তিসি এক সময়ের খুব ই জনপ্রিয় তেল ও আঁশ উৎপাদনকারী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ৷ আমাদের দেশে মূলত তিসির চাষ হয় এর বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল এর জন্য৷ অতি উপকারী এই তিসি আমাদের কাছে কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে সুপরিচিত হলেও আমাদের পরের প্রজন্ম হয়তো এর নাম ই শুনেনি। অথচ তিসি এতটাই উপকারী যে একে সুপারফুড ও বলা হয়। কালের পরিক্রমায় অনেক এলাকা থেকে বিলীন হয়ে গেলেও এই সুপারফুড টাঙ্গাইল এর কিছু জায়গায় এখনো আবাদ করা হয়৷
আমার মা র মুখে শুনেছি যে তিসির তেল বেবিদের জন্য খুব হেল্পফুল এবং এজন্য আগে অনেকের বাড়িতে ই এই তেল থাকতো৷ তিসির তেল শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই ব্যবহার করতো৷ খাওয়া হতো৷ তিসির শুধু তেল না তিসির নাড়ু অত্যন্ত মজার একটি খাবার৷ এছাড়া তিসি খাওয়া হয় সালাদ এ৷ ফাস্টফুড এ ও এর ব্যাপক ব্যবহার করা হয়৷ এছাড়া তিসির পাউডার যেমন উপকারী তেমনি তিসি ভিজিয়ে সেই পানির রস টা ও শরীরের জন্য খুব ভালো৷ আর তিসির চা সে তো অনেক জটিল সব রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে আমাদের।
খাদ্য হিসেবে যেমন তিসির অনেক গুণ তেমনি তিসির যে ফাইবার তা আমাদের পাট এর ফাইবার এর মতই ব্যবহার উপযোগী৷ আমাদের দেশে তিসির ফাইবার ব্যবহার না হলেও অন্যান্য অনেক দেশে তিসি পাটের মতই জাগ দিয়ে আঁশ বের করা হয় এবং তা থেকে যে সুতা পাওয়া যায় যা দিয়ে উন্নতমানের লিনেন বস্ত্র তৈরি করা হয়৷
ইভেন শুধু এগুলোই না বার্নিশ, পেইন্ট এর কাজের একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় তিসির তেল এবং আর্টিফিশিয়াল চামড়া ও ছাপা কারখানা তে ও তিসির তেল একটি অপরিহার্য উপাদান।
গ্রীষ্মমন্ডল ও উপগ্রীষ্মমন্ডল বিভিন্ন দেশে তিসি আবাদ করা হয়। অনেক দেশে তিসির ফাইবার এর লিনেন বস্ত্রের জন্য এর অনেক চাহিদা থাকলেও প্রাচীনকালে মূলত তিসি আবাদ করা হতো এর বীজ থেকে যে তেল পাওয়া যায় তার জন্য৷ এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এ সবথেকে বেশি তিসি চাষ হতো এবং তা আঁশ উৎপাদন এর জন্যই ব্যবহার করা হতো৷ এখন তিসি থেকে উন্নতমানের আঁশ পাওয়া যায় বেলজিয়াম ও তার আশেপাশের দেশগুলো থেকে।
আমাদের দেশের ও প্রায় সব জেলাতেই আগে তিসি চাষ হতো এখন সে সংখ্যাটা ধীরে ধীরে শুধু কমে ই যাচ্ছে৷ তিসির কথা আসলেই বিশেষ যে কটা জেলার নাম উঠে আসে তার মধ্যে টাঙ্গাইল অন্যতম। তবে এটাই বাস্তবতা যে অন্যান্য সব জেলার মত টাঙ্গাইল এও এই চাষ কমতে শুরু করেছে। তবে আমাদের জন্য আশার কথা এটা ই যে আমাদের ভুয়াপুর এর চরাঞ্চল এবং গোপালপুর এর কিছু জায়গায় এখনো তিসি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে এখানকার চাষী রা৷
একটা সময় যমুনার আশেপাশে কিছুই চাষ হতোনা। বিস্তীর্ণ চরগুলো ধু ধু করতো শূন্যতায়৷ যমুনা সেতু হওয়ার ফলে সেতু সুরক্ষাতেই যেহেতু বাঁধ দেয়া হয়েছে তাই টাঙ্গাইল এর ভুয়াপুর, কালিহাতি বিশাল এলাকা জুড়ে জেগে উঠেছে চর। এই চর গুলো অনেক বছর আগে পরে থাকলেও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যেমন চর এর আকার বাড়ছে তেমনি এখানকার চাষীরা ও আবাদ এর পরিমাণ বাড়াচ্ছে। এখানে যা আবাদ হয় তাই এরা আবাদ করে শুষ্ক মৌসুমে। যমুনার কারণে যারা বাস্তুহারা হয়েছে তারা এইসব অঞ্চলে জনবসতি গড়ে তুলেছে সাথে চাষের উপযুক্ত করে তুলেছে হাজার হাজার হেক্টর জমি।
বাংলাদেশ এ যে তিসির যে জাত টি আবাদ করা হয় তা মূলত ১৯৮৮ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন প্রাপ্ত। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বর এর মাঝামাঝি তে রোপন করলে ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ এর দিকে ফসল ঘরে তোলা যায়৷ প্রতি হেক্টর এ ফলন হয় ৮৫০ থেকে ৯৫০ কেজি। ১০০ থেক ১১৫ দিনেই ঘরে উঠে যায় ফসল৷
ভুয়াপুর এর প্রায় ৪০হাজার হেক্টর জুড়ে জমিতে এখানে বসবাসকারীরা ফসলের আবাদ করছেন।ধান, পাট, গম, মসুর, মাসকলাই, বাদাম্মরিচ, ভুট্টা, খেসারি, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, তিল কালোজিরা, আঁখ সব কিছুর পাশাপাশি এখানে এখনো চাষ হচ্ছে তিসির। যদিও কমেছে এর পরিমাণ তবুও এ এলাকার চাষীরা এখনো তিসিকে প্রাধান্য দেয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তিসির আবাদ হয়েছিলো মোট ৩,৩০০ হেক্টর জমিতে এবং ফলন হয়েছিলো ৩,৪০০ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৮০ হেক্টর এ এবং উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭০০ টন। এই কমার ধারাবাহিকতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে তিসির আবাদ হয় মোট ২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে এবং ফলন কমে আসে ২,৩৯১ হেক্টরে। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিলোনা কেননা তিসি সত্যিকার অর্থেই আমাদের শরীর স্বাস্থ্যের জন্য ও অনেক উপকারি একটি পণ্য।।
তিসির উপকারিতাঃ
তিসির উপকারিতার শুরুতেই বলতে চাই তিসি কেন সুপারফুড?
কারণ তিসিতে অন্যান্য খাবার এর থেকে ৮০০ গুণ বেশি লিগন্যানস থাকে। এর বীজ যদি সারারাত ভিজিয়ে সকালে খাওয়া যায় কিংবা ব্রেকফাস্ট এর সাথে দই বা যেকোন সিরিয়াল এর সঙ্গে খেলে অনে উপকার পাওয়া যায়৷
সবথেকে বেশি উপকার পাওয়া যায় এর ফ্ল্যাকসিড থেকে৷ ডায়বেটিস রোগীদের ইনসুলিন নিয়ন্ত্রনে এটা খুব ই কার্যকরী, এখানের ফাইবার গুলো অদ্রবণীয় অবস্থায় থাকে তাই রক্তে শর্করার মাত্র কমায়৷
তিসির বীজ এমাইনো এসিড, আর্জিনিনিন এবং গ্লুটামাইন সমৃদ্ধ যা সবগুলোই হার্ট ভালো রাখার উপাদান।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন এ রাখতে তিসির চা জাদুকরী প্রভাব ফেলে।
বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার এর ঝুঁকি কমায়৷
ত্বক এর জন্য যেমন তিসি খুব ভালো তেমনি চুল এর জন্যও তিসি খুব ই কার্যকর সমাধান দেয়।
তিসির আরেকটি দারুণ উপকার হচ্ছে রেগুলার খাওয়ার পর কেউ যদি একটু করে তিসি চাবায় তবে তার যেকোন নেশা জাতীয় দ্রব্য যেমন তামাক বা অন্য কিছু থেকে মুক্তি মেলতে পারে৷।
এছাড়া ও গ্যাস্ট্রিক আলসার এর জন্য খুব ই উপকারী এই তিসি।
তিসি ভেজে গুড়া করে সেই পাউডার রাতে বা সকালে খেলে যেমন উপকার পাওয়া যায় তেমনি সারারাত ভিজিয়ে পরদিন সকালে সেই রস ও খেলে উপকার পাওয়া যায়৷
এত এত উপকার এর পর ও এর উৎপাদন না বেড়ে বরং উলটো কমে যাচ্ছে। কি হতে পারে এর কারণ?
প্রথমত প্রচার না থাকায় এমন অবস্থা হয়েছে যে এর চাহিদা দিন দিন কমতে শুরু করেছে। চাহিদা না থাকলে চাষীরা আগ্রহী হয়না। কেননা দিনের পর দিন ফসল ফেলে রাখা তাদের জন্য বাড়তি চাপ ও লসের মুখ দেখতে হয় ব্যাপার টা তো আছেই।
উন্নতমানের বীজ নেই। বাংলাদেশ এ একটি জাত উদ্ভাবন হয়েছে কিন্তু তারপর ও সব মিলিয়ে মুনাফা গুণতে পারেনা চাষীরা।
বাজারজাতকরণ ও অনেক বড় ধরণের সমস্যা হয়েছে তিসির জন্য।
আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে চাষীরা অধিক লাভের আশায় স্বল্পকালীন ফসল চাষে মন দিয়েছেন বেশি যাতে করে এক জমিতে তিন বা চার টা ফসল তারা পেতে পারে সেগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে৷ তিসির জায়গা নিয়ে নিচ্ছে তাই উন্নতজাতের অন্য কোন ফসল।
লসের মুখ দেখতে চায়না কেউ ই৷ এটা দোষের না৷ কিন্তু তাই বলে এভাবে ঐতিহ্যেবাহী এত সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো হাড়িয়ে যাবে ব্যাপারটি মেনে নেয়া মানেই সম্ভাবনাকে দমিয়ে রাখা।
সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে৷ অবশ্যই উন্নত জাত উদ্ভাবন এর চেষ্টা করতে হবে যাতে করে অধিক ফলন আসে, মুনাফা বাড়ে।
বাজার বড় করার চেষ্টা করতে হবে, কেননা আমরা সবাই জানি যে বাজার সৃষ্টি করা সহজ না হলেও বাজার তৈরি হওয়া মানেই অনেক অনেক ক্রেতাদের আগ্রহের জন্ম হওয়া, ক্রেতা থাকলেই সেই পণ্যের বিক্রেতাদের জোগাব দেয়ার ইচ্ছা ও থাকে বেশি, আবাদের দিকেও নজড় দেয় তারা।
সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকে এখন কেমিক্যাল মুক্ত ন্যাচারাল সোর্স এর দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে। সেদিক থেকে তিসি আমাদের খুব ই সম্ভাবনাময় পণ্য ঔষধ হিসেবেও, তেল হিসেবেও এবং পুষ্টিদিক বিবেচণাতেও৷ অবশ্যই যদি বেশি প্রচার করা যায় তবে এদিকে উদ্যোক্তার সংখ্যা ও বেড়ে যাবে সাথে রক্ষা হবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী উপকারী একটি পণ্য।