তথ্য থেকে জানা যায়,বেলগাঁও চা বাগানটির প্রতিষ্ঠার সঠিক তথ্য কারও জানা নেই, লোকমুখে জানা গেছে যে ১৯১২ সালে ইংরেজরা বাগানটি শুরু করেন তখন বাগানের ম্যানেজার ছিলেন হিগিন।বাঁশখালী উপজেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকারী পর্যটন এলাকা দক্ষিণ চট্টগ্রামের আলোচিত বাঁশখালীর বেলগাঁও চা বাগান। এটি উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়নে চাঁদপুরে অবস্থিত। ২০২০ সালের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশের ১৬৭টি বাগানের মধ্যে গুণে মানে ৫ম স্থানে রয়েছে এই বাগানটি।
তথ্য মতে, বাঁশখালী উপজেলার লট হল ও লট চাঁনপুর মৌজায় অবস্থিত চাঁদপুর বেলগাঁও চা বাগানটি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে মালিকানার অনুপস্থিতিতে অব্যবস্থাপনার সম্মুখীন হয়। ক্রমান্বয়ে বাগানের অধিকাংশ জমি স্থানীয় অধিবাসীদের অবৈধ দখলে চলে যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রায় বাহাদুর জমিদারের মালিকানায় ছিল। জমিদার রায় বাহাদুরের জন্ম ছিল কু পরিবারে। তাই এই বাগান পূর্বে কু- চা বাগান নামে খ্যাত ছিল।
১৯৬৫ সালের একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে বাগানটি অর্পিত চা-বাগানসমূহের চিফ কাস্টডিয়ান চা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত করা হয়। পরবর্তীতে এনিমি প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট বোর্ড গঠিত হলে বাগানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইপিএমবির ওপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর মিনিস্ট্রি অফ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্স কর্তৃক ১৯৭২ সালের ৯ মার্চ একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তৎকালীন ইপিএমবির ব্যবস্থাপনাধীন আরও কতিপয় চা-বাগানসহ চাঁদপুর বেলগাঁও চা-বাগানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পরিত্যক্ত চা-বাগানগুলো পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ চা-বোর্ডের আওতায় গঠিত বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ওপর ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু ইপিএমবি ও বিটিআইএমসি কোনো প্রতিষ্ঠানই চায়ের অস্তিত্ববিহীন এ বাগানটির বেদখলীয় জমির দখল উদ্ধার করে চা-চাষাবাদ করতে পারেনি।
১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর বাগানটি পরিত্যক্ত ছিল। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ প্রকল্প চালু করার উদ্দেশ্যে বাগানটির বাস্তব দখল চা বোর্ডের নিকট হস্তান্তরের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিকট আবেদন জানায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় ১৯৮৫ সালের ৭ এপ্রিল ৮-৪২০/৮৪ নং পত্রে বাগানটির দখল চা বোর্ডের নিকট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্বকে) নির্দেশ প্রদান করেন। তখন চা বোর্ড প্রায় ৮ একর জমির ওপর চা চাষ শুরু করে। অতঃপর মাত্র ৮ একর চা বাগানটি বাংলাদেশ চা বোর্ড ১৯৯২ সালের ৫ মে স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র অনুযায়ী চাঁদপুর বেলগাঁও চা বাগানটি ব্যবস্থাপনার জন্য রাগীব আলীর স্বত্বাধিকারী বাঁশখালী টি কোম্পানির নিকট হস্তান্তর করেন।
অতঃপর ২০০৩ সালে বাঁশখালী টি কোম্পানির সমুদয় শেয়ার ক্রয় করে ব্র্যাক এবং কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর বিধান অনুযায়ী এ কোম্পানিকে ব্র্যাক বাঁশখালী টি কোম্পানি লিমিটেড নামকরণ করা হয়। ব্র্যাক চা বাগানটির মালিকানাস্বত্ব গ্রহণ করার পর ২০০৪ সালে চা কারখানা চালু করে। অতঃপর চাঁদপুর বেলগাঁও চা বাগানের মালিকানা ব্র্যাক বাঁশখালী টি কোম্পানি লিমিটেডের নিকট থেকে গত ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর থেকে সিটি গ্রুপ পরিচালিত ফজলুর রহমান গংয়ের ভ্যান ওমেরান ট্যাংক টার্মিনাল (বাংলাদেশ) লিমিটেড এবং ইন্টারন্যাশনাল ওয়েল মিলস্ লিমিটেড ক্রয় করেন।
বর্তমানে প্রতিদিন কর্মকর্তাসহ ৭ শতাধিক শ্রমিক এ চা বাগানে তাদের শ্রমের মাধ্যমে নতুন পাতা উৎপাদন, ট্রেসিং থেকে শুরু করে সামগ্রিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাঁশখালীর চা সারা দেশে মানের দিক দিয়ে সু-খ্যাতি অর্জন করেছে। গত অর্থ বছরে চা উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ছিল ৩ লাখ ৬ হাজার কেজি। আগের লক্ষ্যমাত্রা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় ২০২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। চলতি বছরে নতুন করে আরও প্রায় ৩ লাখ ৪ হাজার নতুন চারা রোপণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ।বাঁশখালী উপজেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকারী পর্যটন এলাকা দক্ষিণ চট্টগ্রামের আলোচিত বাঁশখালীর বেলগাঁও চা বাগান।
মধুপুর চা বাগান, খৈয়াছড়া চা বাগান, ক্লিফটন চা বাগান ও কর্ণফুলী চা বাগানের পরেই মানের দিক থেকে এখানের উৎপাদিত চায়ের যেমন রয়েছে পুষ্টিগুণ, তেমনি এ বাগানের উৎপাদিত চায়ের কদর রয়েছে দেশজুড়ে।২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী দেশের ৫ম স্থানে থাকলেও কাটিং, পাতার কোয়ালিটি, গুণগতমানসহ ভালো দামের জন্য চট্টগ্রামে বাগানটির অবস্থান ৩য় স্থানে। শীতের হিমেল হাওয়ার শেষে প্রকৃতিতে বসন্তের আগমনী বার্তায় বর্তমানে চা বাগানে কচিপাতা গজাতে শুরু করেছে। বাঁশখালীর সর্ব উত্তরে পুকুরিয়া ইউনিয়নের উঁচু নিচু পাহাড়ি এলাকায় ৩ হাজার ৪৭২.৫৩ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই চা বাগানটিতে রয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
উঁচু-নিচু ও ঢালু পাহাড়ে নারী-পুরুষ চা শ্রমিকরা চা বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করে। কেউ কেউ গাছের বীজতলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। চা বাগানের ম্যানেজার বলেন, এই বাগানের চা পাতার সুখ্যাতি রয়েছে সারাদেশে। এ কারণে দেশের যতসব চা বাগান রয়েছে, বাঁশখালীর চা বাগানের পাতা মানের দিক দিয়ে ৫ম স্থানে রয়েছে। এই মানের জন্য চা বাগানের কর্মরতরা প্রতিদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
উৎপাদন যত বৃদ্ধি পায় সরকার রাজস্ব তত বেশি পায়। বর্তমানে চা পাতার বিক্রির অর্থ থেকে সরকার ১৫% হারে ভ্যাট পান।
চির সবুজের বিশাল বিচরণ ক্ষেত্র বেলগাঁও চা-বাগানটি দেশের অর্থনীতিতে যেমন ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তেমনি ধীরে ধীরে সেরা পর্যটন স্পটের জায়গা হিসেবে দখল করে নিচ্ছে দর্শনীয় স্থানটি। মন কাড়া এই চা-বাগানে উঁচু নিচু পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে চা-গাছ আর চা-গাছ। এই ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান চা-বাগানে হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড় জমে। আধুনিক পর্যটন স্পট হিসেবে সারা দেশে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে বাগানটি। বিশাল চা বাগানের মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে নানা শ্রেণির মানুষ ছুটে আসে।