লি বিয়ং চল। বিশ্বখ্যাত এক ইলেকট্রনিকস পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৩৮ সালে নতুন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন তিনি। এটা ছিল অনেকটা গুদাম ঘরের মতো। শহরের মধ্যে যে সব মুদি দোকান রয়েছে সেখানে পণ্য পরিবহন করত তারা। লি বিয়ং চল কিংবা দক্ষিণ কোরীয়বাসী কখনো ভেবেছিলেন ছোট্ট এই প্রতিষ্ঠানটি একদিন মাল্টি-বিলিয়ন ডলার কোম্পানীতে পরিণত হবে। হয়ত না। কিন্তু এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে লি বিয়ং চল। অবিশ্বাস্য উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে নিজেদের আদি ব্যবসাকে পেছনে ফেলে প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর বুকে নতুন দৃষ্টা›ত স্থাপন করেছে। হয়েছে বিশ্বখ্যাত টেক জায়ান্ট। প্রতিষ্ঠানটির নাম স্যামসাং।
যাত্রা শুরুর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্মাণ শিল্প, বীমা, খুচরা ব্যবসা এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্প। ১৯৭০ সালে স্যামসাং সর্বপ্রথম তাদের নিজেদের তৈরি সাদা-কালো টেলিভিশন বাজারে উন্মোচন করে। টেলিভিশনটির আকার ছিল ১২ ইি ।
উদ্ভাবনের লক্ষ্যে স্যামসাং মোবাইল প্রযুক্তির দিকে মনোনিবেশ করে। স্মার্টফোনের যে বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে তা গ্রাহকদের মাঝে স্যামসাং-ই পরিচয় করিয়ে দেয়। ১৯৯৯ সালে স্যামসাং বিশেষ টিভি ফোন বাজারে নিয়ে আসে। এর ফলে বিনোদন গ্রাহকদের হাতের মুঠোয় চলে আসে। এবং একই বছর বাজারে আসা স্যামসাং বি৬০০ ফোনের ১০ মেগাপিক্সেল বিল্ট-ইন ক্যামেরার মাধ্যমে গ্রাহকরা উন্নত মানের ছবি তুলতে পেরেছে।
২০০২ সালে ট্রু কালার ফোন উন্মোচনের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে অ্যাক্টিভ ম্যাট্রিক্স এলসিডি ডিসপ্লের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেয় স্যামসাং, যা মোবাইল ডিসপ্লে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন দিগনেÍর উন্মোচন হয়। এর মধ্য দিয়েই স্যামসাং-এর গ্যালাক্সি সিরিজের যাত্রা শুরু হয়। এর পরের বছরগুলোতে গ্যালাক্সি সিরিজের ডিভাইসগুলো গ্রাহকদের দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন মাইলফলক অর্জন করে। গ্যালাক্সি নোট সিরিজ-এর মাধ্যমে স্যামসাং নতুন ক্যাটাগরির স্মার্টফোন- ফ্যাবলেট-এর সাথে গ্রাহকদের পরিচয় করিয়ে দেয়। মজার বিষয় হলো, এই স্মার্টফোনটি ব্যাপকভাবে প্রতিযোগীরা নকল করতে শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ মোবাইল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম স্যামসাং।
সাদা-কালো যুগের অবসানের পর প্রতিষ্ঠানটি তাদের ক্রেতাদের মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স পণ্য এবং হোম অ্যাপলায়েন্স পণ্যে কাটিং-এজ প্রযুক্তির সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত রয়েছে একদল দক্ষ ডিজাইনার, প্রকৌশলী, বিপণনকারী, নৃতাত্ত্বিক, সংগীত শিল্পী এবং লেখক, যারা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারকারীদের সাংস্কৃতিক, প্রাযুক্তিক এবং অর্থনৈতিক ধারা নিয়ে কাজ করে।
পণ্যের নতুন নতুন ডিজাইন তৈরিতে স্যামসাং অপ্রতিরোধ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকটি পুরস্কার তাদের ঝুলিতে যোগ করেছে। স্যামসাং-এর টেলিভিশনগুলোর নিত্য নতুন ডিজাইন প্রচলিত সব ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছে। গত ১৩ বছর ধরে টিভি বিক্রিতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে স্যামসাং। ২০০৬ সালে এলসিডি ডিসপ্লে সমৃদ্ধ বোর্দো টিভি উন্মোচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির নাম্বার ওয়ানের জয়যাত্রা শুরু হয়।
পানীয় পান করার বিশেষ গোলাকার গ্লাসের আকার থেকে উজ্জীবিত হয়ে, বোঁদো সিরিজের টিভির মাধ্যমে টেলিভিশন নকশায় নতুন যুগের সূচনা করেছে স্যামসাং। প্রায় দুই বছর পর স্যামসাং বিশ্বের প্রথম এজ-লিট টিভি বাজারে নিয়ে আসে। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বকে এলইডি টিভির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এর দুই বছর পর স্মার্ট টিভির উন্নয়নে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখায় প্রতিষ্ঠানটি। এই স্মার্ট টিভির মাধ্যমে টিভিতে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায় ব্যবহারকারীরা। নতুন প্রযুক্তির টিভি বাজারে নিয়ে আসতে প্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে রয়েছে বাঁকানো (কার্ভড) ওএলইডি এবং হালের কিউএলইডি এইটকে টিভি।
শুধুমাত্র ইলেকট্রনিকস পণ্যের ক্ষেত্রেই নয়, বিভিন্ন ধরনের ঘরোয়া এবং রান্নাঘরের সরঞ্জামের উন্নয়নেও অগ্রগামী স্যামসাং। প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবনী এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য পণ্য বাজারে থাকা সাধারণ পণ্যকে পিছনে ফেলে বাজারে শীর্ষস্থানে রয়েছে। প্রিমিয়াম এবং উদ্ভাবনী পণ্য দিয়ে বাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে স্যামসাং। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভয়েস রিকগনেশন প্রযুক্তির রেফ্রিজারেটর; যা পারিবারিক যোগাযোগে সহায়ক, ফ্লেক্সওয়াশ ওয়াশিং মেশিন একই সাথে অথবা আলাদাভাবে কাপড় পরিষ্কারে সক্ষম এবং উইন্ডফ্রি এয়ার কন্ডিশন-এর মাধ্যমে সরাসরি বাতাস ছাড়া ঘরকে ঠান্ডা রাখে।
স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের দ্রুত উত্থান এবং কারিগরি প্রযুক্তিতে অসাধারণ অর্জন সেমি-কন্ডাক্টর শিল্পেও প্রতিষ্ঠানটিকে শীর্ষস্থানে নিয়ে এসেছে। ১৯৯৫ সালে ৪ মেগাবিট চিপ নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি শীর্ষস্থানীয় ডায়নামিক র্যানডম-অ্যাকসেস মেমোরি (ডিআরএএম) নির্মাণে শীর্ষস্থান দখল করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি মেমোরি চিপ উৎপাদনে শীর্ষস্থানে রয়েছে।
গত ৫০ বছরে উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে প্রযুক্তি খাতে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে স্যামসাং। খুব শিগগিরই ইলেকট্রনিকস শিল্পে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গ্রাহকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে স্যামসাং তাদের এই উদ্ভাবনের ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বিশ্বকে চমকে দেবে.