ইতিহাসের পথরেখায় সংবাদ আদান-প্রদানে ডাক সেবার অভিযাত্রা সাড়ে চার হাজার বছর আগে থেকে। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া হয়ে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পথ হেঁটে অগ্নিশিখা সংকেত, শিকারি কবুতর পাঠিয়ে কিংবা ঘোড়ার পিঠ রানারের ঝুলির যুগ থেকে স্যামুয়েল মোর্সের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি টরে-টক্কার যুগ অতিক্রম করেছে পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠানটি। হাজার বছরের বৈশ্বিক বিবর্তনের পথ বেয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি যুগে ডাক সেবা আজ প্রবেশ করছে। সংবাদ আদান-প্রদানে প্রাচীনতম এ মাধ্যমটি সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আজও তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে সগৌরবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে চিঠির যুগ শেষ হয়ে গেলেও ডাক সেবার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি বরং উত্তরোত্তর এর প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলেছে এর বহুমাত্রিক ডিজিটাল সেবা প্রদানের বদৌলতে-উদ্ভাবনের হাত ধরেই আগামীর ডিজিটাল শিল্পবিপ্লবের পৃথিবীতেও ডাক সেবার প্রয়োজনীয়তা অব্যাহত থাকবে।
ডাক সেবা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়নের উদ্যোগে প্রতি বছর ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের বের্নে ২২টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক পোস্টাল ইউনিয়ন। ইউনিয়ন গঠন করার মাহেন্দ্রক্ষণটি স্মরণীয় রাখতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৯৬৯ সালে ৯ অক্টোবরকে বিশ্ব ডাক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ) এবং আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্য পদ অর্জন করে। এরপর থেকে দেশে প্রতি বছর বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব ডাক দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলো Innovate to recover বা পুনরুদ্ধারে উদ্ভাবন।
কভিড-১৯ অতিমারির কবল থেকে টিকা উদ্ভাবন বিশ্বকে রক্ষা পেতে সহায়তা করেছে। কভিড সংকটের শুরুতে উদ্বেগ ছিল অতিমারি মোকাবিলায় টিকা উদ্ভাবতি হতে অনেক বছর সময় লাগবে। কিন্তু ব্যক্তি সংস্থা সর্বোপরি বিজ্ঞানী গবেষকদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় এক বছরের মধ্যে এই টিকা উদ্ভাবিত হয়েছে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের নতুন আশা জাগিয়েছে। এই উদ্ভাবন কীভাবে মহামারি থেকে মানুষকে রক্ষা করেছে, তা আন্তর্জাতিক ডাক খাত অনুকরণ করতে পারে। সেদিক থেকে এ বছরের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়েছে।
ডাক সেবার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৮৪০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ডাকটিকিট ব্যবহার করা হয় ব্রিটেনে। তার এক যুগ বাদে ভারতীয় উপমহাদেশে ডাকটিকিটের প্রথম ব্যবহার শুরু হয় ১৮৫২ সালে তৎকালীন সিন্ধুপ্রদেশের কমিশনার স্যার বার্টেল ফেরির হাত ধরে। ওই ডাকটিকিটের নাম ছিল ‘সিন্ডে ডক’। বছর দুয়েক ওই ডাকটিকিট চলার পর গোটা উপমহাদেশজুড়ে এক অভিন্ন ডাক ব্যবস্থা চালু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ওই ডাকটিকিটে ছিল কুইন ভিক্টোরিয়ার ছবি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের সব ডাকটিকিটই হয় কুইন ভিক্টোরিয়া অথবা তার উত্তরসূরিদের ছবি বহাল থাকত। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ডাক সেবার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আমরা কেবল অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করিনি। সংস্কৃতিকর্মী, খেলোয়াড়, সাধারণ জনগণ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমেও আমাদের যুদ্ধটা হয়েছে। ডাকটিকিটেও সেই লড়াইয়ের অংশীদার। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই ভারতীয় নাগরকি বিমান মল্লিকের (বিমান চাঁদ মল্লিক) ডিজাইন করা আটটি ডাকটিকিট মুজিবনগর সরকার, কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। মুজিবনগর সরকার কূটনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার জন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ করে।
একাত্তরের ২৯ জুলাই মুজিবনগর সরকার এবং যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স থেকে প্রকাশিত ৮টি স্মারক ডাকটিকিট বিশ্বে আমাদের জাতিসত্তা, রাষ্ট্রসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই দিবসটি কেবল ডাক অধিদপ্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালনের যৌক্তিকতা আছে। স্মারক এ ডাকটিকিটগুলো কেবলই ইতিহাসের ধারক ও স্মারক নয়। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যা সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে ডিজিটাল কমার্সযুক্ত করায় ডাক বিভাগ নতুনরূপে আবির্ভূত হচ্ছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি বর্তমান বিশ্বকে একটি গ্লোবাল হাউসে পরিণত করেছে। প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডাক সার্ভিসকে লাগসই প্রযুক্তিতে রূপান্তর করার বিকল্প নেই। দেশে দশ হাজার ডাকঘরে প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ডাক সেবায় নিয়োজিত। চল্লিশ হাজার মানুষের আশি হাজার হাত এবং দেশব্যাপী ডাকঘরের বিস্তীর্ণ অবকাঠামো ও নেটওয়ার্ক জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল সাম্য সমাজপ্রতিষ্ঠায় উপযোগী শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে ডাকঘরকে ডিজিটাল করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক পুরোনো প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির অনেক ত্রুটি ও পশ্চাৎপদতা আছে। বিদ্যমান পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠতে ডাক অধিদপ্তরে সব কার্যক্রম ডিজিটাল করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অবিসংবাদিত রাজনীতিক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার চলমান সংগ্রাম সফল করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের দিকনির্দেশনায় ডাক অধিদপ্তর সনাতনী পদ্ধতি থেকে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। ডিজিটালাইজেশন কর্মসূচির ফলে ডাক অধিদপ্তরে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ডিজিটাল মানিঅর্ডার, পোস্টাল ক্যাশকার্ড এবং ডিজিটাল কমার্স ইত্যাদি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। দেশে ৮ হাজার ৫০০ ডাকঘরকে ডিজিটাল ডাকঘরে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় দেশের তৃণমূল জনগোষ্ঠী সরকারের ২০০ ডিজিটাল সেবা পাচ্ছে। দেশব্যাপী ডাকঘরের সুবিশাল নেটওয়ার্ক ডিজিটাল কমার্সে নিয়োজিত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ব্যবহারের জন্য নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর ফলে দেশব্যাপী দ্রুতসময়ে শাকসবজিসহ পচনশীল পণ্য পরিবহন ও বিতরণ সম্ভব হবে। এই লক্ষ্যে ডাক পরিবহনের গাড়ি ও দেশের ৬৪টি জেলায় শর্টিং সেন্টারে হিমায়িত চেম্বার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এর ফলে দেশে ডিজিটাল কমার্সের বিকাশে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। ডিজিটালাইজেশনের ধারাবাহিকতায় এক সময়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়া ডাকঘর আজ জনগণের কাছে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে গড়ে উঠেছে। কভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক অতিমারিতে থেমে যাওয়া জীবনযাত্রায় ডাকঘরের বিস্তীর্ণ পরিবহন নেটওয়ার্ক ও বিশাল অবকাঠামো মানুষের সেবায় কাজে লাগানো হয়েছে। বিনা মাশুলে কৃষকের সবজি, আম, লিচুসহ উৎপাদিত কৃষিপণ্য এবং কভিড চিকিৎসা সরঞ্জাম দেশের প্রতিটি জেলায় পৌঁছে দিয়ে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ এবং এর প্রয়োগের ফলে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান ডাক বিভাগ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ডাকঘরকে ডিজিটাল ডাকঘর হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিদ্যমান জনবলকে ডিজিটাল উপযোগী করে গড়ে তুলতে উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়।
ডিজিটাল কমার্স করোনাকালে লকডাউনে কেনাকাটা সচল রেখেছে এবং আগামী দিনগুলোতে ডিজিটাল কমার্সের চাপ অনেক বেড়ে যাব। ডিজিটাল কমার্স শহরের পণ্য যেমন গ্রামে যাবে ঠিক, তেমনি গ্রামের পণ্য শহরে আসবে। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে ডিজিটাল কমার্সের ব্যাপক সক্ষমতা গড়ে তোলা সম্ভব। এই ক্ষেত্রে ডিজিটাল ডাকঘরের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ডিজিটাল সক্ষমতা তৈরি করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বছর বিশ্ব ডাক দিবসের একটি বড় চমক হচ্ছে দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বসেরা পত্র লেখককে সংবর্ধনা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ডাক অধিদপ্তর। বিশ্ব ডাক সংস্থা ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ) আয়োজতি ৫০তম পত্র লিখন প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক লাভ করেছে সিলেট আনন্দ নিকেতন বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নুবায়শা ইসলাম। আইভরিকোস্টের শহর আবিদজানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ৫০তম আন্তর্জাতিক চিঠি লেখন প্রতিযোগিতায় (এলএলডব্লিউসি) জয়ী হয়েছে কিশোরী নুবায়শা ইসলাম। নুবায়শা তার ছোট বোন আমলের উদ্দেশ্যে চিঠিটি লিখেছিলেন। গত ২৭ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বিজয়ী চিঠি লেখকের নাম ঘোষণা করে এলএলডব্লিউসি। করোনাভাইরাসের মহামারিতে পরিবারের একজন সদস্যের প্রতি চিঠিÑএই প্রতিপাদ্যে লেখা চিঠি ক্যাটেগরিতে জয়ী ঘোষণা করা হয় নুবায়শা ইসলামকে। নুবায়শার এই অর্জনে উৎফুল্ল বাংলাদেশ। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ‘এটি আমাদের মেধার বিশ্বস্বীকৃতি’ বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।