মনে পড়ে সেই বাচ্চাকালের কথা তখন সবে মাএ আমি ক্লাস নাইন।কোচিং শুরু সকাল সাতটা থেকে । আমার বাস থেকে স্কুলের দুরত্ব তখন তিন কিলোমিটার । গ্রামের স্কুল,এরই মাঝে আবার শরৎ শেষে কুয়াশা মুড়িয়ে চলে এসেছে শীতকাল । সকাল সাতটার কোচিং ধরতে আমি ভোর ছয়টায় নিয়ম করে তখনকার সময়ের বউটুপি ,সুয়েটার পড়লেও হাত দুটো যেনো আমার বরফ হয়ে আসে। বাজারের টং দোকানে দাঁড়িয়ে একটু চা পান করার সুযোগ আমাদের ছিলো না ,ওই যে গ্রাম বলে কথা।
কোচিং বা স্কুল যাই হোক না কেনো দেখতাম কোন মেয়েটা চাদর পড়েছে, হাত নিয়ে তার চাদরের ভেতরে দিতাম। আর বাসায় থাকলে তো দাদার সেই ইট কালারের টাংগাইল তাঁতের চাদরে আমার হাত বাঁধা থাকতো।
ক্লাস নাইন শেষে যখন নিউ টেন মা ও খালামনি তখন শীতে ৪ টা শাল কিনে নিয়ে আসে । দুটি উলের শাল ও দুটি টাংগাইল তাঁতের তৈরি ,যার নাম আমার অজানা। খুব পছন্দ করে আমি উলের শাল নেই । মা খুব বেশি যত্নেই আছে এখনও পর্যন্ত আমার কাছে। এখনও মাঝে মাঝে ব্যাবহার করি । তারপর প্রতিবছর শাল কিনলেও ওইটা ভালো লাগে ,কথায় আছে না ফাস্ট ইমপ্রেশন ইজ লাষ্ট ইমপ্রেশন ।
এই বছর কে উদ্যোক্তার নিয়েছেন এবছর শালের বছর হিসেবে । এই কথাটির ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে আমি পরিচিত হলাম প্রায় শতাধিক শালের নামের সাথে।যা একটা সময় স্বপ্ন ছিলো।এরই মাঝে নতুন কিছু নাম জেনেছি যেমন- জামদানি,খেশ,খালি,বম ,বাটিক ,কল্লা সহ বেশ কিছু শালের সাথে।
উপরের গল্প যেহেতু একজন টাংগাইল কন্যার তাই টাংগাইলের তাঁতে আসুন পরিচিত হই।
টাংগাইলের তাঁতে বোনা শাল
টাংগাইল শাড়ির সাথে টেক্কা দিয়েই এবার চাহিদা ও পরিচিতির পাল্লা ভারি করে এগিয়ে যাচ্ছে টাংগাইল শাল ।টাংগাইলের তাঁতে শাল তৈরির জন্য যে সুতা ব্যাবহার করা হয় তা বেশির ভাগই আমদানিকৃত। পরবর্তীতে যার রং করা হয় চাহিদা অনুযায়ী। সবকিছু সেক্রিফাইস করে দিলেও সেক্রিফাইস করা হয় না তার গুনগত মান ও আধুনিকতার সাথে। বিভিন্ন ধরনের ফিউশনে তাঁতিরা মন জয় করে যাচ্ছে সবার ।
টাংগাইলের তাঁত শালের নতুন দুটো ফিউশন রয়েছে হস্তশিল্পে ও হ্যান্ডপেইন্টে । আধুনিকতার ছোঁয়া দিতেই নিজেদের মতো ডিজাইনে করা শাল গুলো তৈরি করেছে উদ্যোক্তারা। দেশের মাটি ছেড়ে জায়গা করেছে বিদেশের মাটিতে এই শালগুলো।আর বিদেশে যাবেই না কেন বলুন,টাংগাইলের তাঁতে মে তাঁত শালের সাথেই তৈরি হচ্ছে আরও বিভিন্ন ধরনের শাল ।যেমন- দু’সুতি ,পাইর,কিরকিরি,নয়নতারা ও বহুরুপীসহ নানা ডিজাইনের শাল ।আফটার অল টাংগাইল শাল বলে কথা।
বাংলাদেশের অনলাইন মার্কেটপ্লেস এর জামদানি বলতেই আমরা জানি কাকলী এট্যায়ার কে । তাহলে জামদানি শাল ও কি এমন কিছুই হবে?
জামদানি শাল
আমরা আভিজাত্য বলতেই বুঝি জামদানি কে । বহুবছর জামদানি শাড়ির রাজত্ব চললেও নতুন করে নামডাক শুরু হয়েছে জামদানি শালের ।এতো দিন জামদানি শাল বাংলাদেশে তৈরি হলেও আমাদের অলসতার কারণে প্রচার হয়নি জামদানি শালের।
জামদানি শাড়ি বলতে আমরা নারায়ণগঞ্জ রুপগন্জ কে বুঝলেও শাল বলতে বুঝা যায় পার্বত্য জেলা গুলোকে। মনে আসে আদিবাসীদের কথা পার্বত্য জেলাগুলোর চাকমা জনগোষ্ঠী জড়িত জামদানি শালের সাথে।আদিবাসি রা জামদানি শাল বুনে থাকে বেইনে তা আমাদের ভাষায় কমড় তাঁত বলে।
জামদানি শাড়ির মতোই শাল বোনার কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে ,সুতার কাউন্টের হিসেব আছে ।জামদানি শাল অনেক বেশি আরামদায়ক ও শীত নিবারক হওয়ার মোষ্ট এক্সটেনসিভ কারণ হলো এখানে উল সুতা ব্যাবহার করা হয়।জামদানি শালের উল বাজার অথবা পুরাতন সুয়েটার থেকে সংগ্রহ করা হয়। বছর কয়েক আগে উল সুতা আলাদা রঙ করা হলেও এখন রঙ করার সমস্যা নেই আর
জামদানি শালের আলাদা কোনো ঝামেলা না থাকলেও সচেতন থাকতে হবে এখানে জামদানি শাড়ির মতোই । পরিস্কার করতে হবে শ্যাম্পু ব্যাবহার করে ,কেননা উল সুতার ব্যবহার রয়েছে এখানে।
জামদানি নাহয় পরিচিত ছিলো কিন্তু খেশ শাল আবার কোথা থেকে চলে আসলো বলুন তোহ!!
খেশ শাল
খেশ শাল বা শাড়ি যাই বলি না কেন আমরা এটার সাথে পরিচিত হয়েছি শুধুমাত্র আরিয়া’স কালেকশন এর নিগার ফাতেমা আপুর মাধ্যমে ।সত্যি বলতে এটাই যে খেশ আমাদের টাংগাইলের হলেও আমি পুরোপুরি অপরিচিত ছিলাম এসবের সাথে ।পুরাতন কাপড়ের ফালি থেকে তৈরি করা হচ্ছে শাড়ি ও সেই শাড়ি থেকেই নতুন সম্ভাবনা হয়ে এসেছে শাল ।
নিগার আপু বলেন খেশ শাল ব্যাবহারে যেমন কোনো ঝামেলা নেই তেমনি কোনো ঝামেলা নেই তার পরিস্কারের ক্ষেএও ।খেশ বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় একটা নাম ।এতো এতো ফিউশনে খেশ শাল তৈরি হচ্ছে তা একটা সময় হয়তো আমরা ভাবতেই পারিনি।খেশ শাল থেকেই উদ্যোক্তারা তৈরি করছে হ্যান্ডপেইন্ট শাল, হ্যান্ডস্টিজ শাল এবং এপ্লিক ।
আমরা সবসময়ই চাই নতুনত্ব ।তাই নতুনত্বের দিকে খেয়াল রাখতেই এসব নতুন নতুন ফিউশন ।
টাংগাইল জেলা কি শুধুই তাঁত শাড়ির জন্য বিখ্যাত ! না আমাদের টাংগাইল জেলা এতো এতো দিক থেকে এগিয়ে যা আমাদের অনেকেরই হয়তো অজানা ।যেমন আমি এখন লিখবো ধুপিয়ান শাল নিয়ে ।যা আমাদের টাংগাইলের তাঁতে বোনা ।
ধুপিয়ান শাল
ধুপিয়ান হাফ সিল্ক শাড়ি নিয়ে অনেক মাতামাতি থাকলেও শাল নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোক্তা এখনও চোখে পড়েনা। বর্তমানে নেট দুনিয়ায় এতো এতো কন্টেন্ট থাকলেও নেই ধুপিয়ান নিয়ে কোনো কন্টেন্ট ,যদিও শাল নিয়েই তেমন কোনো লিখা নেই । তাহলে ভাবুন একবার আমরা কতোটা পিছিয়ে রেখেছি আমাদের দেশ ও দেশের পণ্য গুলোকে।
ধুপিয়ান শাল ব্যাবহারের আরাম অন্যান্য শালের মতো। আলাদা কোনো ঝামেলা নেই , এমনও না যে সিল্ক কথা যুক্ত আছে বলে গায়ে দেওয়ার আগেই পড়ে যাবে ।এটা ব্যবহারে তেমন আরাম তেমনি প্রাইজ হাতের নাগালেই।
ধুপিয়ান শালকে পরিচিত করাতে এই দিকটায় তেমন কোনো উদ্যোক্তা না থাকায় আজ ধুপিয়ান শালের চাহিদা কমে গেছে ।যা আমাদের সবার জন্য ক্ষতির কারণ ,কেননা এই শাল গুলোই আমাদের দেশের ঐতিহ্য।
ধুপিয়ান শালের মতোই একটা কথা আসতে পারে বাটিক শাল নিয়ে।কেননা আমরা সবাই জানি বাটিক মানেই অনেক বেশি আরাম , অন্যদিকে গরমের জন্য পারফেক্ট একটা ড্রেস বাটিক । তাহলে শীতে বাটিক শাল কিভাবে আমাদের কভারেজ দিবে ।
বাটিক শাল
গরমে যেমন বাটিক ড্রেস আমাদের শান্তি দেয় তেমনি ভাবে শীতেও বাটিক শাল থাকবে আমাদের সঙ্গী হয়ে।তেজস্বীর স্বত্ত্বাধীকারী উম্মে সাহেরা এনিকা আপু বলেন ,বাটিক শাল নিয়ে ভয়ের কিছু নেই ,বাটিক শাল অনেক বেশি আরামদায়ক ও শীত নিবারক।
আমরা সবসময়ই তা নিয়ে খুব ভয়ে থাকি তা হলো যত্ন। এদিকটায় খুব বেশি সুবিধা বাটিকের যত্ন নিয়ে আমাদের আলাদা করে ভাবতেই হবে না।
বম শাল
নামটা শুনলেই কেমন আগুন আগুন লাগে না ? এই শালটা ব্যাবহারেও ঠিক এমনই আরাম শীতে ।বম শাল মূলত আদিবাসীদের তৈরি। পার্বত্য জেলা চট্রগ্রামের একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাম বম ।বম শাল আগে শুধুমাত্র পার্বত্য জেলায় তৈরি হলেও এখন ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন জেলায় । টাঙ্গাইল এ ও বম শাল তৈরি হচ্ছে।
এই শাল ব্যাবহারে অনেক বেশি আরামদায়ক ।কেননা এটা তৈরি করা হয় উলের চিকন সুতা দিয়ে ।দেখে সুতি সুতা বা ভিন্ন কিছু মনে হলেও এটা মূলত উলের সুতা ।ডিজাইন অসম্ভব সুন্দর হওয়ায় ছেলে-মেয়ে যেকেউ খুশি মনে ব্যাবহার করে এই শাল। কোমড় তাঁতে তৈরি করা এই বম শাল কনকনে শীতেও দেয় উষ্ণতা ।
সুয়েটার ছেড়ে এখন শালের তৈরি জনপ্রিয়তা বাড়ছে খুব বেশি পরিমাণে। রাজীব আহমেদ স্যার এ বছর কে শাল এর বছর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। যার কারণেই এই বছর কে বলা হচ্ছে দেশীয় শালের বছর। একটা সময় ছিলো যখন ইন্ডিয়ান ,চায়না যতো বিদেশি জিনিস ছিলো আমরা সেগুলোর প্রতি অন্ধ ছিলাম। বাংলাদেশের নাম নিলেই চোখ বন্ধ করে রাখতাম । কিছুদিন পর হলেও বাংলাদেশের ই কমার্স এসোসিয়েশন এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যারের পরিকল্পনায় আজ বাংলাদেশ আবারও ফিরে পেয়েছে তার দিন । লাভবান হচ্ছে দেশের অর্থনীতি সেই সাথে আমরাও রঙিন চশমা খুলে এখন উপভোগ করছি আমাদের দেশীয় পণ্য । এবারের শীতে সঙ্গী হোক দেশীয় শাল।
আমিনা আতকিয়া রিতা
স্বত্ত্বাধিকারী – অপরাজিতা -Oporajita