হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যে ভরপুর বাংলাদেশের একটি জেলা ফেনী। ইতিহাস বলে বহু রাজা ও শাসকের বারবার পালবদলের বদৌলতে এখানে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা , দীঘি , ও দর্শনীয় স্থান। প্রাচীন সমটত জনপদের অন্তর্গত ফেনী জেলা আজও এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনকে লালন করছে। অজস্র প্রাচীন নিদর্শন ছড়িয়ে আছে ফেনীর গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আজ বলব শতবছরের প্রাচীন রুপকথা আর ঐতিহ্যে ভরপুর একটি নিদর্শন ❝বিজয় সিংহ দীঘি❞ নিয়ে।
তবে এই দীঘীর ইতিহাস নিয়ে নানা রকম কাহীনি প্রচলিত। রয়েছে অনেক মতপার্থক্য । অনেকের মতে এটি বাংলার বিখ্যাত সেন বংসের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেনের অমর কীর্তি। বলা হয় ৫০০থেকে ৭০০ শত বছর আগে সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা এটি খনন করেছিলেন । আবার অনেক মনে করেন দীঘিটি খনন করেন স্থানীয় রাজা বিজয় সিংহ। বিজয় সিংহ তার মাকে খুশি করার জন্য এটি খনন করেন ।
বিখ্যাত এই দীঘি নিয়ে বহু রুপকথা ও কাহিনী লোকমুখে শোনা যায় । কথিত আছে একসময় এই দীঘিতে সোনা রুপার থালা ভেসে উঠত। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের আগে কত পিস লাগবে বলে রাখা হত । পরদিন ছোট ডিঙি নৌকায় থালাবাসন ভেসে উঠত! একবার একটি থালা চুরি হয় । এরপর থেকে আর থালা ভেসে উঠে না।
এছাড়া জনশ্রুতি আছে এই দীঘিতে বড় বড় মাছ পাওয়া যেত সেগুলোর একেকটির ওজন ৮০-১০০ কেজি পর্যন্ত হত । বিজয় সিংহ দীঘির নামে গ্রামের নাম হয় পশ্চিম বিজয় সিংহ। গ্রাম বাসিরা মনে করে এটি প্রায় ৭ টি পুকুরের সমান এবং স্থানীয়রা অনেকে এটিকে ৭ পুকুর বলেও অভিহিত করে থাকে।
ফেনীর কৃতি সন্তান ঔপনাস্যিক জহির রায়হান তার কালজয়ী উপন্যাস ❝ হাজার বছর ধরে❞ কমলা সুন্দরীকে জিন দিঘীতে নামানোর কথা উল্লেখ করেন। ধারনা করা হয় এই সেই পরীর দীঘি যার কথা তিনি বর্ননা করেছেন তার লেখনীতে। আরো একটি অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় দীঘিটি সম্পূর্ণভাবে সেচ করা সম্ভব হয়নি কখনো । তবে বহু দূর থেকে মানুষ আসে এই দীঘির পবিত্র পানিতে গোসল করতে।
ঐতিহ্যের নিদর্শন এই দীঘিটির আয়তন ৩৭ দশমিক ৫৭ একর। এটি ফেনী জেলার দুই কিলোমিটার পশ্চিমে সার্কিট হাউজের পাশে বিজয় সিংহ গ্রামে অবস্থিত। এর ৩ দিক ঘিরে রয়েছে উঁচু পাহাড়ের মত,যা পরিপূর্ণ হয়ে আছে সবুজ গাছ আর লতাপাতায় । প্রকৃতির অনন্য এই লিলাভূমিতে দর্শনার্থীরা বিকেল বেলায় ঘুরতে আসেন। একপাশে সমতল যেখানে রয়েছে গোসল ও অজু করার ঘাট । পাশেই একটি মসজিদ, দীঘির অপর পাশে সার্কিট হাউজ , পাসপোর্ট অফিস ও সরকারি অফিস যা পুরো জায়গাটার সর্বক্ষন নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। একসময় বহু প্রাচীন বিশাল বৃক্ষরাজী দিয়ে ঘেরা থাকলেও বেশিরভাগ কালের বিবর্তনে নানা দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে হারিয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালে সরকারি উদ্যোগে প্রচুর বৃক্ষদিয়ে এটি পুনরায় সুসজ্জিত করা হয়। বিজয় সিংহ দীঘিকে ঘিরে ফেনীর পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে প্রচুর এবং এটির উন্নতি ও সৌন্দর্য বর্ধনেরর দিকে নজর দিতে এখানে ২০১৮ সালে নির্মিত হয় হাটাপথ, আরসিসি গ্যালারি, লাইটিং, সীমানা প্রাচীর, শৌচাগার।
প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী ভীড় জমায় দীঘির পাড়ে। এর সুসোভীত গাছের ছায়ার বসে বহু মানুষ গল্প ও আড্ডায় মশগুল হয়ে যায় । মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাওয়া নির্মল পরিবেশে দূর থেকে ঘুরতে আসা পর্যটকরা প্রশান্তি অনুভব করে। ফেনীর স্থানীয়রা বিকেল বেলায় চলে আসে দিঘিটির টলটলে পানির স্নিগ্ধতা ও বৃক্ষঘেরা সৌন্দর্য মন্ডিত পরিবেশটি উপভোগ করতে। রাতের বেলা এই দিঘী রুপ নেয় অপার সৌন্দর্যের আধার হয়ে। দিঘীর চারপাশে ঘিরে লাইটিং দীঘির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুন।
ভ্রমনপিপাসু যারা প্রকৃতির কাছে যেতে চান অথবা বাতাস ও শুদ্ধ জলের সাথে সময় কাটাতে চান তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান। চাইলে এই দীঘির সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে রাত্রিযাপন করতে পারেন। বিজয় সিংহ দীঘির পাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে সার্কিট হাউজ। এখান থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে মিজান রোডে অবস্থিত ফেনী জেলা পরিষদের ডাক বাংলো । এছাড়া এল ই জি ডি রেস্ট হাউজ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্টহাউস ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির রেস্টহাউসে রাতে থাকা যায়। এছাড়া রয়েছে আবাসিক হোটেল। তাই ফেনী জেলার একটি অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন বিজয় সিংহ দিঘীর পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে। এবং ভাল একটি টুরিস্ট ও পিকনিক স্পট হিসেবে এটি প্রসার লাভ করছে।