শেহরীন সহিদ হৃদিতা, চাঁদপুর জেলা প্রতিনিধি, টেকজুম ডটটিভি// আজ ২৫শে বৈশাখ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। ঠিক ১৬০ বছর আগে অবিভক্ত বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ, যিনি সর্বপ্রথম বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্যকে তুলে ধরেছেন,বাঙালীকে,বাঙালির বাঙালিয়ানাকে তুলে ধরেছেন। বাংলাকে তিনি এক অনন্য মাত্রায় তুলে ধরেছিলেন। আজ তাঁকে ছাড়া বাঙালীর প্রতিটি মূহূর্ত-ই অসম্পূর্ণ!
যে সময়ে তাঁর জন্ম, সে সময়ে সমগ্র বঙ্গ ছিলো এক অন্য রকম দশায়। তখন চলছিলো ভারতের পরিবর্তন কাল, পূ্নর্জাগরণের কাল। বাংলা তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, নারীদের অন্তঃপুরে বন্দীদশা, তারা অসূর্যম্শ্যা! বাংলা সাহিত্যের দীনদশা চলছিল।।ইংরেজ শাসন আমল চলছে তখন, ফলে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলায়। এক দিকে গড়ে উঠেছে অভিজাত শ্রেনী, অন্যদিকে বাড়ছে দরিদ্রদের সংখ্যা। সময়টা বাংলার নবজন্মের।
সময়টা যখন এমন, তখনি আবির্ভাব হলো এক অন্যধারার মানবের। তিনি স্থাপন করলেন মানবপ্রেমের এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত।তাঁর কন্ঠে বারবার উচ্চারিত হলো মানবের মাঝেই পরম ঈশ্বরের বাস!তাঁর লেখায় বারবার ফুটে উঠলো অকৃত্তিম দেশপ্রেম। তাঁর গানে বিশ্বজনের হিতবাসনা। তাঁর ভালোবাসা প্র্রকৃতির প্রতি, তাঁর প্রেম জগদীশ্বরের জন্য।তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“হে নূতন,
দেখা দিক আরবার, জন্মের প্রথম শুভক্ষন।
তোমার-ও প্রকাশ-ও হোক , কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন
সূর্যের মতোন..
হে নূতন!”
তাঁর জন্ম কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। ঠাকুরবাড়ির কর্তা তখন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র মহর্ষি শ্রীদেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রিন্স দ্বারকানাথ ইংরেজদের কাছে খুবই প্রিয় ছিলেন। ইংরেজ শাসকদের জন্য তিনি ব্যয় করতেন যথেষ্ট অর্থ, পাশ্চাত্য শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিও অনুরাগ ছিলো তাঁর। এ কারণে পেয়েছিলেন সম্মান্সূচক “প্রিন্স” উপাধি।তবে, তিনি কিন্তু এটাও ভুলে যাননি যে তিনি ধর্মমতে একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আদি নিবাস যশোরে, তাঁদের বংশ-ও উচ্চশ্রে্নীর। তাঁরা ছিলেন যশোরের পিরালী ব্রাহ্মণ,কুশারী তাদের আদি পদবি। অথচ তাঁর-ই পুত্র দেবেন্দ্রনাথ সেই ধর্মকে অস্বীকার করে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করলেন,নাম “ব্রাহ্ম”। এই ধর্মে কোনো বিগ্রহ নয়, পূজনীয় হবেন স্বয়ং পরমেশ্বর,এক ব্রহ্ম। তাঁর-ই আহবানে শুরু হলো এক ধর্মভিত্তিক আন্দোলন, যা পুরো হিন্দু সমাজের ভিত নাড়িয়ে দিলো!
শুধু নতুন ধর্ম-ই না, নতুন এক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে চলছে ঠাকুরবাড়ি তখন। বাড়ির মেয়ে-বউরা বই পড়ছেন, এমনকি লেখালেখিও করছেন পত্র-পত্রিকায়। এমনকি বই-ও লিখছেন স্বনামেই।শুধু তাই নয়, পর্দা ঠেলে বেরিয়ে প্রকাশ্যে ঘোড়ায় চেপে বেড়াতে যাচ্ছেন স্বামীর সাথে, ইংরেজদের পার্টিতেও যোগ দিচ্ছেন!ঠাকুর বাড়ির মেয়েরাই নতুনভাবে শাড়ি পরবার ধরণ শিখিয়েছিলেন গোটা বাংলার নারীদের, যাতে শাড়ি পরা একই সাথে আকর্ষনীয় এবং আরামদায়ক হয়। এখন যেভাবে শাড়ি পরা হয়, তার উদ্ভাবন-ও কিন্তু ঠাকুরবাড়ি থেকেই! তখন ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা বিলেতে পড়তে যাচ্ছেন, ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত হচ্ছে নিজস্ব সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা। স্বভাবত-ই এত পরিবর্তন মেনে নিতে পারলো না সমাজ, ফলে একইধরনের বেশ কিছু পরিবারের মতোই গোঁড়া হিন্দু সমাজ একঘরে করলো ঠাকুরবাড়িকে।
এই পরিবারেই ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এক বৈশাখে জন্ম নিলেন দেবেন ঠাকুর এবং তাঁর স্ত্রী সারদাসুন্দরী দেবীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “রবি”। যাঁর কিরণে নতুনভাবে ঝলমলে হয়ে উঠলো সমাজের আনাচে-কানাচ! মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের মাতৃবিয়োগ ঘটে। আর পিতার ছিলো দেশভ্রমণের নেশা, তাই অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরেই থাকতেন তিনি। তাই রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। এ সম্পর্কে তিনি লিখে রেখে গেছেন তাঁর শৈশবস্মৃতি নিয়ে লেখা আমার ছেলেবেলা” বইটিতে।রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন।কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষা তাঁর ভালো লাগতো না। তাই বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। পড়াশোনার চেয়ে প্রকৃতির বুকে ঘুরে বেড়াতে আর নিজের মতো লেখালেখি করতেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি।
মাত্র সতেরো বছর বয়েসে প্রথমবার বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যান তিনি। সে সময়ে তাঁর মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং তাঁর পরিবারের সাথে ছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেকসপিয়র ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। তিনি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে রিলিজিও মেদিচি, কোরিওলেনাস এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা পড়েন।সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা ভারতী পত্রিকায় ( যা ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত হতো) পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ।এই লেখাগুলি জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনাসহ প্রকাশিত হত “ইউরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা” নামে। ১৮৮১ সালে সেই পত্রাবলি “য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র” নামে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়। এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ। অবশেষে ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে, পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই সাহিত্যচর্চার জন্য ফিরে আসেন তিনি। তাঁকে দ্বিতীয়বার বি্লেতে পাঠানো হয়, কিন্তু এবার-ও একই ঘটনাই ঘটে! এরপর তিনি পুরোপুরি কাব্যচর্চায় মন দেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হলো এর ভিতরের ভাবের গভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, মূর্তির বিগ্রহ নয়, বরং পরম ঈশ্বরকে বুকে ধারণ করা-মানবের মাঝেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, সৌন্দর্যচেতনা, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও কুসংস্কার দূর করে নতুন প্রগতির চেতনা।
বিশ্বের সেরা এই কবি একাধারে একজন সংগীতকার, লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং বাংলা ভাষার সাহিত্যিক। তিনিই নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত প্রথম এশিয়ান যিনি বাংলা সাহিত্যে এইখেতাব পেয়েছেন। তাঁর রচিত উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গান, নাটকের সংখ্যা অগনিত। তিনি একাই বাংলা সাহিত্যে যত রচনা করেছেন, তা একজনের মানুষের এক জীবনে পড়ে শেষ করাই দুরূহ!আট বছর বয়সেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তার “অভিলাষ” কবিতাটি প্রকাশিত হয়। আর এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের “ভিখারিণী” গল্পটি, যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “কবিকাহিনী”।রবি ঠাকুর দুই হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস , ৩৬টি প্রবন্ধ তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।আর তাঁর যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে এবং এছাড়াও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি-ও এঁকেছিলেন।
১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ ভবতারিণীর নামকরণ করেছিলেন মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথের মোট সন্তান-সন্ততি ছিলো পাঁচ জন। এরা হলেন_ “মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা এবং শমীন্দ্রনাথ।অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে। আর মাত্র ত্রিশ বছর বয়েসেই কবিপত্নী মৃণালীনী দেবী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পিতার আদেশে ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সাল অবধি তৎকালীন নদিয়া এবং বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা, পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারিগুলোর তদারকির ভার নিতে হয় রবীন্দ্রনাথকে।সেই সময়ে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন।আর বাকিসময় কাটতো শিলাইদহের পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া “পদ্মা” নদীতে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় ভেসে রচনার কাজে। এই বজরায় বসেই তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ, মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী ইত্যাদি। এমনকি প্রখ্যাত গীতাঞ্জলী কাব্যের অনুবাদ কাজও শুরু করেন এখানেই, যার ফলে পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।নোবেল ফাউন্ডেশন তার এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি “গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ” রূপে। এখানে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীসহ আরো অনেকের।
১৯০১ সালে রবি ঠাকুর সপরিবারে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের কাছে শান্তিনিকেতনে। এখানে তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্ম উপাসনার জন্যে একটি আশ্রম ও ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই আশ্রমের আম্রকুঞ্জ উদ্যানে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন “ব্রহ্মবিদ্যালয়” বা “ব্রহ্মচর্যাশ্রম”। এটি ছিলো একটি পরীক্ষামূলক স্কুল, যে স্কুলটির মাধ্যমে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক একঘেয়ে শিক্ষাক্রমের প্রতি তাঁর প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছিলেন।রবীন্দ্রনাথ তার “তোতা-কাহিনী” গল্পে বিদ্যালয়ের মুখস্ত-সর্বস্ব শিক্ষাকে প্রতি তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, দেশের ছাত্রসমাজকে খাঁচাবদ্ধ পাখিটির মতো শুকনো বিদ্যা গিলিয়ে কিভাবে তাদের বৌদ্ধিক মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
এখানে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছাত্রছাত্রীদের পূর্ণাঙ্গ মনোবিকাশের সুযোগ করে দেওয়া। পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে এই স্কুলটি রূপান্তরিত হয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা বর্তমানে সারা বিশ্বের একটি নামকরা বিদ্যাপীঠ। কবিগুরু তাঁর নোবেল পুরষ্কারের সম্পূ্র্ণ অর্থ ব্যয় করেন এই বিশ্ব বিদ্যালয় তৈরির কাজে।
১৯৫১ সালে এটি ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। দেশবিদেশ থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী প্রতিবছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করতে যান।বহু স্বনাধন্য ব্যাক্তিত্ব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য_ “নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারবিজয়ী চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়, জয়পুরের রানী গায়েত্রী দেবী, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ।
বিশ্বভারতীতে ছাত্র-ছাত্রীদের রবীন্দ্রনাথ বরাবরই শিল্প এবং বাঙালি ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে চেষ্টা করতেন। তাঁরই উদ্যোগে বিশ্বভারতীর শিল্প সদনের শিক্ষার্থীরা মিলে একটি শাড়ি তৈরি করেন। শাড়িটি তৈরি হতো পুরোনো তাঁতের শাড়িকে ছিঁড়ে সেই সুতো দিয়ে, নকশাটা হতো অনেকটা মা-দাদিমাদের কাঁথা সেলাইয়ের নকশার মতো। সেই শাড়িটি বর্তমানে বীরভূম অঞ্চলের অনেক দরিদ্র তাঁতি পরিবারের ভরণ-পোষনের একমাত্র উপায়।শাড়িটির নাম “খেশ শাড়ি”। এটিও আমাদের, অর্থাৎ বাঙালিদের এক ঐতিহ্যের স্মারক।পূর্বে বোলপুর থেকে শাড়ি্টি আমদানী হতো।তবে বর্তমানে বাংলাদেশেও এই শাড়ি তৈরি হচ্ছে। এবং ই-কমার্সের প্রসার লাভের ফলে অনেক উদ্যোক্তা, বিশেষত নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে এই শাড়ি ব্যপক পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে তৈরি হচ্ছে_ এই খেশ কাপড়ের কূর্তি, কামিজ, ব্যাগ,শোপিস এমনকি শাল-ও! তবে এই খেশ কাপড়ের উদ্ভাবনের সাথে রবীন্দ্রনাথ-ও কিন্তু জড়িয়ে আছেন ওতপ্রোতভাবে।
রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম ছিলো অবিস্মরনীয়। কিন্তু , তাঁর মধ্যে কোনো গোঁড়ামি বা উগ্র জাতীয়তাবাদ ছিলো না। তিনি এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯১৫ সালে ইংরেজ সরকার তাকে নাইটহূড উপধিতে ভূষিত করে। কিন্তু, ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন।নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।”
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর লেখা “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য”, “একলা চলো রে”– এর মতো রচনাগুলো রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করে। “একলা চলো রে” গানটি গান্ধীজিরও প্রিয় ছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯১৫ সালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে রবি ঠাকুরই ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল তিক্ত কিন্তু মধুর। রবিঠাকুর গান্ধীজির স্বদেশ আন্দোলনের পন্থাকে মোটেই সমর্থন করতেন না। তিনি বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন। নেতাজি সুভাসচন্দ্র বোসকে সমর্থন করতেন তিনি।তাঁর জন্য “তাসের ঘর” নামে একটি প্রতীকি নাটক-ও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গভঙ্গ রদ করার পিছনে তাঁর ব্যাপক প্রচেষ্টা ছিলো।এ কারনে তিনি হিন্দু-মুসলিম রাখী বন্ধনেরও আয়োজন করেন।যদিও, তাতে শেষ রক্ষা হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-ই একমাত্র গীতিকার যিনি তিনটি দেশের জাতীয় সজ্ঞীতের স্রষ্টা! ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত যথা ‘জন গণ মন’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ দুটোই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা।বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক শিক্ষার্থী, যাঁর নাম ছিলো আনন্দ সমরাকুন, উনি রবি ঠাকুরের লেখা “নমো নমো শ্রীলঙ্কা মাতা” গানটিকে সিংহল ভাষায় রূপান্তর করেন। এবং পরবর্তীতে সেই গানটিকেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
তাঁর জীবনের শেষ চার বছর ছিল শারীরিক অসুস্থতার সময়।১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির।সেবার সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি। এই সময়পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট।এই মহাকবি মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্তও সৃষ্টিশীল ছিলেন। অবশেষে, দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট জোড়াসাঁকোর নিজবাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের নতুন দিশারী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচনকারী। তাঁর অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকরা নতুন একটা পথ আবিষ্কারের কথা ভাবতে পারেননি। সে সময়ে বেশিরভাগ রচনাই ছিলো সংস্কৃত ভাষায় রচিত। রবি ঠাকুর দেখালেন যে, প্রমিত কথ্য বাংলা ভাষাতে রচনা করা সম্ভব। ঈশ্বর আছেন আমাদের মাঝেই, আমা্দের প্রেম নিজেদের সাথেই- এসব জানালেন তিনিই! নাটকে নৃত্য ও গানের ব্যবহারও প্রথম তিনিই শুরু করেন। বাঙালির আধুনিক জীবনযাত্রা, মুখস্তনির্ভরশিক্ষা বর্জন, স্বদেশী চেতনা, নারী ও সমাজ সংস্করন এই সব কাজেই তাঁর অগ্রণী ভূমিকা আছে।
আজ তিনি বাঙালির হৃদয়ের এমন স্থানে আছেন, যেখান থেকে তাঁকে টলানো অসম্ভব। সকল শুভ কাজের শুরুতে, সকল উৎসবের প্রাক্কালে তিনি আছেন, তিনি ছাড়া বাঙালিয়ানা যে অসম্পূর্ণ!তিনিই বাঙালির জীবনের ধ্রুবতারা, তিনিই কণর্ধার! হাসিকান্নার মাঝে ভেসে আসে তাঁর গানের ভেলা,ঋতুর আগমনে মু্গ্ধ প্রানে বাজে তাঁর বাঁশির সুর। বিদ্রোহে চাই তাঁর কবিতার শক্তি, প্রেমে চাই তাঁর-ই রচিত আকুলতা! তিনিই যে আমাদের আবেগ-অনুভবের পরিপূরক!
হে কবি, হে জ্যোতির্ময়, জন্মদিনের এই শুভ ক্ষণে, তোমারেই করি নমষ্কার। তোমারি হোক জয়!