‘বিকাশ কাস্টমার কেয়ার থেকে বলছি। আপনার বিকাশ অ্যাকাউন্টটি ব্লক করা হয়েছে। অ্যাকাউন্টটি স্বাভাবিক করতে হলে আমাদের কিছু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। নাম-ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার, সর্বশেষ লেনদেন কবে, কত? মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে ৬ ডিজিটের একটি সংখ্যা প্রেরণ। এরপর সংখ্যা জিজ্ঞেস করার কিছুক্ষণ পর অ্যাকাউন্টের সব টাকা উধাও! নাম্বার বন্ধ।’
বিকাশ অ্যাপস ব্যবহার করে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে শত শত মানুষের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্রের সদস্যরা। এবার প্রতারণার নতুন কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে চক্রটি। ভুয়া রেজিস্ট্রেশনকৃত মোবাইল নাম্বারের মাধ্যমে ফোন করে বিভিন্ন এমপি-মন্ত্রীর পরিচয় দিয়ে বিকাশের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
কৌশলটি বাস্তবায়নে টার্গেট করছে সমাজের প্রভাবশালী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিকদের। এসব ব্যক্তিরা প্রতারণার শিকার হয়েও লজ্জায় কাউকে কিছু বলছেন না। সম্প্রতি এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও চট্টগ্রাম-৭ আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের পরিচয়ে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২১ জুন বেলা ১১টায় বিবিএস ক্যাবলস লিমিডেটের সিলেট শাখার ম্যানেজার জেএইচএম নাজমুল হুদাকে ফোন দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম্বার চায়।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওই নাম্বারে ফোন দিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিশেষ প্রয়োজনে ওই নাম্বারে এক লাখ টাকা বিকাশ করতে বলে। সরাসরি যোগাযোগ করলে বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন। পরে কোম্পানির পক্ষে নাজমুল এসএমপির কোতোয়ালী থানায় ১২১৮নং সাধারণ ডায়েরি করেন।
অপরদিকে ২৫ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টায় খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে ফোন দিয়ে চট্টগ্রাম-৭ আসনের এমপি মোস্তাফিজুর রহমান পরিচয় দিয়ে বলে, তার আপন ছোট ভাইসহ তিনজন সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তার ভাইসহ আহতদের সাহায্য করার অনুরোধ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই নাম্বারটি পাঠান সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের মোবাইলে। চট্টগ্রামের এমপির ভাইকে সার্বিক সহযোগিতার নির্দেশ দেন।
কামরান তাৎক্ষণিক সহযোগিতার জন্য ওসমানী হাসপাতালের নার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইসমাঈল আলী সাদেককে নির্দেশ দেন এবং মন্ত্রীর পাঠানো নাম্বারটি সাদেককে দেন। ওই নাম্বারে ফোন দেন সাদেক।
এরপর এমপি মোস্তাফিজ পরিচয়দানকারীর অনুরোধে সাদেক তার পাঠানো নাম্বারে ৫১ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে সাদেক বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন বলেন, ঘটনাটি আমি শোনার পর অবাক হয়েছি।
পুলিশ এই প্রতারকদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। আর চট্টগ্রাম-৭ আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হয়তো কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আমার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন এমপি-মন্ত্রীর কাছে টাকা চাচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক লোকের ৫০ হাজার ও জামালপুরের আমার ঘনিষ্ঠ এক সংসদ সদস্যের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদিকে অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিকাশ অ্যাপেসের মাধ্যমে চক্রটি যেকোনো নাম্বার দিয়ে ‘গোপন নাম্বার ভুলে গেছেন?’
অপশনে ক্লিক করলে ওই নাম্বারে ৬ ডিজিটের একটি কোর্ড চলে যায়। তাৎক্ষণিক ওই কোর্ডটি নিয়ে অ্যাকাউন্টে ডুকে সব তথ্য জেনে নেয়। পরে বিকাশের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়ে বলে গোপন নাম্বার ভুলে গেছি।
কাস্টমার কেয়ারকে সব তথ্য দিয়ে নতুন গোপন নাম্বার নেয়। এরপর অ্যাকাউন্টের সব টাকা নিয়ে যায়। এরকম প্রতারণার শিকার শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল মোমেন জীবন। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তিনি থানায় অভিযোগ করেননি।
মামলা ও জিডি দুটিই গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিবিএস ক্যাবলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে টাকা চাওয়া নাম্বারের কললিস্ট খতিয়ে একটি নাম্বারে সবচেয়ে বেশি কথা বলার তথ্য মিলে।
ওই নাম্বারটি ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ-উত্তরের দফতর সম্পাদক রবিউল আলমের। রবিউল পুলিশকে জানান, ওই নাম্বারে ফোন করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে তার কাছ থেকেও ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
তিনি লজ্জায় বিষয়টি কাউকে বলেননি। এমপি মোস্তাফিজ ও তার ভাই পরিচয়ে টাকা নেয়া নাম্বারগুলোর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। শিগগির এই চক্রটিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন জিডি এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও এসএমপির কোতোয়ালি থানার সোবহানিঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ অনুপ কুমার চৌধুরী।
বিকাশের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা শামছুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, গ্রাহকদের কথার জালে ফেলে প্রতারণা করছে চক্রটি। এজন্য আমরা সবসময় বলে আসছি ‘পাসওয়ার্ড’ কোনোভাবেই কাউকে বলবেন না। শুধু ভেরিফিকেশন কোর্ড জেনে লেনদেন করা সম্ভব নয়। সৃত্র :যুগান্তর