“বাটালী হিল” নাম শুনলেই যেন “বাটালি গুড়” এর কথা মনে পরে। বাটালি হিল এর সাথে বাটালি গুড়ের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তার সঠিক ব্যাখ্যা জানা নেই। তবে আপনি জেনে অবাক হবেন যে, জিলাপির সাথে ‘বাটালি হিল’ এর এক দারুণ সম্পর্ক রয়েছে।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পাহাড়, “বাটালি হিল” স্থানীয় জনসাধারণের কাছে ‘জিলাপি পাহাড়’ নামে পরিচিত। বাটালী হিলের চূড়ায় উঠার রাস্তাটি জিলাপির মত পেঁচানো হওয়ার কারণেই এই পাহাড়ের এমন নাম দেওয়া হয়েছে।
বলা বাহুল্য,বাটালি পাহাড় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকার ইস্পাহানী মোড়ের উত্তরে অবস্থিত। ইস্পাহানী মোড়ের উত্তরে ফাহিম মিউজিকের পাশ ঘেষেই বাটালী হিলের রাস্তা। এইখান থেকে জিলাপির মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে রাস্তাটি।
তবে বাটালি হিল এর একেবারে সর্বোচ্চ চূড়াটি দর্শন করতে হলে চট্টগ্রামের টাইগারপাস মোড় দিয়েই পাহাড়ে যাওয়া উত্তম। টাইগারপাস হতে পশ্চিম দিকে আমবাগান এলাকার দিকে যাওয়ার রাস্তাটি ধরে কিছুটা পথ হেঁটে গিয়ে ডান দিকে মোড় নিলেই একটি পাহাড়ি রাস্তা চোখে পরবে। স্থানীয় জনগণকে জিজ্ঞেস করে ওই রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে খাড়া পাহাড় বেয়ে সরাসরি বাটালি হিল এর চূড়ায় উঠা যায়। এটাই মূলত প্রকৃত বাটালি হিল, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাটালী হিলের উপরে একটি কামান স্থাপন করা হয়। এবং এই স্থান হতে পুরো চট্টগ্রাম শহর দেখা যায়।
তবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটালে চাইলে কিংবা প্রকৃতির পূর্ণ সৌন্দর্য অনুভব করতে চাইলে ইস্পাহানী মোড়ের উত্তরে ফাহিম মিউজিকের পাশ ঘেষেই যে রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়েই পাহাড়ে উঠা উত্তম। এখান থেকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার অনুভূতি অন্য রকম। জিলাপির মত পেঁচানো আঁকা বাঁকা রাস্তা, দুপাশে ঘন পাহাড়ি জঙ্গল… এই রাস্তা ধরে পাহাড়ে উঠার সময় যেন মনে হবে দৈত্যকৃতির গাছগাছালি ঘেরা এই বন আপনাকে গিলে খাচ্ছে। জিলাপির প্রতিটা প্যাঁচ অর্থাৎ পাহাড়ের প্রতিটা রাস্তার মাঝে আছে খাঁড়া সিঁড়ি। দ্রুত পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে চাইলে এই সিঁড়িগুলো বেয়ে উঠা যায়, আর ধীরে ধীরে উঠতে চাইলে জিলাপির মত পেঁচানো রাস্তা ধরেই উঠা যায়। তবে রাস্তা ধরে উপরে উঠতে হলে তুলনামূলক বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। সিঁড়ির পথগুলো হলো শর্টকাট। এই পথ পাড়ি দেয়ার সময় মাঝপথে বিশ্রামের জন্য অনেকগুলো স্থায়ী বেঞ্চ রয়েছে। বেঞ্চ ছাড়াও সিঁড়ি কিংবা রাস্তার ধারে বসেও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অনুভব করা যায়।
এই পথ ধরে উপরে উঠতে উঠতে একেবারে সর্বোচ্চ যে চূড়াটি রয়েছে তার নাম “শতায়ু অঙ্গন”। তবে এই চূড়া থেকে কিন্তু পুরো চট্টগ্রাম শহরকে দেখা যায়না। এই অঙ্গনে একটি মঞ্চ রয়েছে, যেখান নানান সময় নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এখানে বসারও সুব্যবস্থা রয়েছে। অধিকাংশ মানুষই এই স্থান ঘুরে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু মূল বাটালী হিলের যে চূড়া, তা দর্শন করার জন্য এই শতায়ু অঙ্গন এর পাশ ঘেঁষা সিঁড়ি ধরেই তুলনামূলক কম গাছপালাসমৃদ্ধ পাশের আরেকটি ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হয়। এটিই মূলত ঐতিহ্যবাহী বাটালি হিল এর চূড়া। এখান থেকেই পাখির মত পুরো চট্টগ্রাম শহরকে এক নজরে দেখা যায়।
শুধু তাই নয়, এই স্থান হতে বঙ্গোপসাগরে সূর্যাস্তের শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। অনেক অনেক বছর আগে এই স্থানে একটি বাতিঘর স্থাপন করা হয়েছিলো দূর সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের দিক নির্দেশনার জন্য। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই চূড়াটিতেই একটি কামান স্থাপন করা হয়েছিলো।
চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হলো এই বাটালি হিল। এর উচ্চতা প্রায় ২৮০ ফুট। বাটালি পাহাড়ে জলপাই, কাঁঠাল, কালোজাম, লিচু, কমলা, আম, জাফরান, চন্দন, কফি, অর্জুনের মতো বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় সাড়ে ১২ হাজার গাছ রোপণ করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। বর্তমানে এই পাহাড় বাংলাদেশ গণপূর্ত বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পাহাড়ের চূড়ায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অফিস ও বাংলো রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগের পাশাপাশি বিশুদ্ধ অক্সিজেন সেবনের জন্য প্রতিদিন অনেক মানুষ এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠার অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন।
জুলিয়া আফরোজ
সত্ত্বাধিকারী – বর্ণিল রঙ্গন