ইতিহাসের নিকৃষ্টতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার কনিষ্ঠপুত্র শিশু শেখ রাসেল। মাত্র ১০ বছর ১০ মাস বয়স। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। মাত্র কয়েক ঘন্টা পর স্কুল ড্রেস পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার কথা ছিল তার। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাবেন সমাবর্তনে যোগ দিতে। তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেবে ল্যাবরেটরি স্কুলের শিশুরা। সারাদেশ অপেক্ষায় ছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হবার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোর রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ঘাতকরা সপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। শেখ রাসেল অশ্রুসিক্ত কন্ঠে মিনতি করে বলেছিলেন, ‘মায়ের কাছে যাব’। বর্বর ঘাতকরা তান্ডব শেষে ঠাণ্ডা মাথায় হাসতে হাসতে গুলি করে হত্যা করে শিশু রাসেলকে। অথচ তাঁর তখন রাজনীতি ও পৃথিবী সম্পর্কে বুঝে ওঠার মতো বয়স হয়নি ।
পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, যেবছর একমাত্র বিরোধীদল হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করেন বঙ্গবন্ধু; সেই ১৯৬৪ সালেই জন্ম নেয় শেখ রাসেল। তখন হেমন্তকাল, সময়টা ছিল ১৮ই অক্টোবর। নবান্নের নতুন ফসলের উৎসবে আগমন নতুন অতিথির। এ যেন বাঙালির আনন্দ, বাংলার আনন্দ। ধানমন্ডির সেই ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর রোডের বাসায় শেখ হাসিনার ((আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) কক্ষেই রাত দেড়টায় জন্ম হয় শেখ রাসেলের। রাসেলের আগমনে পুরো বাড়ি জুড়ে বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে শিশু রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রচিত ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে লিখেছেন, “রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিল রাসেল।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত। তাঁর বই তিনি পড়তেন। বার্ট্রান্ড রাসেল কেবলমাত্র একজন দার্শনিকই ছিলেন না বিজ্ঞানীও ছিলেন। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্ব নেতাও। বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্যে বার্ট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন— “কমিটি অব হানড্রেড”। শেখ রাসেলের জন্মের দু’বছর পূর্বে ১৯৬২ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেফ-এর মধ্যে স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছিল। যেটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। তাঁর নামানুসারেই বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখা হয় রাসেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে লিখেছেন, “আব্বা বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখলেন।”
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ৭৫’র ১৫ আগস্ট দশটি বছর শেখ রাসেলের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বঙ্গবন্ধুর এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার পথে অগ্রযাত্রা, আর রাসেলের বেড়ে ওঠা- সমান্তরাল পথচলা। বাঙালি জাতির জেগে ওঠা এবং মুক্তিসংগ্রামের প্রতীকী শিশু শেখ রাসেল। রাসেলের জীবনের প্রথম সাত বছর মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে ব্যস্ত পিতার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত ছিল। রাস্ট্রপতির ছেলে হয়েও নিজের সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেত। রান্নাঘরে গৃহকর্মীদের সাথে বসে ভাত খেতে পছন্দ করতো। নিজের হাতে খাবার দিত পোষা কবুতরকে। মুরগি জবাই হলে রক্ত দেখে ভয় পেত। নিবিষ্টমনে অংক কষতো গৃহশিক্ষিকার কথা মতো। টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার সময় গ্রামের বন্ধুদের জন্য পোশাক নিয়ে যাওয়ার বায়না ধরতো।
রাসেলের জন্মের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে নানান কারণে জেলবাস করতেন। তাই শিশু রাসেলের বাবার সান্নিধ্য পাবার সুযোগ খুব কমই হয়েছে। রাসেলের সব থেকে প্রিয় সঙ্গী ছিলো তার হাসুপা (আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা)। তার সমস্ত সময় জুড়েই ছিলো মা আর হাসুপা। শৈশবে শেখ রাসেল বাবাকে যখনই কাছে পেতেন সারাক্ষণ তার পাশে ঘোরাঘুরি করতেন। খেলার ফাঁকে ফাঁকে বাবাকে এক পলকের জন্য হলেও দেখে আসতো। এরই মধ্যে জন্ম হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়ের। জয়কে পেয়ে তো রাসেল মহাখুশি। সে তার খেলার নতুন এক সঙ্গী পেয়েছে। সারাটা সময়জুড়েই জয়ের সাথে মেতে থাকতো রাসেল। রাসেলের মাছ ধরার খুব শখ ছিল, কিন্তু সে মাছ ধরে আবার তা পুকুরেই ছেড়ে দিত। এতেই সে মজা পেত। বঙ্গবন্ধুর বাসায় একটি পোষা কুকুর ছিল টমি নামে। ছোট্ট রাসেল টমিরও সাথে খেলতো। এভাবে কেটে যাচ্ছিল শেখ রাসেলের দিন।
সময়টা ১৯৭৫, আগস্টের কিছুদিন আগে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বামীর কাছে জার্মানি চলে যাবেন। সাথে বোন শেখ রেহানাও যাবে। অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে রাসেলকেও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন রাসেলের শরীরের অবস্থা খুব ভালো ছিলো না, তার জন্ডিস ধরা পড়েছিলো। তাই সেদিন আর রাসেলের হাসুপা’র (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ) সাথে যাওয়া হয়নি। আর এটাই হয়তোবা শিশু রাসেলের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে একদল বিপদগামী তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাসভবন ঘিরে ফেলে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতার পরশ মেখেই নির্মল শৈশবের বাসন্তী হাওয়ায় এক দুরন্ত প্রাণবন্ত শিশুর বেড়ে ওঠা শিুশু রাসেলকে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক চক্রের ষড়যন্ত্রে অকালে প্রাণ দিতে হলো। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ছোট্ট রাসেলের দোষ কী ছিল জানেন? তার পিতা বাংলা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। হাজার বছরের দাসত্বের শৃংখল থেকেই বাঙালি জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে পরাজিত উগ্রবাদী শক্তি। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার জন্য নির্মমভাবে খুন করে শিশু রাসেলকেও। যুগে যুগে ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতকদের হাতে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এই পৃথিবীতে। কিন্তু শিশু রাসেলকে যেভাবে পিতা-মাতা ভাই ভাবিদের রক্তভেজা লাশের পাশে নিয়ে পৈশাচিক উল্লাস করেছে খুনিরা, এমন নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড আর কোথাও ঘটেনি।
রাসেল বেঁচে থাকলে আজ শেখ রাসেলের বয়স হত ৫৯ বছর। আমরা এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে চিন্তা করছি। তিনিও বেঁচে থাকলে হয়তোবা সামিল হতেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে। ভিশন ২০২১, ২০৪১, ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে তার বোন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মাননীয় আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয় এখন যেমন দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন, বেঁচে থাকলে তিনিও নিঃসন্দেহে নিজেকে দেশের জন্য নিয়োজিত রাখতেন। তিনিও হয়তো জাতির পিতার মতো বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার কাণ্ডারী হতেন। কিংবা হতে পারতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের মতোই স্বমহিমায় উজ্জ্বল বিশ্বমানবতার প্রতীক। শিশু রাসেল-কে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা মানব সভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ করেছে। এ ধরনের নিষ্ঠুর ‘মার্সি কিলিং’ শুধু রাসেলের জীবনকেই কেড়ে নেয়নি, সেই সঙ্গে ধ্বংস করেছে তার সব অবিকশিত সম্ভাবনাকেও।
শেখ রাসেল চিলেন প্রাণচঞ্চল, বন্ধু বৎসল ও মানবিক। নিষ্পাপ ও নির্মল শেখ রাসেল আমাদের শিশু-কিশোরদের কাছে অনুপ্রেরণার নাম। দশ বছর বয়সেই তাঁর নেতৃত্বগুণ, সহনশীলতা ও ধৈর্যের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। “শেখ রাসেল দীপ্তিময়, নির্ভীক নির্মল দুর্জয়” এ প্রতিপাদ্য নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে তৃতীয় বারের মতো জাতীয়ভাবে দেশব্যাপী “শেখ রাসেল দিবস-২০২৩” আমরা পালন করছি। এ দিবস পালনের মাধ্যমে ‘শেখ রাসেলের বেড়ে উঠা, মানবিকতা, উদারতা, অতিথি পরায়নতা এবং দশ বছর জীবনের যে জীবন সংগ্রাম-এই সবকিছু আমরা তুলে ধরতে চাই বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে। শেখ রাসেলের নির্মল, দুরন্ত ও প্রাণবন্ত শৈশব প্রত্যেক শিশুর কাছে তুলে ধরতে এবং প্রতিটি শিশুকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে প্রগতিশীল, অসম্প্রদায়িক এবং নির্ভীক সোনার মানুষে পরিণত করতেই এ উদ্যোগ।
আমি ১৯৭৫ সালের আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম নির্মম হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই এবং শিশু রাসেলসহ সেই হত্যাকাণ্ডের সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি।
(লেখক: জুনাইদ আহমেদ পলক, এমপি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী)