স্পর্শের অনুভূতি দেয়া বিশেষ ধরনের হলোগ্রাম তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করা যাবে। ফলে আপনি বিশ্বের যেখানেই থাকুন অনলাইনে দূরের কোনো সহকর্মীর সঙ্গে করমর্দন করতে পারবেন, অনুভব করতে পারবেন তার হাতের উষ্ণতা।
ধরুন হোম থিয়েটারে প্রিয় শিল্পীদের অভিনীত সিনেমা দেখছেন। হৃদয়ে ঝড় তোলা শিল্পী যেন একদম জীবন্ত, চোখের সামনে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, এমনকি অভিনয়ের মাঝে তাকে স্পর্শ করতেও কোনো বাধা নেই।
ঘটনাটি ঠিক বাস্তব মনে হচ্ছে না, তাই তো?
তবে দুই-এক দশকের মধ্যেই এটি হয়ে যেতে পারে একদম স্বাভাবিক ঘটনা। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তো আছেই, বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন এমন হলোগ্রাম, যাকে স্পর্শের অনুভূতি পাওয়া সম্ভব!
একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসা ক্ষেত্র, শিক্ষা, শিল্প, নিরাপত্তা ও সামরিক খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে নানান হলোগ্রাম। বিজ্ঞানীরা লেজার, আধুনিক ডিজিটাল প্রসেসর ও মোশন-সেন্সিং প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এসব হলোগ্রাম তৈরি করছেন। তবে এগুলো আটকে আছে কেবল দৃশ্যমানতায়, স্পর্শের অনুভূতি যেখানে অনুপস্থিত।
এবার সেই বাধা দূর করেছেন স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগোর ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড ন্যানো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক রাভিন্দার দাহিয়ার নেতৃত্বে গবেষক দল। তারা বিশেষ ধরনের হলোগ্রাম তৈরি করেছেন ‘অ্যারোহ্যাপটিকস’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তিতে বাতাসের জেট বা প্রবাহ ব্যবহার করে স্পর্শের অনুভূতি তৈরি করা হয়। বাতাসের জেটগুলো মানুষের আঙুল, হাত ও কবজিতে এমন অনুভূতি দেয়, যাতে মনে হয় হলোগ্রামটি ধরা আছে হাতেই।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সাইট সিঙ্গুলারিটি হাবের এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে দেয়া হয়েছে বিশদ ব্যাখ্যা।
কল্পনার সবকিছু স্পর্শের ক্ষমতা পাচ্ছে মানুষ
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করা যাবে। ফলে আপনি বিশ্বের যেখানেই থাকুন অনলাইনে দূরের কোনো সহকর্মীর সঙ্গে করমর্দন করতে পারবেন, অনুভব করতে পারবেন তার হাতের উষ্ণতা।
জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন সিরিজ স্টার স্ট্রেকে দেখানো হলোডেকের (সম্পূর্ণ হলোগ্রামে তৈরি ত্রিমাত্রিক জীবন্ত পরিবেশ, যেখানে সবগুলো অনুভূতি পাওয়া যায়) মতো প্রযুক্তিও ভবিষ্যতে উদ্ভাবনে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।
হলোগ্রামে স্পর্শের এই অনুভূতিকে তৈরি করতে বাণিজ্যিকভাবে সহজলভ্য ও কম খরচের যন্ত্রাংশের সঙ্গে কম্পিউটার নির্মিত গ্রাফিকস ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে নির্দিষ্ট দিকে ধাবিত বাতাসের জোরালো প্রবাহ।
এর সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের ভার্চুয়াল রিয়েলিটির তফাৎ রয়েছে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে একটি হেডসেটে থ্রিডি গ্রাফিকস দেখা যায়। সেই সঙ্গে স্পর্শের অনুভূতি সৃষ্টির জন্য স্মার্ট গ্লাভস বা হাতে ধরার কন্ট্রোলার দিয়ে হেপটিক ফিডব্যাক দেয়া হয়।
তবে একটি ভার্চুয়াল বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করা, আর দুই ব্যক্তির মধ্যে স্পর্শের অনুভূতি এক নয়। কৃত্রিম স্পর্শের অনুভূতি যোগ করা হলে গ্লাভস বা কোনো কন্ট্রোলার ছাড়াই কোনো বস্তুকে ছোঁয়ার স্বাভাবিক অনুভূতি পাবে মানুষ।
আয়না ও কাচের ব্যবহার
দাহিয়া ও তার দল থ্রিডি ভার্চুয়াল ইমেজ তৈরির জন্য গ্রাফিকস ব্যবহার করেছেন। এটি অনেকটা ১৯ শতকের থিয়েটারে ভৌতিক অনুভূতি দেয়ার জন্য স্টেজে ব্যবহার করা পেপারস গোস্ট প্রযুক্তির মতো।
এই কৌশলে কাচ ও আয়না ব্যবহার করে একটি দ্বিমাত্রিক বস্তুর ইমেজ কোনো বাড়তি যন্ত্রাংশ ছাড়াই শূন্যে ভাসমান অবস্থায় দেখানো হতো। দাহিয়া ও তার গবেষকদের তৈরি স্পর্শের অনুভূতিটিও এ রকম শূন্য বা বাতাস দিয়েই তৈরি।
তারা যে পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন সেখানে ব্যবহৃত কাচগুলো পিরামিড আকৃতিতে সাজানো এবং শুধু এক দিকে উন্মুক্ত। ব্যবহারকারীরা উন্মুক্ত অংশে হাত ঢুকিয়ে ভেতরে কম্পিউটার সৃষ্ট ইমেজ ধরার চেষ্টা করেন। ইমেজগুলোকে দেখলে মনে হয় এরা পিরামিডের ওপর ভাসছে। ইমেজগুলো গ্রাফিকস দিয়ে তৈরি এবং ইউনিটি গেম ইঞ্জিন নামের একটি সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালিত। এই গেম ইঞ্জিনটি দিয়ে বিভিন্ন ভিডিও গেমের থ্রিডি পরিবেশ তৈরি করা হয়।
পিরামিডের ঠিক নিচে রয়েছে একটি সেন্সর। এটি মানুষের আঙুল ও হাতের নড়াচড়াকে খেয়াল করে। সেন্সরের সঙ্গে থাকা সরু নলগুলো হাতের আঙুল বা হাতের দিকে বাতাস প্রবাহিত করে। এতে করে তৈরি হয় স্পর্শের অনুভূতি। পুরো ব্যবস্থাটির জন্য রয়েছে একটি বিশেষ ইলেকট্রনিক হার্ডওয়্যার, যাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে বাতসের নলগুলোর নড়চড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য।
গবেষক দলটি একটি অ্যালগরিদম তৈরি করেছেন যা মানুষের হাতের নড়াচড়ার ওপর নির্ভর করে বাতাসের দিক ও গতি পরিবর্তন করে।
দাহিয়া ও তার দল অ্যারোহ্যাপ্টিক সিস্টেমের একটা নমুনাও দেখিয়েছেন। সেখানে বাস্কেটবলের ভার্চুয়াল প্রদর্শনীতে বলটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে ছোঁয়া সম্ভব হয়েছে। এমনকি একে রোল করা ও বাউন্স করাও সম্ভব। ব্যবহারকারীরা ফসকে যাওয়া বাস্কেটবল বাউন্সের পর ফের তালুবন্দি করার অনুভূতি পেয়েছেন। ভার্চুয়াল বলটিকে জোরে বা আস্তে ছোড়া সম্ভব এই উদ্ভাবনে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিগগিরই তারা এই হলোগ্রাম সিস্টেমে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ করতে যাচ্ছেন। এর ফলে প্রবাহিত বাতাসের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এতে গরম বা ঠাণ্ডা বস্তু অথবা বস্তুপৃষ্ঠের উষ্ণতা অনুভূত হবে। সেই সঙ্গে বাতাসে যোগ করা হবে গন্ধ। ফলে ভার্চুয়াল বস্তুটিকে স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে এর ঘ্রাণও পাওয়া যাবে।
অদূর ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির অফুরন্ত সম্ভাবনা দেখছেন দাহিয়া ও তার দল। ভিডিও গেম খেলার সময় কোনো পরিধানযোগ্য গ্যাজেট ব্যবহার করেও গেমে ডুবে থাকার বাস্তব অভিজ্ঞতা দেবে এই প্রযুক্তি। সেই সঙ্গে টেলিকনফারেন্সিংকে আরও জীবন্ত করে তুলবে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত খুলতে পারে এই উদ্ভাবন। এমন দিন হয়তো অচিরেই আসবে, যখন চিকিৎসকেরা রোগীর টিউমার দূর থেকেই ধরে, দেখে ও এ নিয়ে আলোচনা করে চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করে ফেলবেন।