বলা হয়ে থাকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে যে কোনো সময়ের চেয়ে সেরা সময় পার করছেন বর্তমান মানব সভ্যতা। আজ থেকে ২০/৫০ বছর আগেও যেসব প্রযুক্তির কথা ভাবা যেত না, সেসব প্রযুক্তিই এখন আমাদের জীবন সহজ ও স্বাভাবিক করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আরও বেশি বদলে যাবে আমাদের জীবন। কেমন হবে, ভবিষ্যতের পৃথিবী?
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা নিয়ে নানা কথা হলেও জলবায়ু পরিবর্তন, বর্ধিত জনসংখ্যা আর সঙ্কুচিত হতে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদের কথা ভেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দের ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই, গবেষকরা জানিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্ম অনেক আরাম আয়েশেই থাকবে। যুদ্ধবিগ্রহ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির মত সমস্যা তো থাকবেই, কিন্তু সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবিকাশে উঁকি দেবে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
গবেষকদের মতে, ২০৫০ সার নাগাদ বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির মিলিত উৎকর্ষে মানুষের জীবনযাত্রা হবে অনেক বেশি চিত্তার্ষক। গাড়ি চালাতে লাগবে না চালক, প্রেমিকা না জুটলেও অসুবিধা নেই, মিলবে কৃত্রিম প্রেমিকা, এমনকি অমরত্ব লাভের সুযোগও থাকবে সেই প্রজন্মের সামনে।
জিন সম্পাদনা করে ‘আদর্শ’ মানুষ তৈরি করার বিদ্যা মানুষ আগামী ৫০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে খুব ভালোভাবেই রপ্ত করবে। আগামী দশকগুলোতে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন কম্পিউটারে মানব মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করতে সফল হবেন তারা। এর মাধ্যমে আজীবনের জন্য কৃত্রিম শরীরের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবে মানুষ, পূর্ণ হবে অমরত্বের স্বপ্ন! রাশিয়ান ধনকুবের দিমিত্রি ইসকোভের অর্থায়নে নিউরোসাইন্টিস্ট র্যাপন্ডাল কোয়েন চেষ্টা করছেন মানব চেতনা ও মস্তিষ্ককে যেন আগামী ২০৪৫ সালের মধ্যে কৃত্রিম শরীরে প্রতিস্থাপন করা যায়। এমনকি এখন যারা বেঁচে আছেন তারা মারা গেলেও এক সময় নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে তারা বেঁচে উঠবেন, কৃত্রিমভাবে সংরক্ষিত নিজেদের মস্তিষ্কের সাহায্যে। এমন আশার কথা শোনাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এজন্য বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা করছেন কেমিক্যাল সলুশনের মাধ্যমে কিভাবে মস্তিষ্ককে অনন্তকাল সতেজ রাখা যায়।
২০৫০ সাল নাগাদ ইন্টারনেট পৌঁছে যাবে বিশ্বের সর্বত্র। ব্যবহারকারী হবে বিশ্বের প্রায় সবাই। ফোরাম ফর দি ফিউচার ফাউন্ডারের গবেষক জোনাথন পোরিট ধারণা করছেন ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৯৮ ভাগ বা ৮শ’ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, যার অনেকেই সংযুক্ত হবেন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। বর্তমানে বিশ্বের ৪০ শতাংশ লোক ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আছেন। গুগলসহ বিশ্বের আরও অনেক তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বের সবখানে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে।
যদিও আমরা জানি না ভবিষ্যতে আর কোন ধরনের রোগ আমাদের সামনে হুমকি হিসেবে দেখা দেবে, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে এখনকার সবচেয়ে প্রাণঘাতী রোগগুলো থেকে মুক্তি মিলবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এমনকি উদ্ভাবিত হবে ক্যান্সার ও এইচআইভি প্রতিষেধকও! গবেষকরা আশাবাদী আগামী ২০ বছরের মধ্যে তারা এমন টিকা আবিষ্কার করতে পারবেন যার দ্বারা এইডস প্রতিরোধ সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ লোক মারা যায় এইডস রোগে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব লাইসেস্টার এনএইচএস ট্রাস্টের কনসালট্যান্ট মার্টিন উইসেলকা এ ব্যাপারে বলেন, ভবিষ্যতে আমাদের গবেষকরা এমন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারবেন যার মাধ্যমে এইচআইভি’র মত ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে। ক্যান্সারও নির্মূল হবে। উদ্ভাবিত ন্যানোপার্টিক্যাল ক্যানসার স্টেম সেলে আক্রমণ চালিয়ে ক্যান্সারের জীবাণুকে ধ্বংস করবে। উদ্ভাবিত হবে ক্যান্সার ভ্যাক্সিন।
তাছাড়া প্রায় সম্পূর্ণভাবে দূর হবে ম্যালেরিয়ার মত রোগ। প্রতিষেধকের পাশাপাশি ম্যালেরিয়ার বাহক মশাদের ধ্বংস করতে উদ্ভাবন হবে জেনেটিক্যালি মডিফাই মশা। আলঝেইমার রোগেরও কারণ ও প্রতিকার বের হবে। মেনিনজাইটিস রোগের প্রতিষেধক ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে উৎপাদনে রোবটের ব্যবহার এমন একপর্যায়ে পৌঁছতে পারে যে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ধনী দেশগুলোর সম্পদের ফারাক সাত আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে। উন্নত দেশগুলোর ত্রুটিহীন মানবজিনোমের অধিকারী বড়লোকেরা হয়তো আজ থেকে ১০০ বছর পর স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন না। এরা তাদের বিপুল সম্পদ নিয়ে প্রথমে পৃথিবীর আন্তর্জাতিক পানিসীমানায় নিজস্ব কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে বড়লোকপাড়া স্থাপন করবে।
আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই যানবাহনের জন্য কোনো ড্রাইভারের প্রয়োজন হবে না। মিলকেন ইন্সটিটউটের তথ্য মোতাবেক ২০৩৫ সালের মধ্যেই পৃথিবীর সব গাড়ি হবে চালকমুক্ত। মানবীয় ভুলের সম্ভাবনা না থাকায় এই সব চালকবিহীন গাড়ি হবে বেশি নিরাপদ।
এছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির জয়জয়কার হবে। ইতালীয় জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইনেলের মতে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি বছর বিশ্বে ইলেক্ট্রিক গাড়ির উৎপাদন দাঁড়াবে ১০ কোটিতে। যা সারা বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৩০ শতাংশ হ্রাস করবে।
তবে প্রযুক্তির এমন অগ্রগতির পাশাপাশি বারবার একটি প্রশ্নই সামনে আসছে। পৃথিবী আর কত বছর টিকবে? অনেকে নিকট ভবিষ্যতে পৃথিবী ধ্বংসের আলামত দেখতে পাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী কমপক্ষে পৌঁনে দুইশ বছর টিকবে। আর বেশি হলে টিকতে পারে সাড়ে ৩শ কোটি বছরের বেশি সময়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এরপর থেকে সূর্যের তাপ এতো উত্তপ্ত হবে যে পৃথিবীতে কোনো কিছুই টিকে থাকতে পারবে না। সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত সূর্য থেকে প্রাণীর বসবাসের উপযোগী দূরত্বে আছে পৃথিবী। ‘গোল্ডিলক’ জোনো অবস্থান হওয়ার কারণে পৃথিবীর সমুদ্রের পানি সিদ্ধ হওয়ার মতো উত্তপ্ত হয় না, আবার স্থায়ীভাবে বরফ হয়ে যাওয়ার মতো ঠাণ্ডাও হয় না। কিন্তু এখন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সূর্য। দিন যতই যাচ্ছে সূর্য ততই উত্তপ্ত হচ্ছে। সূর্যের নিকটবর্তী কোনো গ্রহতে পানি ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু সূর্য আর পৃথিবীর দূরত্ব যথারীতি একই থাকবে, এক সময় পৃথিবী হয়ে যাবে বসবাসের অযোগ্য। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার বিশেষজ্ঞরা এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তাদের ধারণা, সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবী টিকতে পারে ৬৩০ কোটি বছর থেকে ৭৮০ কোটি বছর। প্রায় ৪৫৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি। এর অর্থ হচ্ছে পৃথিবী টিকবে ১৭৫ কোটি বছর থেকে সাড়ে ৩০০ কোটি বছর।
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার গবেষক অ্যান্ড্রু রুশবে বলছেন, ওই সময় সূর্যের উত্তপ্ত জোনের মধ্যে থাকবে পৃথিবী, তাপমাত্রা এতো বাড়বে যে সমুদ্রের পানি বাষ্পীভূত হবে। আমরা সমস্ত জীবের সর্বনাশা ও চরম বিলুপ্তি দেখব। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রথম প্রাণীর তালিকায় থাকবে মানুষ।