বর্তমানে বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই উন্নত হয়েছে যে, একেকটা দেশ যেন আজ প্রতিবেশী একেকটা গ্রাম হয়ে উঠেছে। আর সবকিছুই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে। যদিও চাকা আবিষ্কারের পরেই মানব সভ্যতায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। এরপর থেকে প্রযুক্তির হাত ধরে নতুন নতুন আবিষ্কার চলমান পৃথিবীর রুপ পাল্টাতে সাহায্য করছে সবসময়।
আধুনিক প্রযুক্তি শুধু পৃথিবীর মধ্যেকার যোগাযোগ ব্যবস্থার দূরত্বই কমায়নি, যেভাবে চাকার আবিষ্কার যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দিয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে প্রযুক্তি মানুষের সামনে বিশাল মহাশূন্যের দুয়ার উন্মোচন করেছে। প্রযুক্তির এমন আবিষ্কারের জন্যে শত শতকোটি মাইল দূরের চাঁদ-তারা, গ্রহ-নক্ষত্র গুলোকে মানুষ তার হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রযুক্তির সাহায্যে রকেটের আবিষ্কার হয়েছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রের অস্ত্র হিসেবে। দূরের ঘাঁটিগুলোতে আক্রমনের অস্ত্র হিসেবে রকেট যুদ্ধক্ষেএে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। বিশ্বযুদ্ধ দুইটি পৃথিবীর সবকয়টি দেশকে আধুনিক যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরে মানুষের মনে যুদ্ধের প্রতি অনীহা তৈরি করে, এতে প্রত্যেকটি দেশই নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বিশ্ব পরাশক্তি গুলো সামরিক ও প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন ঘটাতে শুরু করলে রকেট প্রযুক্তির মাঝেও পরিবর্তন শুরু হয়।
রকেট প্রযুক্তিকে সফল ভাবে সর্বপ্রথম রাশিয়া মহাকাশ গবেষণার কাজে ব্যবহার করে। দেশটি ১৯৫৭ সালে কৃত্রিম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে। পিছিয়ে না থেকে পরের বছর আমেরিকাও তাদের প্রথম স্যাটেলাইট প্রেরণ করে। এই প্রযুক্তি এক ধাপ এগিয়ে যায় ১৯৬১ সালে, যখন রাশিয়া সফলভাবে একজন নভোচারীকে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরণ করেন। পরের বছরে আমেরিকাও পৃথিবীর কক্ষপথে নভোচারী প্রেরণ করে। রকেট প্রযুক্তির ওপর আগ্রহ ও প্রয়োজনীয়তা অনেকগুণ বেড়ে যায় আমেরিকার অ্যাপোলো মিশনের পর। এই মিশনটির মাধ্যমেই মহাকাশে প্রথম বারের মতো চাঁদের পৃষ্ঠে কোনো মানুষের পদচিহ্ন পড়ে।
চন্দ্রাভিযান পৃথিবীর সামনে মহাকাশ বিজ্ঞানের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত করে ফলে পৃথিবীর অনেক দেশই আগ্রহী হয়ে ওঠে। নতুন রুপে রকেট বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। কেননা অভিকর্ষ বলকে টেক্কা দিয়ে মহাশূন্যে পৌঁছানো রকেট ছাড়া সম্ভব নয়।
মহাকাশ গবেষণায় একের পর এক সফলতা অর্জন করেছে অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত দেশগুলো সেখানে মধ্যম বা নিম্ন আয়ের দেশের কাছে এটা চিন্তা করা এক কথায় বিলাসিতা। কেননা, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে স্পেসএক্স কোম্পানির পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট উদ্ভাবনের পর থেকে খরচ অনেকটা কমে আসে। স্পেসএক্স-এর রকেটগুলো একাধিক মিশনেও ব্যবহার করা যায় যে জায়গায় পূর্বে একটি রকেট শুধু একবারই ব্যবহার করা যেত।
আজ জানবো, স্পেসএক্স কোম্পানির একটি বিশেষ রকেট ‘স্টারশিপ’-এর ব্যাপারে। স্টারশিপ-কে বলা হয়ে থাকে এখন অবদি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহদাকৃতির রকেট, যেটির দ্বারা স্পেসএক্স মঙ্গল গ্রহে মানববসতি গড়ে তুলতে আগ্রহী।
স্পেসএক্স ও স্টারশিপ
বর্তমান বিশ্বে ‘এলন মাস্ক’-কে চেনেন অনেকেই এমন কে, বিশেষ করে আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করবো বা আমাদের সামান্য আইডিয়া আছে আশা করছি তারা সকলেই ‘এলন মাস্ককে চিনেন। এলন মাস্ক একজন সফল উদ্যোক্তা, তার এমন খেতাবের পেছনে রয়েছে নতুন ধরনের সব উদ্ভাবনী আইডিয়া।
‘স্পেসএক্স’ ২০০২ সালে আমেরিকায় যাত্রা শুরু করে। টানা কয়েক বছর অসফল থাকার পরেও হাল ছাড়েননি আর বর্তমানে মহাকাশ গবেষণায় এই ‘স্পেসএক্স’ সবচেয়ে সফল প্রাইভেট কোম্পানি। সাল ২০০৮ ‘স্পেসএক্স’ প্রথম পৃথিবীর অরবিটে লিকুইড ফুয়েল রকেট পাঠায়। এর পরেই নাসার সঙ্গে চুক্তি হয় এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন হয়ে কাজ করার সুযোগটা এসে যায়।
‘স্পেসএক্স’ ২০১০ সালে একটি মিশন পরিচালনা করে, মিশনে ড্রাগন ক্যাপসুল নামের মহাকাশযান পৃথিবীর অরবিট সফলভাবে ঘুরে আসতে সক্ষম হয়। প্রথম কোম্পানি যেটি নাসার একটি কার্গো সফলভাবে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পৌঁছে দিয় জন্ম দেয় ইতিহাসের।
ট্রাভেলের খরচ কমাতেই স্পেসএক্স উদ্ভাবন করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট, যেটি সত্যিকার অর্থেই স্পেস ট্রাভেলের খরচ কমাতে সক্ষম হয়েছে। সত্যি বলতে এলন মাস্কের স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল মহাকাশ ভ্রমণের খরচ যথাসাধ্য কমিয়ে আনার।
তার স্বপ্ন চাঁদের মতো একদিন মঙ্গলের মাটিতেও পা ফেলবে মানুষ। তবে চন্দ্রাভিযানের মতো মঙ্গলে কৃত্রিম বসতি গড়ে তোলা বিষয়টা সহজ হবে না। প্রযুক্তির সহায়তায় স্পেসএক্স এক বিশেষ রকেট নিয়ে কাজ শুরু করেছে, স্টারশিপ হলো সেই রকেট।
প্রথমেই আসা যাক ‘স্টারশিপ’ নামের ব্যাপারে। এলন মাস্ক ২০১৬ সালে এর কাজ শুরু করেন। প্রথমে এর নাম ঠিক করা হয়েছিল ইন্টার প্ল্যানেটারি ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, এরপর নাম পাল্টে পুরনো ফ্যালকন রকেটের সাথে মিলিয়ে রাখা হলো বিগ ফ্যালকন রকেট। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হলো স্টারশিপ নামটিই।
স্টারশিপের মোট দুইটি অংশের একটি হলো রকেট বুস্টার যেখানে মোট ৩৭টি র্যাপ্টার ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে। রকেট বুস্টারের কাজ হচ্ছে মূল যানটিকে অভিকর্ষ পার করে পৃথিবীর অরবিটে পৌঁছে দেওয়া, এবং স্টারশিপ যেহেতু সম্পূর্ণ পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি রকেট তাই মূল যানটি অরবিটে পৌঁছানোর পর বুস্টারটি আবার পৃথিবীতে অবতরণ করবে নির্দিষ্ট ল্যান্ডিং প্যাডে। বুস্টারে ব্যবহৃত র্যাপ্টার ইঞ্জিনগুলোর যদি বিশেষ কোন সমস্যা না হয় তবে অনায়াসে ১ হাজারবার ব্যবহারযোগ্য, স্পেসএক্সের অন্যান্য ফ্যালকন রকেটগুলো ছিল লিকুইড অক্সিজেন দ্বারা চালিত, তবে অত্যাধুনিক এই র্যাপ্টার ইঞ্জিন চলবে লিকুইড অক্সিজেন ও লিকুইড মিথেনে।
স্টারশিপের অপর অংশটি মূল যান। যেখানে রয়েছে ৬টি র্যাপ্টার ইঞ্জিন। ভূমি থেকে অরবিটে পৌঁছে বুস্টার আলাদা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটি রকেট পাঠানো হবে এবং সেটি মূল যানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রি-ফুয়েলিং করে দেবে, যেন মূল যানটি নির্ধারিত মিশন চাঁদ কিংবা মঙ্গলে পৌঁছাতে পারে। রকেট বুস্টার এবং মূল যানের সম্মিলিত রূপই হচ্ছে স্টারশিপ।
স্টারশিপের উচ্চতা ১২০ মিটার । এই মহাকাশ যানটি একটি দূরপাল্লার মিশন, যেমন- চাঁদ অথবা মঙ্গলে একসাথে ১০০ যাত্রীসহ অসংখ্য কার্গো বহন করতে সক্ষম। এছাড়াও এর মোট ধারণ ক্ষমতা ১৫০ মেট্রিক টন যা ২১টি আফ্রিকান হাতির সমান।
রকেটটি তৈরি হবে সম্পূর্ণ স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে। পূর্বের রকেটগুলো কার্বন ফাইবারের হলেও এখানে স্টিল ব্যবহার করার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। একে তো এতে করে খরচ কমে যাবে, আরেকদিকে মঙ্গলে প্রতি ঘন্টায় ১৭ হাজার মাইল গতিতে ল্যান্ডিংয়ের সময় যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হবে তা কার্বন ফাইবারের পক্ষে সহনীয় নয়।
টেক্সাসে স্টারশিপের নির্মাণকাজ চলছে, বানানো হচ্ছে অসংখ্য প্রোটোটাইপ স্টারশিপ, যে নমুনাগুলোর মাধ্যমে চূড়ান্ত মিশনের আগে বিভিন্ন পরীক্ষা চালানো হবে। প্রথমদিকে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা ব্যর্থ হলেও সর্বশেষ খবর বলছে স্টারশিপের একটি নমুনা এসএন-৫ ভূমি থেকে ১৫০ মিটার উচ্চতায় সফলভাবে উড্ডয়ন করেছে।
প্রজেক্টটির অধিকাংশ অর্থ আসছে এলন মাস্কের স্টারলিংক নামের অন্য একটি প্রজেক্ট থেকে, যেটি একসময় পুরো পৃথিবীর সব প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলোতে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করেছে স্পেসএক্স। এটি ছাড়াও জাপানি একজন ধনকুবের ইয়ুসাকু মুজওয়া অর্থের জোগান দিচ্ছেন প্রজেক্ট স্টারশিপে। যাকে প্রথমবারের মতো একজন বাণিজ্যিক যাত্রী হিসেবে চাঁদে নিয়ে যাবে স্পেসএক্স। স্টারশিপ সম্পূর্ণ প্রস্তুত হলে চাঁদে একটি মিশন পরিচালনা করা হবে মঙ্গলে যাওয়ার পূর্বে। বলা হয়েছে ২০২৪ সালে যাত্রা করা হবে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে, তবে ২০২৪ সাল টিকেই চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা হয়নি।
মহাকাশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে স্টারশিপ তৈরির কাজ শুরু হলেও এ নিয়ে আছে আরো এক যুগান্তকারী ভাবনা। সেটা হচ্ছে ৩৫-৪০ মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারটা! এমনটাই সম্ভব করতে যাচ্ছে মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানি। এছাড়াও স্টারশিপকে ব্যবহার করা হতে পারে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের কাজেও। আর এই ভ্রমণে খরচটি যেন এরোপ্লেন বিজনেসের কাছাকাছিই বা সমপরিমাণ হয় সেটাই দেখা হবে।
এলন মাস্কের প্রজেক্টটি সফল না-ও হতে পারে, তবে মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এই জঞ্জালপূর্ণ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ সুন্দর সময়ের আশায় দিন কাটায়। মঙ্গলে যাবার স্বপ্নটিও পৃথিবীর মানুষের কাছে তেমনই একটি আশা, যে অপেক্ষার অবসান হবে একসময়। ‘দ্য রেড প্ল্যানেট মঙ্গলে’ মানুষ নিশ্চয়ই একদিন পৌঁছে যাবে।