নভেল করোনাভাইরাস ডিজিজ বা কভিড-১৯ নিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে বিশ্ব নেতৃত্ব। মরণঘাতী ভাইরাসটি মোকাবেলায় সম্ভাব্য সব ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ প্রয়োগ করেও রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বৈশ্বিক রথী-মহারথীরা। কোনো প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন না থাকায় ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের কৌশল রপ্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে অনেক দেশ। এমনকি এসব কৌশল রপ্ত করতে রীতিমতো সাইবার স্পাইং বা সাইবার গোয়েন্দাগিরি চলছে বলেও জানিয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। আর এমন সাইবার স্পাইংয়ের অভিযোগ উঠেছে ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে। করোনা মোকাবেলায় কৌশল রপ্ত করতে চীনের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের চেষ্টা হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এ তথ্যের পর নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তাহলে কি ভিয়েতনামের করোনা মোকাবেলায় সফলতার মূল কারণ হ্যাকিং থেকে প্রাপ্ত তথ্য।
চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে গত বছরের একেবারে শেষ সময়ে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এরপর থেকে দ্রুত এটি সারা বিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ২৩ জানুয়ারি প্রথম চীনের প্রতিবেশী দেশ ভিয়েতনামে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়। তবে এত দীর্ঘ সময় পরও ভাইরাসটি দেশটিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। দেশটিতে এখন পর্যন্ত সংক্রমিতের সংখ্যা ৩০০-এর নিচে। ভাইরাসটি মোকাবেলায় দেশটির দ্রুত নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ কার্যকর হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করে কৌশল রপ্ত করেছে ভিয়েতনাম। মার্কিন সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক ফার্ম ফায়ারআই গত বুধবার এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, ভিয়েতনামের সরকার সমর্থক হ্যাকাররা চীন কীভাবে মহামারী মোকাবেলা করছে, সেটি জানার জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে।
ফায়ারআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিয়েতনামের হ্যাকাররা শুরু থেকেই চীনের মিনিস্ট্রি অব ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এবং উহান সরকারের কর্মকর্তাদের ওয়েবসাইট টার্গেট করে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক কভিড-১৯ নিয়ে সতর্ক বার্তা দেয়ার একদিন পর গত ৬ জানুয়ারি প্রথম হ্যাকিংয়ের চেষ্টা করে তারা। আর এপ্রিল পর্যন্ত এ হ্যাকিং চেষ্টা অব্যাহত ছিল।
ফায়ারআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপিটি-৩২ নামে পরিচিত হ্যাকিং গ্রুপটি ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট মন্ত্রণালয় এবং উহানের সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ও অফিশিয়াল মেইল হ্যাক করার চেষ্টা করে। প্রতিষ্ঠানটির অনুসন্ধানকারী এবং অন্যান্য সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক ফার্মগুলো মনে করে, এপিটি-৩২ নামের ওই হ্যাকিং গ্রুপটি ভিয়েতনাম সরকারের হয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে এ মহামারী মোকাবেলায় তারা বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক এজেন্সিগুলো থেকে তথ্য হাতিয়ে নিতে কাজ করছে।
ফায়ারআইয়ের ম্যান্ডিয়েন্ট থ্রেট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক বেন রিড বলেন, এসব সাইবার আক্রমণ প্রমাণ করে যে ভাইরাসটি ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তথ্য পাওয়ার জন্য এখানে সবাই সবকিছুই করছে।
নিউইয়র্কের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম সিগেল মনে করেন, হ্যাকিং কার্যক্রম থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, ভাইরাসটির বিষয়ে আগাম জানতে হ্যানয় দ্রুত সাইবারস্পেস ব্যবহার করেছে। যে কারণে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা এটির বিষয়ে জানতে পেরেছে।
ফায়ারআই বলছে, এপিটি-৩২ মূলত ছোট ছোট গ্রুপ করে হ্যাকিং টার্গেট করে। সে অনুযায়ী, তারা ট্র্যাকিং লিং সংযুক্ত করে টার্গেট ব্যক্তিদের কাছে মেইল পাঠায়। এর ফলে ই-মেইল ওপেন করার সঙ্গে সঙ্গে হ্যাকাররা বুঝতে পারে। আর তখন আরো ম্যালওয়ার দিয়ে মেইল পাঠানো হয়। যেখানে মেটালজ্যাক নামে একটি ভাইরাস পাঠানো হয়, যা হ্যাকারদের ব্যবহারকারীর কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নিতে সহায়তা করে।
স্লোভাকিয়াভিত্তিক সফটওয়্যার সিকিউরিটি ফার্ম ইএসইটির গবেষক ম্যাক ইত্তিনি লেভিলি জানান, এপিটি-৩২ হ্যাকিং গ্রুপটি চীন ছাড়াও সম্প্রতি পূর্ব এশিয়ার দেশের সরকারি ও বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর ওয়েবসাইট টার্গেট করে একই ধরনের ম্যালওয়ার পাঠিয়েছে। এছাড়াও ভিয়েতনামের ভিন্ন মতাবলম্বীদেরও এই ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে টার্গেট করা হয়।
তবে ফায়ারআইয়ের এমন দাবির বিষয়ে রয়টার্সের পক্ষ থেকে জানতে ভিয়েতনাম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করেনি। একইভাবে সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব চায়না (সিএসি), মিনিস্ট্রি অব ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এবং উহান সরকারও এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে দূরে রয়েছে।
যে কারণে এটা অস্পষ্ট যে চীনকে টার্গেট করে ভিয়েতনামের হ্যাকিং গ্রুপ যে অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা করেছিল, সেটি আদৌ কতটুকু সফল হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ হ্যাকিং চেষ্টার পর পরই দেশটির রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়।
তবে ভিয়েতনামের হ্যাকাররা চীনে হ্যাকিংয়ে সফল হোক আর না হোক কভিড-১৯-এর ফলে উদ্ভূত সংকট মোকাবেলায় অন্যান্য দেশের কার্যকর হাতিয়ার বা পদ্ধতি জানার জন্য গোয়েন্দা এবং হ্যাকিং গ্রুপ আগামীতেও যে সাইবারস্পেস চষে বেড়াবেন, এটিতে একমত হয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র: রয়টার্স ও সিনেট ডটকম