টার পুষ্টিমান বেশি। এতে প্রায় ১১ শতাংশের ওপরে আমিষ জাতীয় উপাদান রয়েছে। আর আমিষে প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড, ট্রিপটোক্যান ও লাইসিন অধিক পরিমাণে রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ভুট্টায় প্রায় ৯০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন বা ভিটামিনের উপস্থিতি রয়েছে।
গত বছর দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছে সাড়ে ৫৬ লাখ টন, যা গত পাঁচ বছরের দ্বিগুণেরও বেশি। তবু দেশে চাহিদার তুলনায় ভুট্টার ঘাটতি রয়ে গেছে। কারণ প্রাণিখাদ্য হিসেবে প্রতিবছর দেশে ভুট্টার প্রয়োজনীয়তা ছাড়িয়ে গেছে ৭০ লাখ টন।
দেশের প্রাণিখাদ্যের বাজার এখন ভুট্টার ওপর নির্ভরশীল। মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার খাবারের চাহিদাও বাড়ছে। দেশের শতাধিক কোম্পানি এসব খাদ্য প্রস্তুত করছে। পাশাপাশি ভুট্টা চাষ, মানুষের বিভিন্ন খাদ্য তৈরি, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতসহ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। সবমিলিয়ে দেশে এখন ভুট্টার বড় কারবার চলছে। খাদ্যশিল্পে ভুট্টা ব্যবহারের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। দেশে প্রচুর কর্নফ্লাওয়ার, স্টার্চ প্রয়োজন হয়, সেটা আমদানি করা হচ্ছে।
পাঁচ বছরে ভুট্টার দ্বিগুণ উৎপাদনভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টন। যা গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় সাড়ে ৫৬ লাখ টনে। দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। দেশে গত কয়েক বছরে ভুট্টার উৎপাদনশীলতা বেশ বেড়েছে। এখন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৯ দশমিক ৭৪ টন ভুট্টার ফলন হচ্ছে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
দেশে এখন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৯ দশমিক ৭৪ টন। গ্রীষ্ম ও শীত দুই মৌসুমে ভুট্টা চাষ হয়। তবে মোট উৎপাদনের ৮৭ শতাংশই হয় শীত মৌসুমে। কিন্তু দেশে ভুট্টার চাহিদা থাকে সারাবছর। পাল্লা দিয়ে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। সারাবছরে শস্যটির চাহিদা থাকে ৭০ লাখ টনের বেশি।
প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশে প্রাণিখাদ্যের বাজার বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। প্রাণিখাদ্য তৈরির বড় অংশই ভুট্টা থেকে আসে। এর মধ্যে মুরগির খাদ্য তৈরিতে ৫৫ শতাংশ ভুট্টার দরকার হয়। এ হার গবাদিপশুর খাদ্যে ৩০ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। শুধু এ তিন খাতে বছরে ৪৫ লাখ টন ভুট্টার চাহিদা রয়েছে।
নতুন সম্ভাবনা ভুট্টার তেল ও অন্যান্য পণ্যসম্প্রতি আলোচনায় এসেছে ভুট্টার তেল। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বছরে দেশে উৎপাদিত ৫৪ লাখ টন ভুট্টা থেকে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টন ভুট্টার তেল আহরণ করা সম্ভব। যার বাজার মূল্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
তথ্য মতে,ভুট্টার তেলে বিদ্যমান সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলের সমপরিমাণ। ভুট্টার তেলে ভিটামিন ‘ই’ (টোকোফেরল) এর পরিমাণ সূর্যমুখী তেলের চেয়ে বেশি। বিশেষত ভুট্টার তেলে ভিটামিন কে (১.৯ মাইক্রো গ্রাম) রয়েছে যেখানে সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলে তা অনুপস্থিত। এছাড়া সালাদ থেকে শুরু করে খাবারের বিভিন্ন আয়োজনে ও বর্তমানে ভুট্টা ব্যবহার করা হয়।
ভুট্টা থেকে স্টার্চ, ইথানল, চিনি, সিরাপ এবং কাণ্ড, পাতা ও ডাঁটা থেকে কাগজ, কার্ড বা হার্ডবোর্ড, প্লাস্টিক পাইপসহ বহু শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি করা যায়।উদ্ভাবন হচ্ছে নতুন নতুন জাতকোয়ালিটি প্রোটিন ও প্রো ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ভুট্টার জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পপকর্ন, বেবিকর্ন ও মিষ্টি ভুট্টার জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট।
চট্টগ্রামের চরাঞ্চল ও পতিত জমিতে ও ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। ফলে দেশের যে চাহিদা তা অনায়াসেই উৎপাদিত হবে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে খরচ ও পরিশ্রম কম হওয়ায়
উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের এবং ভুট্টার ভালো দামও পাচ্ছেন।
ভুট্টা চাষের পর সেই জমিতে আবার পাটের আবাদ করা হচ্ছে।এদিক দিয়ে ও লাভ হচ্ছে কৃষকরা।পরিকল্পিত প্ল্যানিং হলে চট্টগ্রামের ভুট্টা ও ই-কমার্সে রাখতে পারে অনন্য অবদান।
রাহাত সোলতানা
অভিরুচি বুটিকস