বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরিতে কোবাল্ট গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়। বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় অর্ধেক কোবাল্ট সরবরাহকারী দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো (ডিআরসি)। তবে মধ্য আফ্রিকার দেশটিতে এ খনিজ আহরণে শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয়। বহুজাতিক বৃহৎ প্রযুক্তিপণ্য প্রস্তুতকারকরা কোবাল্ট আহরণে শিশুশ্রম জড়িত থাকার বিষয়টি জেনেও নিজেদের স্বার্থে কঙ্গো থেকে তুলনামূলক কম মূল্যে খনিজ পদার্থটি সংগ্রহ করে আসছে। এমন অভিযোগে প্রযুক্তিপণ্য প্রস্তুতকারক অ্যাপল, গুগল, মাইক্রোসফট, ডেল এবং গাড়ি নির্মাতা টেসলার বিরুদ্ধে মামলা করেছে একটি আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ। খবর সিএনএন বিজনেস।
গত রোববার ওয়াশিংটন ডিসিতে এ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্লাস অ্যাকশন মামলা করে আন্তর্জাতিকভাবে অধিকার নিয়ে কাজ করা অ্যাডভোকেটদের একটি দল। এ গ্রুপটির কার্যক্রমও পরিচালিত হয় ওয়াশিংটন ডিসি থেকে। অভিযোগ করা হয়, কঙ্গোয় কোবাল্ট আহরণে অমানবিক এবং ভয়ংকর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুশ্রম জড়িয়ে থাকার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানগুলো জানে। তার পরও তারা নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে কঙ্গো থেকে কোবাল্ট সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সতর্কতা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানগুলো কঙ্গোয় কোবাল্ট আহরণে শিশুশ্রম বন্ধে বিষয়টি আমলে নিয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এর আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছিল, ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও বৃহৎ প্রযুক্তিপণ্য প্রস্তুতকারকরা খতিয়ে দেখে না যে, তাদের পণ্যে ব্যবহূত কোবাল্ট আহরণে অমানবিক শিশুশ্রম জড়িয়ে আছে কিনা। প্রায় দুই বছর আগেই অ্যাপল, স্যামসাং, মাইক্রোসফট ও সনির মতো প্রযুক্তি জায়ান্টগুলোর বিরুদ্ধে শিশুশ্রমের অভিযোগ তুলেছিল সংস্থাটি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগের পর কঙ্গোয় কোবাল্ট আহরণে শিশুশ্রম বন্ধের উদ্যোগ নেয় বেশকিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল এগিয়ে রয়েছে। তবে দেশটিতে কোবাল্ট উত্তোলনে শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে গুগল, মাইক্রোসফট, ডেল ও টেসলার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো কোবাল্ট। বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় অর্ধেক কোবাল্ট উৎপাদিত হয় কঙ্গোয়। দেশটিতে কোবাল্ট আহরণে সাত বছর বয়সী শিশুদেরও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করতে দেখা যায়। খনিতে কাজ করা শ্রমিকরা দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য জটিলতায় আক্রান্ত হন। একই সঙ্গে অনিরাপদ অবস্থায় প্রাণঘাতী খনি দুর্ঘটনায় নিয়মিত শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটছে। এ ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন খনি শ্রমিকরা।
কঙ্গোয় এক-পঞ্চমাংশ কোবাল্ট আহরণ করা হয় শিশুদের মাধ্যমে বিপজ্জনক পরিবেশে। তবে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এ অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করছে, তারা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে থাকে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, কঙ্গোয় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শিশুদের মাধ্যমে আহরণ করা কোবাল্ট থেকে মুনাফা করা হচ্ছে না—এ বিষয় প্রমাণে প্রতিষ্ঠানগুলোর যথেষ্ট দায়দায়িত্ব রয়েছে।
২০১৬ সালের শুরুর দিকে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২৯টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কোবাল্ট আহরণে শিশুশ্রম বন্ধের উদ্যোগ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এক্ষেত্রে শিশুদের মাধ্যমে আহরিত কোবাল্ট বর্জনে এগিয়ে রয়েছে অ্যাপল। অ্যাপল প্রথম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোবাল্ট সরবরাহকারীদের নাম প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে অন্য ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ডগুলো খুব সামান্যই অগ্রগতি করতে পেরেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর আগে আফ্রিকান রিসোর্চ ওয়াচের সঙ্গে যৌথভাবে করা প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, কীভাবে ব্যবসায়ীরা শিশুশ্রমে ভরা খনিগুলো থেকে কোবাল্ট কিনে কঙ্গো ডংফ্যাং মাইনিং ইন্টারন্যাশনালের (সিডিএম) কাছে বিক্রি করছে। সিডিএম থেকে এসব কোবাল্ট যায় মূল কোম্পানি চীনা মালিকানাধীন ঝেজিয়াং হুয়াওয়ে কোবাল্ট লিমিটেডের কাছে। অবশ্য প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঝেজিয়াং হুয়াওয়ে কোবাল্ট সংগ্রহে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে এখনো বিষয়টি ঘিরে তথ্য বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
হুয়াওয়ে পরবর্তী সময়ে এক বিবৃতিতে জানায়, দরিদ্রতার কারণে কঙ্গোয় শিশুশ্রম পুরোপুরি রোধ করা কষ্টসাধ্য কাজ। বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজের কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসবের মধ্যে রয়েছে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা এবং ঋণদানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায় উদ্যোক্তা বাড়ানো।
অ্যামনেস্টি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ২৬টি শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান তাদের কোবাল্ট সরবরাহকারীদের তালিকা প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছে।