একঘেয়ে কাজ আর সবুজের কাছ থেকে দূরে থাকার অবসাদ জেঁকে বসেছে আমাদের ওপর। আমাদের শরীর ও মন একটু অবসর বা মানসিক প্রশান্তি চায় মাঝে মাঝেই। একটু হাসি-আনন্দ আর পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে দিন কাটালে মানসিক অবসাদটা কেটে গিয়ে কাজে চলে আসে গতি। মানুষের সময় স্বল্পতা আর দৈনন্দিন ব্যয়ের হিসাবটা প্রভাব ফেলছে বিনোদনের উপর তাই নিজ জেলা বা বিভাগীয় শহরের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর মাঝেই এখন মানুষের চোখ থাকে দলবেঁধে ঘুরে আসার জন্য। ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত কন্যা নামে খ্যাত উপজেলার নাম হালুয়াঘাট। এই জেলার রয়েছে ঐতিহাসিক মূল্য আর বন-পাহাড়-সবুজের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। হালুয়াঘাট উপজেলার দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই; রয়েছে বিল, নদী আর পাহাড়ের সাথে সখ্যতায় গড়ে উঠা পিকনিক স্পট। তবে প্রচার, সংস্করণ আর উন্নয়নের অভাবে জায়গাগুলো পরিচিতি পাচ্ছে না সঠিকভাবে। বর্তমানে এই সমস্যা গুলোর অন্যতম সমাধান হল ইন্টারনেটের মাধ্যমে জায়গাগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানানো ও আগ্রহী করা। ই-কমার্স সেক্টর কনটেন্ট ভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে জোর দেয় বেশি তাই দর্শনীয় স্থানগুলোর ক্ষেত্রে ই-কমার্স সেক্টর অবদান রাখতে পারে সবচাইতে বেশি পরিমাণে। কারণ দর্শনীয় স্থানগুলোকে রাইটিং ও ভিজুয়াল কন্টেন্টের মাধ্যমে ই-কমার্সেে ছড়িয়ে দেয়া যায় সহজেই। সেই লক্ষ্যে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ; যেমন গাবরখালির পর্যটন কেন্দ্র, ময়মনসিংহ স্থলবন্দর পিকনিক স্পট, কড়ইতলী-গোবরাকুড়া স্থলবন্দর ইত্যাদি এর বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা নিয়ে আজকের লেখাটি।
গাবরাখালী গারো হিল পর্যটন কেন্দ্র
পাহাড় এবং টিলা, বনভূমি নদী-খাল-বিল সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ময়মনসিংহ জেলা পর্যটন শিল্প বিকাশ করা লাভ করেনি প্রত্যাশিত মাত্রায়। তবে সীমান্ত এলাকাযর পাহাড় টিলা অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এরই অংশ হিসেবেই হালুয়াঘাট উপজেলার প্রত্যন্ত অবহেলিত ও পাহাড় ঘেরা গাবরাখালি গ্রামে ১৪টি পাহাড়-টিলা সমন্বয়ে ১২৫ একর জমিতে প্রশাসন এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, যা ইতিমধ্যে সাড়া ফেলেছে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। পাহাড় ও সমতলের মিলনস্থলে প্রতিদিন ঘুরতে আসছে হাজার হাজার দর্শক ও ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সরকারের স্থানীয় বিনিয়োগ মডেল অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রটি। রয়েছে একটি বিশ্রামাগার, একটি রেস্ট হাউস, বিভিন্ন টিলায় ওঠার জন্য আছে সিঁড়ি ও সংযোগ সেতু। তৈরি করা হয়েছে পার্ক ও স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনভিত্তিক জাদুঘর। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিজস্ব বিনিয়োগে ফুডপার্ক ও শপিং জোনও রয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্রে। উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা বলেছেন, খুব শিগগিরই শুরু হবে ওয়াচ টাওয়ার, গ্রুপ ভিত্তিক সমবায় সমিতির মাধ্যমে ক্যাবলকার ও সুইমিং পুলের নির্মাণকাজও। এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং পাশাপাশি এই বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় রিসোর্স হবার সম্ভাবনা রয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্রটিতে। কেন্দ্রটিকে সেবা বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে গঠন করা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় শিল্পীদের সমন্বয়ে কালচারাল টিম, ডেকোরেশন টিম ও টুরিস্ট গাইড টিম। ময়মনসিংহের সাবেক বিভাগীয় জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের অক্লান্ত চেষ্টায় এই পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছে যা শুধু একটি ভ্রমনস্থান হিসাবে সরকারের রাজস্ব আদায় করছে না, পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে।
ঢাকা বা ময়মনসিংহ জেলা থেকে প্রাইভেট কারে করে সরাসরি চলে যাওয়া যাবে এই পিকনিক স্পটটিতে অথবা বাসযোগে হালুয়াঘাট পৌঁছে সিএনজি বা অটোরিকশা দিয়ে যাওয়া যাবে গাবরাখালী গারো হিল পর্যটন কেন্দ্রে।
ময়মনসিংহ স্থলবন্দর পিকনিক স্পট
মেঘালয় কোলঘেঁষা হালুয়াঘাট কড়াইতলী ও গোবরাকুড়া স্থলবন্দর। এর পাশেই ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে সাড়ে তিন একর জমির ওপর ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে ওঠে হালুয়াঘাট পিকনিক স্পট। নয়নাভিরাম এই স্পটে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসেন এবং উপভোগ করেন নৈসর্গিক সৌন্দর্য। বাংলাদেশ থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্য ও পাহাড়ে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার অনুভূতিই অন্যরকম; তাই বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও অফিসের পিকনিক বা অফিশিয়াল ট্যুরের জন্য এই পিকনিক স্পটটি জনপ্রিয় হচ্ছে ধীরে ধীরে। শিশুদের আধুনিক মানের রাইড, রেস্টুরেন্টসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি দর্শনার্থীদের। যদি রাস্তাঘাট আবাসস্থল খাবার ও পানির যথাযথ ব্যবস্থা করা যায় তাহলে এই পিকনিক স্পটটি হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম টুরিস্ট প্লেসে। সরকারি সহায়তা পেলে ভবিষ্যতের আধুনিক মানে পরিণত করার কথা জানায় পিকনিক স্পট কর্তৃপক্ষ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় স্পটটিকে আধুনিক মানের করে গড়ে তোলা গেলে এটিও হয়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন কেন্দ্র। বর্তমানে রাস্তা ভালো হওয়ার গাড়ী বা বাসে করে সহজেই চলে যাওয়া যায় ময়মনসিংহ স্থলবন্দর পিকনিক স্পটে।
বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানা আমাদের কাছে অনেক আগ্রহের জায়গা। যে সকল সীমান্তবর্তী জায়গা রয়েছে আমাদের দেশে, সেই জায়গাগুলোতে মানুষের ঘুরার আগ্রহ থাকে বেশি। ভারতের মেঘালয়ের ঝর্ণা নেমে এসেছে হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়া ও কোন অঞ্চলের নদীতে যার পাশে নির্মিত হচ্ছে কড়ইতলী ও গোবরাকুড়া স্থলবন্দরটি। ব্যবসা ও পর্যটন শিল্পের জন্য অপার সম্ভাবনাময় এই দুটি স্থলবন্দর স্থাপিত হয় ২০১২ সালে । হালুয়াঘাট সদর থেকে 5 কিলোমিটার দূরে গোবরাকুড়া ও 6 কিলোমিটার দূরে কড়ইতলী স্থলবন্দর নির্মিত হচ্ছে। গোবরাকুড়া স্থলবন্দরের নির্মাণকাজ 90% ও কড়ইতলী স্থলবন্দরের নির্মাণকাজ 80% সম্পূর্ন হয়েছে যার কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে জেগে উঠছে নতুন স্বপ্ন। হালুয়াঘাট উপজেলায় কোন শিল্প কারখানার নেই বললেই চলে অন্যদিকে মেঘালয় রাজ্যে ও তেমন কোন শিল্প কারখানা না থাকায় গোবরাকরা ও কড়ইতলি স্থলবন্দরটি স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পাশাপাশি স্থানীয় পণ্য আমদানি রপ্তানি করাতে সাহায্য করবে। স্থলবন্দর দুটির বিশাল জায়গা জুড়ে অন সিজনে প্রচুর পরিমাণে কয়লা আমদানি করা হয় ভারত থেকে। অফ সিজনে জায়গাগুলো ফাঁকা থাকায় প্রচুর লোক সমাগম হয় শুধুমাত্র স্থলবন্দর দুটি দেখার উদ্দেশ্যে। যে প্রবেশপথটি দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিকেরা আসা-যাওয়া করে সেই প্রবেশপথটি অনেক মানুষেরই আগ্রহের কারণ। যার কারণে স্থল বান্দর দুটি শুধু ব্যবসায়ী কাজে নয় সেইসাথে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও জায়গা করে নিচ্ছে মানুষের মনে। সড়ক পথ সহজ হওয়ায় ঢাকা বা ময়মনসিংহের মানুষ সহজেই চলে আসতে পারবে এই জায়গাটিতে।
হালুয়াঘাটের গারো পাহাড়
ঢাকা থেকে একদিনে ঘুরে আসার মত পাহাড়ি অঞ্চল খুঁজতে চাইলে প্রথমেই মনে হবে হালুয়াঘাটের গারো পাহাড়ের কথা। যে কোন ছুটির দিনে অথবা লং ভ্যাকেশনে চাইলেই ঘুরে আসা যাবে হালুয়াঘাটের গারো পাহাড় থেকে। সূর্যপুর, পানিহাতা আর কড়ইতলী, হালুয়াঘাটের এই জায়গাগুলো থেকেই মেঘালয়ের সব পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়; কড়ইতলী এর মাঝে সবচাইতে কাছের জায়গা। হালুয়াঘাটে শাপলা বাজার মোড় পার হতে ভাগ হয়ে যায় রাস্তা, যেখান দিয়ে যেতে যেতেই চোখে পড়ে পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের সৌন্দর্যগুলো বৈচিত্র্যময়, কোনোটাতে মেঘ জমেছে তো কোন পাহাড়ে বৃষ্টি পড়ছে; আবার কোনোটাতে চলছে রোদের খেলা। কড়ইতলী এর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেই দেখা যাবে গারো নারীরা মাঠে নেমে ধানের চারা রোপন করছে। বয়ে যাওয়া ছোট কংস নদীর উপরে বাঁশের সাঁকো বিছানো; বর্ষায় কংস নদীর জলরাশি ভাসিয়ে নিয়ে যায় দুই পারের লোকালয়। দূরের পাহাড় থেকে এক ঝাঁক বক উড়ে যায় এমনিভাবে যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে দিন দিন মানুষ আগ্রহী হচ্ছে হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়া ইউনিয়নের কড়ইতলী গ্রামের উপর। ঢাকা বা ময়মনসিংহ থেকে বাসে করে হালুয়াঘাট উপজেলা পৌঁছে রিক্সা বা অটো ভাড়া করে চলে যাওয়া যাবে কড়ইতলী গ্রামে। খাবারের ব্যবস্থা নিজেরা করে নিলেই ভালো হয় তবে থানার পাশে একটি ঘরোয়া হোটেল পাওয়া যাবে যেখানের হাঁসের মাংস বেশ প্রসংশনীয়।
একটি অঞ্চলের পর্যটন এরিয়া শুধু জেলা বা বিভাগীয় ভিত্তিক উন্নয়নই ঘটায় না বরং একটি দেশের সামগ্রিকভাবে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটায়। ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটের দর্শনীয় স্থানগুলো সামগ্রিক ভাবে প্রচারের অভাবে শুধু আঞ্চলিক দর্শনার্থীদের কাছেই মান পাচ্ছে। আমরা যদি এই অঞ্চলের পর্যটন এরিয়াগুলোকে ই-কমার্সের ভিতর নিয়ে আসি এবং কন্টেন্টের মাধ্যমে তুলে ধরি, তাহলে এই জায়গাগুলো শুধু পরিচিতিই পাবে না, মানুষ পাবে সময় কাটিয়ে আসার মতো নতুন জায়গার আর নতুন স্বাদের।
লেখক -রুকসানা সুলতানা