এক সময় ফোনের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ফিনল্যান্ডের নকিয়ার। তখনও স্মার্টফোনের যুগ শুরু হয়নি। নকিয়া কিপ্যাডযুক্ত সিমব্রিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের ফিচার ফোন দিয়ে বাজার দখল করে রেখেছিল। কিন্তু অ্যানড্রয়েডের যুগ শুরু হলে বাজার হারাতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। তখন নকিয়া কিনে নেয় মাইক্রোসফট। বাজারে আসছে মাইক্রোসফটের মোড়কে নকিয়ার স্মার্টফোন।
উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম চালিত ওই ফোন ক্রেতারা তেমন একটা গ্রহণ করেনি। ফলে আবারও মুখ থুবড়ে পরে নকিয়া। নকিয়ার হাতবদল হয়। এখন এইচএমডি গ্লোবাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই ফোনের উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটি চাইছে ফিচার ফোন দিয়ে হারানো বাজার ফেরাতে। আর তাইতো একের পর এক ফিচার ফোন আনছে।
অনেকেরই জীবনের প্রথম মোবাইল ফোন ছিল নকিয়া। তখন হয়তো সবে সবে কলেজে ঢুকেছেন কিংবা পা দিয়েছেন চাকরিক্ষেত্রে। আশপাশের জিনিসপত্র তখনও এত স্মার্ট হয়নি। সে সময় মোবাইলের বাজার একচেটিয়া দখলে রেখেছিল ফিনল্যান্ডের এই সংস্থাটি।
মনোফোনিক রিংটোন, সাদা কালো স্ক্রিন থেকে ক্রমে অল্প অল্প বুদ্ধিমান হচ্ছিল সে সময়ের মোবাইল ফোন। কালার স্ক্রিন থেকে পলিফোনিক রিংটোন, টি-৯ পেরিয়ে ক্রমে মোবাইলে যুক্ত হল ক্যামেরা থেকে কোয়ার্টি কি বোর্ড। ক্রমশ আরও স্মার্ট হতে লাগল সময়।
অ্যানড্রয়েডের হাত ধরে স্মার্টফোন-ভুবনে পা রাখল বিশ্ব। ততদিনে বাজারের দখল নিতে শুরু করল একাধিক চীনা মোবাইল প্রস্তুতকারক সংস্থা। স্যামসাং এবং আইফোনের দাপটে ক্রমে ছিটকে গেল নকিয়া।
উইন্ডোজের হাত ধরে স্মার্ট হলো নকিয়া : ২০০৭ সালে মোবাইল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ৪৯.৪ শতাংশ বাজার দখল করে রেখেছিল নকিয়া। ২০১৩ সালে তা নেমে এল ৩ শতাংশে। এ সময় বাজার ধরতে অন্য নীতি নিল মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি। বাকি সংস্থাগুলো যখন অ্যানড্রয়েডের পেছনে দৌঁড়চ্ছে, নকিয়া তখন ধরল মাইক্রোসফটের এর হাত।
লুমিয়া ব্র্যান্ডের আওতায় একের পর উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম যুক্ত মোবাইল বাজারে আনতে শুরু করল সংস্থাটি। দিব্যি জনপ্রিয়তাও পেতে শুরু করেছিল তারা। চড়া রং, উজ্জ্বল ডিসপ্লে, উন্নত মানের ক্যামেরা আর তার সঙ্গে সুপার স্মুত সফটওয়ার এক্সপিরিয়েন্স। ফের নকিয়া ব্যবহার বাড়ছিল।
সাম্রাজ্যের পতন : তবে সেই সংখ্যাটা বাজারে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল না। স্টিভ জোবসের হাত ধরে যখন প্রথমবার আত্মপ্রকাশ করল আইফোন। সেসময় ৫১.০৬ বিলিয়ন ইউরোর ব্যবসা নকিয়ার। আর সেই বিপুল সাম্রাজ্যে ধ্বস নামতে বেশি সময় লাগল না। ক্রমশ নামতে নামতে ১১.৭৬ বিলিয়ন ইউরোতে এসে ঠেকেছিল নকিয়া।
শেষপর্যন্ত মাইক্রোসফটের কাছে ৭ বিলিয়ন ডলারে স্মার্টফোনের ব্যবসাই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় নকিয়া।
উত্থান ফিনিক্সের : ২০১৬ নাগাদ ফিনল্যান্ডের একটি মোবাইল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এইচএমডি গ্লোবাল ঘোষণা করে, নকিয়াকে ফের বাজারে ফেরত আনতে চলেছে। আর সেই এইচএমডি গ্লোবালের হাত ধরেই ফের বাজারে ফিরল নকিয়া নস্টালজিয়া। আর উইন্ডোজ নয়। এবার অ্যানড্রয়েড ফোন বিক্রি শুরু করল প্রতিষ্ঠানটি।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত প্রায় ২০ বিলিয়ন ইউরোর আশেপাশে বিক্রি করেছে এইচএমডি গ্লোবালের আওতায় নকিয়া। তবে এত এত স্মার্টফোনের দুনিয়ায় ফের বাজার ধরা এতটাও সহজ ছিল না তাদের পক্ষে।
দেরিতে হলেও শেষপর্যন্ত এই বিশাল মোবাইল মার্কেটে শেষপর্যন্ত নিজেদের ইউনিক সেলিং পয়েন্টটি খুঁজে পেয়েছে নকিয়া। তাই অ্যানড্রয়েডের পাশাপশি বেসিক ফিচার ফোন তৈরির দিকে ফের ঝুঁকেছে প্রতিষ্ঠানটি। যা একদিন তাদের পৌঁছে দিয়েছিল সাফল্যের শীর্ষে। আসলে প্রযুক্তির সঙ্গেই আসে প্রযুক্তির যন্ত্রণাও।
অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোনের দৌলতে যেমন বিশ্বের দরজা খুলে গিয়েছে ইউজারদের সামনে, তেমনই বেড়েছে ডেটা-নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নও। এদিকে নেটব্যাংকিংয়ের যুগে মোবাইল নম্বরের সঙ্গে ব্যাংকের সংযুক্তিকরণও বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে সাইবার জালিয়াতির ঝুঁকি এড়াতে ব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত মোবাইল নম্বরটি বেসিক ফোন থেকে ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন বহু সাইবার বিশেষজ্ঞই। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ছে বেসিক ফোনের চাহিদা। কেউ সুরক্ষার খাতিরে, কেউ বা শুধুই নস্টালজিয়ায় ডুব দিতে ঝুঁকছেন বেসিক মোবাইল সেটের দিকে।
ফিচার ফোনের বাদশা : আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতে স্মার্টফোনের তুলনায় অনেক বেশি ফিচার ফোন বিক্রি করছে নকিয়া। তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে অন্তত ১৬টি ফিচার ফোনের অপশন রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ৩৩১০ এবং ৬৩১০ জনপ্রিয় মডেল।
নকিয়ার অফিশিয়াল ক্যাটালগে স্মার্টফোনের সংখ্যা মাত্র ৮টি। তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, বাজারভর্তি অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে ভাবনাচিন্তা করেই ফিচারফোন বিক্রির স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে নকিয়া। আর সেখানে ভালোই ব্যবসা করছে প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি।