বাংলা প্রদেশের প্রথম মহিলা কলেজ- ইডেন মহিলা কলেজ। বর্তমানের ইডেন মহিলা কলেজ আর উনিশ শতকের ইডেন স্কুলের মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য।
ইডেন স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে দুই ধরনের মতামত পাওয়া যায়।
১মটি হলো- ঢাকার তৎকালীন গণ্যমান্য নাগরিক দীননাথ সেনের মেয়ে সুশীলা দেবীর ( জন্ম-১৮৬২)। সামাজিক প্রথাকে উপেক্ষা করে দীননাথ চেয়েছিলেন মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে। আর তাই সূত্রাপুরে রামচন্দ্র বসুর বাসায় খোলা হয়েছিল একটি পাঠশালা। ছাত্রী ছিলেন -রামচন্দ্র বাবুর মেয়ে সুশীলা ও আরো দুজন ছাত্রী। শিক্ষক ছিলেন বিহারীলাল সেন৷
২য় মতামত পাওয়া যায় ইডেন স্কুলের একজন প্রতিষ্ঠাতা ও ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম কর্মী নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী থেকে।তিনি লিখেছেন -সর্বপ্রথম বিখ্যাত অভয়চন্দ্র দাস তার বাসাটিকে তার পুত্র বাবু প্রাণকুমার দাস ও কয়েকজন ব্রাহ্মণ যত্ন করে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বলেন -তিনিও এই বিদ্যালয়ের একজন পরিচালক ছিলেন। কিছুদিন এই বিদ্যালয়ের কার্যক্রম নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ফরাসগঞ্জের বাসায় চলেছিলো। পরে এই বিদ্যালয়টি বাবু বঙ্গচন্দ্র রায়, বিহারীলাল সেন, কৈলাশচন্দ্র নন্দী এবং নবকান্ত চট্টোপাধ্যায় যত্ন করে “যুবতী বিদ্যালয়” পরিনত হয় এবং বাবু আনন্দমোহন দাস প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয় হয় “ঢাকা ইডেন ফিমেল স্কুল”।
২য় মতামত ভাষ্যটি বেশী গ্রহণযোগ্য।তবে সুশীলা ও নবকান্ত দুজনই একই স্কুলের কথা বলেছেন। আর শিক্ষক হিসেবে বিহারীলাল সেনের কথা জানান। দুজনের তথ্যকে একত্রিত করে বলা হয় – ব্রাহ্মদের উদ্যোগে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কিছু চিন্তা করা হয়। ব্রাহ্মণদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ফিলান থ্রপিক সোসাইটি ফর সোশ্যাল রিফর্ম (১৮৭১) বা “শুভ সাধিনী সভা” থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। “ফিমেল এডাল্ট স্কুল” হিসেবেই এটি পরিচিত ছিলো। এ স্কুল দেখেই ১৮৭৬ সালে মেরী কার্পেন্টার বাংলা সরকারকে লিখেছিলেন ”
Dacca the capital of East Bengal, though somewhat remote, is considerably in advance of other places in female education, through the efforts of many enlightened Native Gentleman. Here I found a small adult school unique in this character, whose husbands desire for them intellectual improvement.”
তৎকালীন সরকার এই রিপোর্ট এর উপর ভিত্তি করেই ১৮৭৮ সালে মেয়েদের মিডল ভার্নাকুলার স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করার অনুমতি দেন ইডেন স্কুলকে। তখন বাংলার গর্ভণর ছিলেন স্যার অ্যাশলি ইডেন। তার শিক্ষার প্রতি আগ্রহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্কুলের নামকরন করা হয় ইডেন ফিমেল স্কুল। লক্ষীবাজারে স্থাপিত হয়েছিলো স্কুলটি এবং কমিটির প্রথম সচিব ছিলেন নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
সরকারী সাহায্য ছাড়াও স্থানীয় ভদ্রলোকেরাও সাহায্য করতেন। ১৮৮৩ সালে ঢাকা প্রকাশের এক রিপোর্টে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতনাদি সম্পর্কে জানা যায়। প্রধান শিক্ষিকা বাড়িসহ বেতন পেতেন ১শত ৬০ টাকা। ইংরেজি শিক্ষক বেতন পেতেন ৪০ টাকা এবং পণ্ডিত পেতেন ২০ টাকা।
১৮৯৭ সালে উৎপত্তি স্থল আসাম হতে ৮.৭ মাত্রার তীব্র ভূমিকম্প হয়। সেই ভূমিকম্পে লক্ষীবাজারের স্কুলটি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিলো উকিল ঈশ্বরচন্দ্রের বাসায়।
১৯২৬-২৭ সালে ইডেনকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে। সদরঘাটেই ছিলো স্কুল ও কলেজের শাখা। ১৯৪৫ সালে স্কুল ও কলেজকে নিয়ে আসা হয় বর্তমান সচিবালয়ে। তখনই সচিবালয়ের নাম হয় ইডেন বিল্ডিং যা চালু ছিলো কিছুদিন আগেও।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর ও ইডেন স্কুলের অস্তিত্ব বিলীন হতে থাকে। পরে এক বছরের মধ্যে স্কুল ও কলেজকে একসাথে স্থানান্তরিত করা হয় কমিশনার অফিসে এবং সবশেষে কামরুন্নেসা স্কুলের সাথে।
১৯৪৮ সালে ইডেন কলেজ শাখাটি স্থানান্তরিত করা হয়ছিলো বখশীবাজারে।ঐ বছরই কলেজে ডিগ্রী ক্লাস শুরু করা হয়। ১৯৪৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা হয়। তবে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানের ক্লাস করার জন্য যেতে হতো ঢাকা কলেজে। ১৯৬২ সালে কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখা বখশীবাজার রেখে (বর্তমানের বদরুনন্নেসা কলেজ) আজিমপুরে বর্তমান জায়গায় খোলা হয়েছিল কলেজের স্নাতক ও ডিগ্রী কোর্স।
১৯৬২ সালে আজিমপুরে ১৮ একর জমিতে গড়ে উঠে ইডেন কলেজ। ১৯৬৩ সালে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে “ইডেন মহিলা কলেজ” নামে পরিচালিত হয়।
জোবেদা খাতুন নামক প্রথম মুসলিম ছাত্রীর লেখায় বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ১৯০৭ সালে ক্লাস টুতে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তিনি জানিয়েছিলেন- বাংলা, ইংরেজি,অংক, গান সবই শেখানো হতো স্কুলে। তখন ছিলো রবীন্দ্র যুগ, স্কুলের গানের শিক্ষিকা প্রভাদি কলকাতায় গিয়ে নতুন নতুন গান তুলে আসতেন তারপর তাদের শেখাতেন। জোবেদা খাতুন আরো জানিয়েছিলেন – তার ভর্তির ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হয়ে নবাব সলিমুল্লাহ জোবেদা খাতুন এর বাবার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর উত্তরে তার বাবা বলেছিলেন – “আমরা মেয়েদের পড়াবো বলে ভর্তি করিয়েছি। আমরা তো ঢাকা সমাজের নই, সিলেটের”।
দেশ বিভাগের পর ইডেনের প্রথম অধ্যক্ষা নিযুক্ত হয়েছিলেন ফজিলাতুননেসা জোহা৷
ইডেন মহিলা কলেজের উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন ছাত্রীরা হলেন-
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার – বাঙালী বিপ্লবী
শেখ হাসিনা- বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী
আমেনা বেগম- রাজনীতি বিদ
মনিরা রহমান – মানবাধিকার কর্মী
ফেরদৌসী মজুমদার – নাট্য ব্যক্তিত্ব
মতিয়া চৌধুরী – রাজনীতি বিদ
দিলারা জামান – নাট্য ব্যক্তিত্ব।