বাংলাদেশের একটি ছোট্ট জেলা ফেনী। এই জেলা ৬ টি উপজেলা দ্বারা বেষ্টিত। এবং প্রত্যেক উপজেলায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহি খাবার, দর্শনীয় স্থান, অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় প্রচুর শিল্পপন্য। ফেনী জেলার অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি উপজেলার নাম সোনাগাজি । এর আনাচে কানাচে রয়েছে অপার সম্ভাবনা । আজ চলুন ফেনী নদীর উপর স্থাপিত মুহুরি সেচ প্রকল্পের বর্ননা শুনি যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প হিসবে লিপিবদ্ধ। মুহুরি সেচ প্রকল্প বর্তমানে একটি দর্শনীয় স্থান যার রয়েছে প্রচুর পর্যটন সম্ভাবনা। মৎস চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মৎস জোন হিসেবে মুহুরি প্রকল্প এলাকা পরিচিতি পেয়েছে। এছাড়া দেশের প্রথম বায়ু বিদুৎ কেন্দ্রটি এখানে অবস্থিত।
মুহুরী সেচ প্রকল্পঃ-
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প মুহুরী প্রজেক্ট । এর অবস্থান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলায়। সোনাগাজি উপজেলা থেকে ২০ কি.মি দূরে মুহুরী প্রজেক্টে নির্মিত ৪০ গেইট বিশিষ্ট রেগুলেটর ও ক্লোজার ডেমটি বেশ আকর্ষণীয় ও সুন্দর।
এর নির্মান কাজ ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরে শুরু হয়ে
১৯৮৫-১৯৮৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
ফেনী নদী, মুহুরী নদী এবং কালিদাস পাহালিয়া নদীর সম্মিলিত প্রবাহকে আড়ি বাঁধ নির্মানের মাধ্যমে ৪০ ফোক বিশিষ্ট বৃহদাকার পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করা হয় যা বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমানো ও আমন ফসলে অতিরিক্ত সেচ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্য নির্মিত ।
সিডা, সিইসি ও বিশ্বব্যাংক অর্থ সহায়তায় জাপানের সিমুজু কোম্পানি ১৬৮ কোটি টাকা ব্যায়ে এই প্রকল্প নির্মান করে। এর ফলে ২০, ১৯৪ হেক্টর এলাকা সেচ সুবিধা এবং ২৭,১২৫ সম্পুরক সেচ সুবিধার আওতায় আসে।এবং এবছরের ফেব্রুয়ারিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় ডিজিটাল পানি ব্যাবস্থাপনায় যুক্ত হয়েছে মুহুরী সেচ প্রকল্প ।
মুহুরী প্রকল্প এলাকাটি শুধুমাত্র সেচ প্রকল্প নয় গত আড়াই দশকে এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি নয়াভিরাম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। মুহুরীর জলরাশীতে নৌকা ভ্রমনের সময় দেখা মিলে বিভিন্ন ধরনের হাঁস ও ৫০ জাতের হাজার হাজার অতিথি পাখির। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত মুহুরি প্রকল্পের বাঁধের দুপাশে পাথর দিয়ে বাঁধানো, নিচে জলরাশি উপরে ঘাসের নরম বিছানা সেই সাথে নানা পাখপাখালির কলকাকলীতে ভরপুর যে কোন ভ্রমনপিয়াসির মন ভরিয়ে দিবে অনাবিল আনন্দে।
নদীর পানিতে সূর্যাস্ত ও সূর্যদোয়ের অসাধারণ সৌন্দর্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। অন্যদিকে লোনা পানিতে চিংড়ির পোনা ধরার দৃশ্য সবার নজর কাড়ে। এখানে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। মুহুরির ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিকল্পিত ভাবে মাছ চাষ, দেশের প্রথম বায়ু বিদুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ডেইরি ফার্ম ইত্যাদি চোখ জুড়ানো ও মনে রাখার মত।
বায়ু বিদুৎ কেন্দ্রঃ-
বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদুৎ কেন্দ্রটি মুহুরি সেচ প্রকল্প থেকে ৫০০ গজ দূরে খোয়াজের লামছি গ্রামে অবস্থিত । বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নযন বোর্ড (পিডিবি) ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দেশের প্রথম বায়ু শক্তি চালিত বিদ্যুৎ ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বায়ু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এখানে স্থাপিত হয় বায়ু বিদ্যুৎ এর চারটি টারবাইন। বিদুৎ জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে ২০১৪ সালে এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎতের পরিমান ছিল ২ লাখ, ২৪৩৯ ইউনিট। এবং গড় উৎপাদন ছিল ১৬৮৩০ ইউনিট।
প্রকল্প এলাকার পাশ দিয়ে ফেনী নদী বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে৷ মুহুরী প্রকল্পের নদী ও সূর্যাস্তের দৃশ্যতে নতুন মাত্রা যোগ করে এই বায়ুকলগুলো। গোধূলির শেষ আলোর অপরুপ সৌন্দর্য সেই সাথে উইন্ডমিলের উপস্থিতি মিলে মিশে অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা করে যা এই স্থানের পর্যটন সৌন্দর্য কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয় । তাই মুহুরি প্রকল্পে গেলে সূর্যাস্ত না দেখে ফেরাটা একদমই ঠিক হবেনা।
মৎস প্রকল্পঃ-
দেশের সবচেয়ে বড় মৎস জোন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে মুহুরি প্রকল্প। স্থানীয়দের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এটি মৎস চাষ প্রকল্প রুপে বিপ্লব ঘটিয়েছে । আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে মাছ চাষ করা হয়। এছাড়া দেশের অনেক অনেক নামি-দামি প্রতিষ্ঠান বানিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এখানে রয়েছে প্রায় দু হাজার মৎস প্রকল্প। প্রতিদিন প্রায় ১০০ টনের মত মাছ চাষ এই এলাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যায়। অঞ্চলের মানুষ শতভাগ মাছের চাহিদা পূরন করে মুহুরী প্রকল্প থেকে।
গত আড়াই দশকে মুহুরী সেচ প্রকল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিনোদন ও পিকনিক স্পট। শীত মৌসুমে ঘুরে আসার মত একটি সুন্দর স্থান এই মহুরী এলাকা। এবং মুহুরী সেচ প্রকল্প শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নয় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে নির্মল বাতাস ও নদীর জলের দৃশ্য দেখতে ছুটে আসে। এছাড়া এলাকাটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলে হওয়াতে এর নৈসর্গিক শোভা মনমুগ্ধকর। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠলে কোটি টাকা রাজ্বস আয় করা সম্ভব বলে স্থানীয়দের দাবী ।