প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে ঝুঁকছে তরুণ প্রজন্ম। তাই দক্ষতা ও আয় বাড়াতে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তরুণদের প্রশিক্ষিত করার উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। তবে এ খাতের বড় সমস্যা হলো নিয়মিত বেতনভিত্তিক চাকরির সুযোগের স্বল্পতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় আইসিটি খাতে।
বর্তমানে আইসিটি খাতে নিয়োজিতদের প্রায় ৮৮ শতাংশই চুক্তিভিক্তিক। মাত্র ১২ শতাংশ চাকরি স্থায়ী ও বেতনভিত্তিক। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘সার্ভে অন আইসিটি জব মার্কেট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে বেসিস। এর তথ্যমতে, আইসিটি খাতে প্রায় ৮৭ দশমিক ৯ শতাংশ নিয়োগ চুক্তিভিক্তিক ও ১২ দশমিক এক শতাংশই স্থায়ী। তবে এ খাতের চাকরিজীবীর বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। এর মধ্যে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে ৪৪ দশমিক ৩১ শতাংশ, স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত বা ডিগ্রিধারী রয়েছে ৩৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী বা ডিগ্রিধারী রয়েছে ১১ দশমিক তিন শতাংশ। এছাড়া এইচএসসি পাস রয়েছে চার দশমিক ২৪ শতাংশ, এসএসসি পাস এক দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী এক দশমিক ২০ শতাংশ।
আইসিটি খাতে নিয়োজিতদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ৫৪ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩০ বছর। আর ৩১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী রয়েছে ২৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ কর্মী ও ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সী রয়েছে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ কর্মী। এছাড়া ৩৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী রয়েছে ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ কর্মী। আর ৪০ বছরের বেশি এমন চাকরিজীবীর সংখ্যা ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ। তবে সবচেয়ে কম ২১ বছরের কম বয়সী। মাত্র এক দশমিক ৭৫ শতাংশ কর্মী এ বয়সের। যদিও আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান এখনও পুরুষের দখলে। এ খাতে নিয়োজিতদের মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ নারী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাজের চাহিদা বাড়লেও চুক্তিভিক্তিক ও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে হওয়ায় বিভিন্ন সময় ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছেন এ খাতের চাকরি প্রার্থীরা। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে তরুণদের একটি বড় অংশ অন্য খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারায় আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফলে একদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে বাংলাদেশ আউটসোর্সিংয়ে যেমন শক্তিশালী হচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও সহায়ক হচ্ছে। তবে এটি ধরে রাখতে হবে। যদিও আমাদের দেশে অনেক থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রাপ্য সুবিধা প্রদানে অনীহা দেখায়। তাই এ খাতে সরকারের মনিটরিং বাড়ানো উচিত। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের কারণে পুরো সেক্টরের বদনাম যাতে না হয়। এই শিল্পকে কর্মীবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে।
তারা আরও জানান, ‘বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দেশের প্রথম খাত হিসেবে তৈরি পোশাকশিল্প প্রধান ভূমিকা রেখে আসছে। তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে পেশার ধরন বদলে গেছে। বিপিও খাতে বিশ্বের বর্তমান বাজার ৫০ হাজার কোটি ডলার, যেখানে বাংলাদেশ আয় করছে মাত্র ৩০ কোটি ডলার। তবে উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কোরিয়ায় শ্রমশক্তি হ্রাস পাওয়ায় আউটসোর্সিং খাতে বাংলাদেশের জন্য দরজা খুলে গেছে। ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ ১০০ কোটি ডলার আয় করতে পারবে বলে ধারণা করছেন খাত বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ আমিনুল হক বলেন, ‘আউটসোর্সিংয়ে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে। তবে আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় দেশে প্রচুর কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ খাত থেকে আয়ে প্রধানমন্ত্রীর ৫০০ কোটি ডলারের যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়নে সবার যৌথভাবে কাজ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ খাতে উন্নয়নের জন্য সরকারকে আরও সহায়ক ভূমিকা রাখতে হবে। আউটসোর্সিংয়ে সম্পূর্ণভাবে ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে। ইন্টারনেট ডেটার খরচ কমাতে হবে। কম খরচ নিশ্চিত না হলে এ খাতে কাজ দিতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহী হবে না।’
এদিকে থার্ড পার্টির মাধ্যমে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর কল সেন্টার পরিচালিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভদের (সিএসআর)। মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো একজন রিপ্রেজেন্টেটিভের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করছে, তার প্রায় অর্ধেক টাকা কেটে নেয় থার্ড পার্টির প্রতিষ্ঠানগুলো, যা চাকরিজীবীদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া কল সেন্টারে কাস্টমারদের সঙ্গে প্রতিদিন টানা পাঁচ-ছয় ঘণ্টা কথা বলাটাও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে কল সেন্টার তৈরি করে রাতারাতি বড় লোক হচ্ছেন এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। একজন রিপ্রেজেন্টেটিভের জন্য মোবাইল ফোন অপারেটর, ব্যাংক ও বিদেশি কোম্পানিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যপরিচালনায় যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করে, তার প্রায় ৬০ শতাংশও রিপ্রেজেন্টেটিভকে প্রদান করা হয় না। অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ টাকাই কেটে নিচ্ছে দেশের থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে ‘কল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন’কে ভূমিকা রাখা দরকার বলেও মনে করেন তারা।