খাদি বা খদ্দর উপমহাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। হাজার বছরের ইতিহাস থাকলেও খাদি মূলত পরিচিতি পায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়। এটি প্রাকৃতিক আঁশ থেকে তৈরি একটি তন্তু।
প্রথমদিকে খাদি কাপড় ছিল মূলত সুতি। তবে দুই ধরনের খাদি তৈরির উল্লেখ পাওয়া যায় অনেক যায়গায়।
১. সুতি সুতার উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি খাদি যাকে বলা হয় সুতি খাদি এবং
২. সিল্কের উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি খাদি যাকে বলা হয় এন্ডি সিল্ক বা খাদি সিল্ক।
এছাড়াও পাতলা এবং মোটা দুই ধরনের খাদি তৈরি হয়ে থাকে। খাদি একটি বহুমুখী ফেব্রিক্স র্অথা গ্রীষ্মকালে শীতল এবং শীতকালে উষ্ণ। যার ফলে সারা বছর খাদি কাপড় ব্যবহারের জন্য উপযোগী।
ইতিহাসে খাদি: ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় খাদির হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে এবং সেখানে বিদেশি অনেক বণিক উপমহাদেশে ভ্রমণে এসে খাদির কথা তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন যার মধ্যে অন্যতম হলো চীনা বণিক হুয়ান সাং এবং ইতালিয়ান বণিক র্মাকো পোলো। ১২শ শতাব্দীতে র্মাকো পোলো খাদি সর্ম্পকে তার লেখায় উল্লেখ করেন যে, বাংলার খাদি মাকড়সার জালের চেয়েও মিহি। রোমানরাও বাংলার খাদির প্রতি আকৃষ্ট ছিল।
মধ্যযুগেও বাংলা থেকে মিহি খাদি রোমান সাম্রাজ্য রপ্তানি করা হতো। মোগল আমলে কুমিল্লার তাঁতিদের হাতে তৈরি বুনা খাদি মূল্যবান টেক্সটাইল হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। খাদি জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখতে বা প্রচারের জন্য মহাত্মা গান্ধী যেমন সব সময় খাদি দিয়ে তৈরি ধুতি এবং শাল পরতেন তেমনি ১৯৪২ সালে রাজনৈতিক র্কমী সুহাসিনী দাস আজীবন খাদির পোশাক পরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
খাদির নামকরণ: সাধারণত খাদ থেকে তৈরি হয় বলেই এর নামকরণ করা হয় খাদি। তবে এই নামকরণ নিয়ে অনেকের অনেক ভিন্ন মত রয়েছে। প্রথমদিকে খাদি চরকায় সুতা কেটে তৈরি করা হতো এর জন্য খাদের
প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দেশে যখন কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায় তখন মাটিকে র্গতে করে খাদ বানিয়ে তাতে পায়ে চালিত প্যাডেল দিয়ে খাদি কাপড় তৈরি
করা হতো যেন দ্রুত কাপড় উ পাদন করা যায়। যার ফলশ্রুতিতে র্বতমানে খাদি নামটির উপত্তি। অনেকে আবার খদ্দর শব্দটিকে গুজরাটি শব্দ হিসেবেও উল্লেখ করেন।
কুমিল্লা জেলা ও খাদি: ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লার চান্দিনাউ পজেলায় আসেন স্থানীয় তাঁতিদের অনুপ্রাণিত করার জন্য। সে সময়’ নিখিল ভারত তন্তুবাই সমিতির’ একটা শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয় যা কুমিল্লা জেলায় তৈরি খাদি রপ্তানি করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। যার ফলে খাদির চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। খাদির এই চাহিদাকে ধরে রাখতে ১৯৫২সালে ভাষা আন্দোলনের পরে ত কালীন কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়াকলেজের অধ্যক্ষ ও র্বাডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান ও গর্ভণর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় ‘ দ্য খাদি এন্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। সে সে সময় কুমিল্লার অভয়াশ্রম, চট্টগ্রামের প্রর্বতক সংঘ এবং নোয়াখালী গান্ধী আশ্রমেখাদি কাপড় বুনা হতো। চান্দিনাতে ড. আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য
খাদি কো-অপারেটিভ এসোসিয়েশন লিমিটেডের’ হাল ধরেন চান্দিনার শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ। বাবার মৃত্যুর পরে ছেলেই খাদি শিল্পকে আকড়ে
রেখেছেন। চান্দিনায় এখনও মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত তাঁতশিল্প রয়েছে। খাদি শিল্প আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৪ সালে যার পেছনের কারন ছিল কুমিল্লায় তৈরি গুনগত মান সম্পন্ন খাদি। র্বতমানে কুমিল্লার দেবিদ্বার, মুরাদনগর ও চান্দিনায় সবচেয়ে বেশি খাদি বুনা হয়।
খাদিতে আধুনিকতার ছোঁয়া: র্বতমানে খাদিতে অনেক পরির্বতন এসেছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নানা ডিজাইনের পোশাক তৈরি হচ্ছে। সেই সাথে খাদির রঙে এসেছে পরির্বতন। বিভিন্ন সুতার মিশ্রণে এখন খাদি তৈরি হয়। যেমন: সুতি, রেশম, সিল্ক, মুগ, তসর, উল ইত্যাদি। যার ফলে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের খাদি পোশাক তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। খাদি দিয়ে তৈরি শাড়ি, পাঞ্জাবী, থ্রি – পিস, টু-পিস, র্শাট, র্কুতা, টপ্স, শাল
ইত্যাদি এখন দেশীয় পোশাকের মধ্যে অন্যতম। এছাড়া ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে খাদিতে আরও ভেরিয়েশন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে যা আগামীর খাদি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
খাদি শিল্পের প্রচারে বিভিন্ন উদ্যোগ: হাজার বছরের এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন এর সঠিক প্রচারণা। যার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। খাদি নিয়ে মেলা, সেমিনার, শিক্ষাঙ্গনে খাদির প্রচারণায়
ই-কর্মাস ক্লাবের র্কাযক্রম, কাস্টমার মিট-আপ, জাতীয় র্পযায়ে খাদির ব্যবহার ইত্যাদি উদ্যোগুলো খাদির প্রচারে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খাদির প্রচারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ
করা যেতে পারে। সম্ভাবনা এই শিল্পের অগ্রযাত্রায় প্রয়োজন নীতির্নিধারণী র্পযায়ে সহযোগিতা। আমরা আশাবাদী আগামীতে খাদি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ
গ্রহণ করা হবে যা এই শিল্পের ভবিষ্য কে উজ্জ্বল করতে সাহায্য করবে।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট