সম্পদের নতুন উৎসের সন্ধান, প্রযুক্তিগত মান সম্পন্ন নতুন পণ্যের উদ্ভাবন ও বিকাশ এবং তা ব্যবহারের বিকল্প নেই।উদ্যোগ নিলে মধুপুরের মতো চট্টগ্রামে ও গড়ে উঠবে অপার সম্ভাবনা। মধুপুরে আনারসের পাতার আঁশ থেকে নানা পণ্য উৎপাদনে সুতা তৈরির প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলছে।
শুধু আনারস নয় আনারসের আঁশে ও রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভবনা আর সম্ভাবনাময় একটা জেলা চট্টগ্রাম। কেননা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর পরিমাণে আনারস জন্মে।আর এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ উন্নয়ন ও রফতানি আয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম চট্টগ্রামের আনারসের উচ্ছিষ্ট যা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে অনস্বীকার্য।
আনারসের পাতার আশ থেকে তৈরী হয় দামী সুতা-কাপড়। বিদেশে আনারসের সূতায় বোনা একটি শাড়ীর দাম ৩০ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার অধিক দেশের অনেক স্থানে আনারসের পাতা থেকে তৈরী হচ্ছে অর্গানিক সুতা। এক মন আনারসের পাতা থেকে প্রায় ৪ কেজি সুতা দামী অফসেট কাগজ, আর্ট পেপার। শুধু তাই নয়, আনারসের বর্জ্য থেকে তৈরী হবে ক্ষার, ডিটারজেন্ট পাউডার।
আনারসের তৈরী সুতা দিয়েই সম্ভবনার দ্বার খোলা সম্ভব । আর সেই সুতায় বোনা শাড়ী, পাঞ্জাবী, শার্ট, টপস অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে দেশে বিদেশে।দেশের আনারসকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। আনারসকে কেন্দ্র করে স্থাপন করা যেতে পারে বৃহদাকারের খাদ্য ও বস্ত্র শিল্প।
সম্প্রতি আনারসের পাতা থেকে আঁশ ছাড়িয়ে তৈরি হচ্ছে সুতা। আর সেই সুতাতে কাপড় বুনে চমক দেখিয়েছে বেসরকারি সংস্থা মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি)। ফিলিপাইনসহ আরো কয়েকটি দেশে আগেই এ ধরনের উপাদান থেকে সফলভাবে কাপড় তৈরি সম্ভব হলেও বাংলাদেশে এ নিয়ে গবেষণা ও সাফল্য এটাই প্রথম।
প্রকল্পটির প্রধান গবেষক বলেন, গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারলে এ ধরনের কাপড়ের ভালো বাজার পাওয়া সম্ভব। ইতিমধ্যে কানাডার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের এ কাপড়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে বলেও জানান তিনি। আনারসের পাতার আঁশ নিয়ে তাদের গবেষণাটি শুরু হয় ২০০৬ সালে। প্রথমে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় কাজ শুরু হলেও পরে প্রকল্পটি নিয়ে আসা হয় ময়মনসিংহ শহরে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রফিকুল ইসলাম নিজেই তৈরি করে নেন।
আনারসের পাতা ও কলাগাছের খোল থেকে কেমন আঁশ হয় প্রথম দফায় সেটিই পরখ করে দেখেন তিনি। এ কাজে তিনি বিভিন্ন টেক্সটাইল এবং স্পিনিং মিলের কর্মকর্তাদের সহায়তা নেন। এরপর এমসিসি’র জব ক্রিয়েশন কর্মকর্তা ইকবাল হাসান ও রিচার্ড জয়ন্ত সরকারের উৎসাহে ফিলিপাইনে যান এ প্রযুক্তির ওপর আরো বিস্তারিত ধারণা নিতে। ২০০৯-এর মাঝামাঝি রফিকুল এ আঁশ থেকে কাপড় তৈরিতে সাফল্য পান। এমসিসির ময়মনসিংহ কার্যালয়ে কলাগাছ আর আনারসের পাতার আঁশ দিয়ে তৈরি যে কাপড় সাজিয়ে রাখা হয়েছে, তা দেখলে রেশম ও খদ্দরের মিশেলে তৈরি বলে মনে হতে পারে।
আপাতত শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়ার মতো কাপড় তৈরি করছে এমসিসি। এ কাপড় তৈরির জন্য আনারসের পাতা । বিশেষ প্রক্রিয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে সেগুলো থেকে বের করে আনা হয় আঁশ। সেই আঁশ পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে ‘ক্লিন’ করে তৈরি হয় তুলার রোল। এরপর স্পিনিং মেশিনে ফেলে তৈরি হয় সুতা। সেই সুতাতেই তাঁতের সাহায্যে তৈরি হয় এসব কাপড়। এমসিসির মার্কেটিং বিভাগ শিগগির কাপড়ের মূল্য নির্ধারণ ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে।
উৎপাদিত এ কাপড়ের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা প্রসঙ্গে গবেষক প্রধান বলেন,’কয়েকটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এ কাপড়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। আরো কয়েকটি দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ চলছে। তবে আপাতত আমরা কাপড়ের গুণগত মানোন্নয়নের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। এজন্য মধুপুরে অত্যাধুনিক স্পিনিং মেশিন বসানো হয়েছে। মান সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছলেই আমরা রপ্তানির উদ্যোগ নেব।’
আনারসের পাতা হতে আঁশ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত এবং উৎপাদিত আঁশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরির কৌশল, দক্ষতা অর্জন এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নসহ পণ্য বাজারজাতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা- জ্ঞান লাভ এ প্রশিক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য।
‘কৃষিজ বর্জ্য হতে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক আঁশ থেকে উৎপন্ন পণ্যের মান উন্নয়নের মাধ্যমে নারীদের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন’- স্লোগানের এ প্রকল্প পরিচালনা করছে বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই)।
নারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে দক্ষ করার লক্ষ্যে।প্রশিক্ষণকালেই অংশগ্রহণকারী নারীরা বিভিন্ন আকর্ষণীয় পণ্য যেমন হাতব্যাগ, ভ্যানিটিব্যাগ, গহনার বাক্স, ওয়ালম্যাট, টিস্যু বক্স, কলমদানি, হ্যাট, নারীদের বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার ইত্যাদি তৈরি করছে।
এ জাতীয় কৃষিজ বর্জ্য থেকে প্রাকৃতিক আঁশ ও সুতা উৎপাদন করে পরিবেশসম্মত পোশাক ও হস্তশিল্প উৎপাদনের মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের রফতানি আয় বৃদ্ধির অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বৃহৎ পরিসরে আনারসের পাতা থেকে সুতা ও কাপড় তৈরির মাধ্যমে দেশের আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে তার জন্য প্রয়োজন এই খাতের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু হস্তশিল্প সম্প্রসারণের জন্য দেশের চারটি ইউনিট অফিসের মাধ্যমে ২ হাজার সংগঠিত এসএমই নারী সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলছে। তিনটি ইউনিট অফিস নরসিংদী, টাংগাইল ও গাইবান্ধায় অবস্থিত এবং ওই তিনটি ইউনিটে কলাগাছ থেকে আঁশ সংগ্রহ করা হয়। এরই মধ্যে প্রশিক্ষণের মাঝপথ অতিক্রম করেছে মধুপুর ইউনিট।
বিক্রয়যোগ্য পণ্য উৎপাদন ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা এবং নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যগুলো উপযুক্ত ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর ওপরই নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট নারীদের স্বপ্ন।এতে বাড়বে কর্মসংস্থান, হবে বেকারত্ব নিরসন আর অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
রাহাত সোলতানা
স্বত্বাধিকারী-অভিরুচি বুটিকস