অ্যালোভেরা অতি পরিচিত একটি নাম আমাদের কাছে, যা বহু গুণে গুণান্বিত। ভেষজ উদ্ভিদ এর মধ্যে এলোভেরা যাকে বাংলায় আমরা ঘৃতকুমারী বলে থাকি তার ব্যবহার কিন্তু সেই আদি যুগ থেকেই হয়ে আসছে। সুপরিচিত এই উপকারী ভেষজ উদ্ভিদ এখন উৎপাদন হচ্ছে বাণিজ্যিক ভাবেও। যদিও এর বাণিজ্যিক ব্যবহার বাংলাদেশ এ নেই বললেই চলে তবুও ভেষজ উদ্ভিদ ফলনে ইদানীং অনেক বেশি জোড়ালো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, এর ই আওতাধীন এ এলোভেরা চাষ এ ও এগিয়ে আসছে কৃষক এবং টাঙ্গাইল এ ও বেশ কিছু জায়গাতে এর বাণিজ্যিক চাষে সফল চাষীরা।
অ্যালোভেরা সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে এর জেল এর কথা। প্রসাধনী থেকে শুরু করে জ্যুস সব ই আমাদের জন্য উপকারি। অনেকটা আনারস এর গাছের মত দেখতে এর পাতাতেও আছে কাটা এবং এটি প্রায় ৬০ থেকে ১০০ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। উত্তর-আফ্রিকা, আসলে উত্তর আফ্রিকার মরুভূমি অঞ্চল, মাদাগাস্কার ও কেরানিদ্বীপপুঞ্জ হলো এলোভেরার আদিবাস। এর নামকরণ করেন ক্যারলিনিয়াস। ৬০০০ বছর আগে মিশর থেকে এর উৎপত্তি শুরু হয়, এরপর থেকে আজকের অবস্থানে৷
লিলি গোত্রের এ গাছের পুরো পৃথিবী জুড়ে আছে ২৫০ টি প্রজাতি। বাংলাদেশ এ ২ প্রজাতির এলোভেরা চাষ করা হয়৷
এ যুগে এসে আমরা বাড়ির ছাদে, বারান্দায় কিংবা জমিতে বা উঠানেও এলোভেরা চাষ করা হয়। কিন্তু তারপর ও যথেষ্ট ব্যবহার নেই উপকারী এই উদ্ভিদ এর। এলোভেরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে হকারি পণ্য হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে বর্তমান সরকার বিভিন্ন উপজেলা তে ঔষধি গুণ সম্পন্ন গাছের সম্প্রসারণ এর লক্ষ্যে নিয়েছেন বিভিন্ন পদক্ষেপ। এই প্রজেক্ট এর আওতায় টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর এ ও ঔষধি গাছ সম্প্রসারণ লক্ষ্যে এলোভেরার বেশ কিছু প্রজেক্ট করা হয়েছে৷ মধুপুর এ অন্যান্য অনেক কৃষিজ পণ্যের পাশাপাশি এলোভেরার চাষেও সফল হয়েছেন চাষীরা।
টাঙ্গাইল এ সখীপুর এ মহিলা কলেজ রোড এ আছে একটি এলোভেরা বাগান। যেখানে কাজ করে হয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী ও স্বাবলম্বী। এক বাগান থেকে চারা, পাতা পাইকারি খুচরা সব ভাবেই সেল করা হয়৷ যার ফলে গ্রাহক থাকে সারাবছর ই। এই গ্রাহকদের আগ্রহের কারণেই এলোভেরা চাষ করে মন্টু রবিদাস আজ সফল এবং স্বচ্ছল।
এলোভেরা চাষে মূলধন লাগে কম। জমিতে তেমন সার এর ও প্রয়োজন নেই। জৈব সার দিয়ে জমি প্রস্তুর করে তবে চারা রোপন করতে হয়৷ অনেক চাষীরা প্রচুর ছাই ও ব্যবহার করে থাকেন। বছরের যে কোন সময় চারা রোপন করা গেলেও জুন বা আষাঢ় এর শুরুতে চারা লাগালে গাছ দ্রুত বাড়ে। এলোভেরা গাছের গোড়া থেকেই চারা বের হয় অনেক, সেই চারা লাগিয়ে আবারো শুরু হয় পাতা উৎপাদন৷ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ এর সময় অনেকেই মোথা কেটে বাদ দিয়ে পুরোনো চারা লাগান, এতে দ্রুত পাতা পাওয়া সম্ভব হয়৷ এক বিঘাতে গড় হিসাব করলে ২৫০ মন এলোভেরা পাওয়া সম্ভব যা থেকে বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হতে পারে।
চারা থেকে আয়, পাতা থেকে আয়, লাভ এর অংক টা শুধু এখানে সীমাবদ্ধ না। এলোভেরার উপকারীতা অনেক। এর মধ্যে এখানে কিছু তুলে ধরতে চাই৷ যেমনঃ
◑এলোভেরার পাতার ঠিক নিচেই থাকে হলুদ রঙ এর ল্যাটিস, যার নীচে থেকে আমরা পাই জেল৷ এই জেল এর জ্যুস হার্ট সুস্থ রাখে৷ রক্তের ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ এ থাকে, রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা ও কমিয়ে দেয়৷
◑যেকোন ব্যাথায় এলোভেরা জেল এর ক্রিম লাগালে ব্যাথা কমে যায়।
◑ত্বকের যত্নের কথা যদি আমরা বলি তবে বলতেই হয় যে এর এত্ত উপকারীতা যে বিউটি পার্লার হলো এলোভেরার রেগুলার ক্রেতা৷ এর মধ্যে থাকা এন্টি ইনফ্লামেন্টরি উপাদান থাকে যা ত্বকের অনেক ধরণের ইনফেকশন দূর করে।
◑দাঁত এর ইনফেকশন দূর করে, দাঁত এর ক্ষয়রোধ করে এলোভেরা৷
◑মুখের ঘা ভালো করে এলোভেরা জেল। মুখের দূর্গন্ধ দূর করে।
◑চুলের যত্নে এলোভেরার গুণ অত্যন্ত বেশি৷ ঝলমলে সুন্দর চুল সম্ভব এলোভেরার জেল ব্যবহার এর মাধ্যমে। মাথায় খুশকি দূর করে৷
◑এলোভেরা তে প্রায় ২০ রকম অ্যামাইনো এসিড আছে যা ইনফ্লামেশন এবং ব্যাকটেরিয়া রোধ করে৷ বুকে জ্বালাপোড়া কমে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে।
◑এছাড়া ও আমরা জানি যে এলোভেরা জেল খুব ই ভালো হাইলাইটার হিসেবে কাজ করে এবং এর জেল ত্বক উজ্জ্বল করে, চোখের নীচের কালি ও দূর করে৷
অনেক অনেক গুণ সম্পন্ন এ এলোভেরা অতি সুপরিচিত ও বটে, এরপর ও এর মার্কেট এত ছোট৷ বড় পরিসরে এলোভেরা বিক্রি হচ্ছে আমাদের দেশে সেই বাজার টা এখনো গড়ে উঠেনি। আসলে এলোভেরা রেখে খাওয়ার মত ও জিনিস না, কিংবা এর জ্যুস যে রেগুলার খাওয়া হবে সেই বাজার এখনো তৈরি হয়নি। যার জন্য অনেক সম্ভাবনাময়ী এ পণ্য এখনো মাথা উঁচু করে উঠতে পারছেনা অথচ এই পণ্যের অনেক সম্ভাবনা আছে, সম্ভাবনার এই দিকগুলোই শুধু তুলে ধরা প্রয়োজন।
তবে সেভাবে না ভাবলেও বা জানলেও সম্ভাবনার দিক ও আছে কিন্তু। যেমন অনেক হার্বাল ওষুধ কোম্পানির সাথে যদি চুক্তিবদ্ধ হওয়া যায় বা তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা যায় তবে তারা নিজে থেকে চাষীদের বাড়ি থেকে এসে এলোভেরার পাতা নিয়ে যান।
এলোভেরা থেকে শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, অন্যান্য সব ধরণের প্রসাধনী তৈরি হচ্ছে তবে হ্যা সেই ম্যানুফেকচার কোম্পানি আমাদের নেই বললেই চলে তাছাড়া আমরাও প্রসাধন সামগ্রী বলতেই যেন বিদেশী তে অভ্যস্ত। একদিনে বদলাবে না তবে বদল হবে এসব কিছুর ই ধীরে ধীরে সময় নিলে, উদ্যোগ নিলে, ছড়িয়ে দিলে এবং সম্ভাবনার কথা তুলে ধরলে।
তবে আশার কথা হচ্ছে ঢাকায় অনেক ওষুধ কোম্পানি আছে বা এলোভেরা প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশ পাঠায় এমন কোম্পানি আছে, যারা সরাসরি এলোভেরা রপ্তানি করে৷ যেহেতু তারা সরাসরি মাঠপর্যায়ের চাষীদের থেকে এগুলো সংগ্রহ করে তাই এটি বিশাল একটি সম্ভাবনা তৈরি করছে। চাষীরা লাভের মুখ ও দেখছে এবং আগ্রহ হচ্ছে এই সেক্টর এ। স্কয়ার, একমি, হামদর্দ সহ ছোট বড় মিনিমাম ১৫০ থেকে ২০০ কোম্পানি আছে যারা প্রতিনিয়ত এলোভেরা নিয়ে কাজ করছে। শুধু তাদের সাথে যোগাযোগ করার মত সেইরকম একটা মিডিয়া প্রয়োজন।
এমন একটি কোম্পানি হলো তাইওয়ান ফুড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, যার কথা না বললেই নয়, এটি ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত এবং এরা এলোভেরা রেগুলার প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করে তাইওয়ান, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তেয়াজ্য, আরব আমিরাতসহ ইউরোপ এর বিভিন্ন দেশে। এখানে দিনে ২০ থেকে ২২ মেট্রিক টন এলোভেরার চাহিদা থাকে কিন্তু পাচ্ছে রেগুলার ১৫ মেট্রিকটন। এই জায়গাতেই ঘাটতি আছে কত্ত এলোভেরার, যা খুব সহজেই সাপ্লাই দেয়া যায় চাষীদের থেকে। তবে তা তখন ই সম্ভব হবে যখন চাষীরা এই ব্যাপার টি জানবে।
এছাড়াও আরো কয়েকটি কোম্পানি থেকে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব৷ কুয়েত, কাতার, আবুধাবী, কোরিয়া, থাইল্যান্ড সহ আরো বিভিন্ন দেশ এ এলোভেরা পাঠানো হচ্ছে। প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫% হারে এর চাহিদা বেড়েও চলছে৷
যেহেতু দেশের ভেতরে এর মার্কেট ছোট, নাই বললেই চলে তাই চাষীরা এখনো এমুখী হচ্ছেনা। অথচ বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব এলোভেরা থেকেই কেননা এর চাহিদা অনেক বেশি।
এলোভেরার বাজার আছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজার ও তৈরি হবে তখন ই যখন এ সম্পর্কে মিডিয়া সোচ্চার হবে এবং প্রচার বাড়াবে। কেননা কোন চাষীরা ই বাজার ছাড়া পণ্য উৎপাদন এ আগ্রহী হয়না। এর জন্য প্রয়োজন কোম্পানির সাথে মাঠপর্যায়ের লোকেদের যোগাযোগ রক্ষার সুন্দর একটি মাধ্যম। যেহেতু ওষুধ এবং প্রসাধনী ইন্ডাস্ট্রি তে এর ব্যাপক প্রয়োগ আছে তাই এর রপ্তানি বাজার আরো বাড়বে এবং অভ্যন্তরীণ বাজার ও। টাঙ্গাইল এর বিভিন্ন উপজেলায় চাষীরা সফল হচ্ছেন এবং উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও যেহেতু সোচ্চার এ বিষয়ে তাই অনেকের মাঝে এর প্রসার, সচেতনতাবোধ এবং আগ্রহ তৈরি করতে বেশি বেশি প্রচার করা প্রয়োজন। ই-কমার্স সেক্টর এ এ নিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি হলে চাষী এবং কোম্পানী বা গ্রাহকদের মধ্যে সুন্দর সুষম যোগাযোগ তৈরি হবে অবশ্যই।