চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বিশ্বের বৃহৎ চুক্তিভিত্তিক ইলেকট্রনিকস নির্মাতা ফক্সকনের মুনাফা কমেছে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ায় অ্যাপলের মতো অন্যতম ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পণ্যের চাহিদা কমায় মুনাফা কমেছে। গত সোমবার প্রতিষ্ঠানটির জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের আর্থিক খতিয়ানে এমন তথ্য জানানো হয়। খবর রয়টার্স।
তাইওয়ানভিত্তিক ফক্সকন চীনে স্থাপিত কারখানায় অ্যাপলের আইফোন সংযোজনের কাজ করে আসছে। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে নিজেদের নিট মুনাফা ৪ হাজার ৭৭৬ কোটি তাইওয়ানিজ ডলারে দাঁড়ানোর তথ্য দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি, যা বিশ্লেষকদের পূর্বাভাসকৃত নিট মুনাফা ৪ হাজার ৬৯৪ কোটি তাইওয়ানিজ ডলারের চেয়ে কিছুটা বেশি। তবে তা গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের নিট মুনাফার চেয়ে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ কম। গত বছর জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ৬ হাজার ২৬১ কোটি তাইওয়ানিজ ডলারে পৌঁছেছিল।
চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান নভেল করোনাভাইরাসের উত্পত্তিস্থল। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে উহানে প্রথম নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে সৃষ্ট রোগ কভিড-১৯ আক্রান্ত শনাক্ত হয়। এরপর উহান লকডাউন ঘোষণা করে চীন। কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো স্মার্টফোন উৎপাদন কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছিল ফক্সকন।
বিবৃতিতে ওই সময় ফক্সকন জানায়, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অন্যান্য শিল্পের মতো স্মার্টফোন উৎপাদন শিল্পেরও কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। আমরা চীনে স্মার্টফোন উৎপাদন কারখানাগুলোর কর্মীদের অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের আর্থিক খতিয়ানে।
গত মাসের শেষ দিকে ফক্সকনের প্রতিষ্ঠাতা টেরি গো বলেন, চীনে নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরেছে। কর্মীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজে যোগ দিচ্ছেন। চীনে স্থাপিত স্মার্টফোন কারখানাগুলোর কার্যক্রম প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরছে।
অ্যাপলের প্রধান চুক্তিভিত্তিক পণ্য সরবরাহকারী ফক্সকনের সিংহভাগ উৎপাদন কারখানা চীনে অবস্থিত। এর সরবরাহকারীদেরও বেশির ভাগই চীনে অবস্থিত। নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়লে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের রাজস্ব ১৫ শতাংশ হ্রাসের পূর্বাভাস দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে প্রান্তিকটিতে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি কমেছে, যা গত সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
টেরি গো আগেই সতর্ক করেছিলেন, উৎপাদন স্বাভাবিক হলেও নভেল করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক মোবাইল ডিভাইস বাজারে। কারণ নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে ডিভাইস বাজারে চাহিদা কমেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণকে মহামারী রোগ ঘোষণা করেছে। মোবাইল ডিভাইসের গুরুত্বপূর্ণ দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে নভেল করোনাভাইরাসের তীব্র প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ উৎপাদন স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরলেও ভোক্তারা প্রযুক্তি পণ্যে ব্যয় বন্ধ করলে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আইফোন নির্মাতা অ্যাপল ফক্সকনের প্রধান গ্রাহক। চীনে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় আইফোন উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত মাসের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলার রাজস্ব আয়ের যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল, তা পূরণ সম্ভব হবে না। কারণ আইফোন উৎপাদনের জন্য তারা এখনো শতভাগ ফক্সকনের ওপর নির্ভরশীল। অ্যাপল এখনো প্রথম প্রান্তিকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
চীনভিত্তিক ডিভাইস ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব অ্যাপলের আইফোন ব্যবসা বিভাগের ওপরও পড়ছে। বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে অ্যাপলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চীনে আইফোনের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় তাদের আগাম পূর্বাভাসের তুলনায় রাজস্ব আয় অনেকাংশে কম হবে। প্রতিষ্ঠানটি স্বীকার করে নেয়, তাদের আইফোন উৎপাদন ও বিক্রি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী আইফোন সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।
অ্যাপল প্রথম কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, যা চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ার বিষয় স্বীকার করে নেয়। দেশটিতে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আইফোন উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। অ্যাপল জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ৪ কোটি ১০ লাখ ইউনিট আইফোন উৎপাদনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তা পূরণ সম্ভব হয়নি। কারণ ফক্সকনের কারখানায় টানা কয়েক সপ্তাহ আইফোন উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। উৎপাদন বিভ্রাটের কারণে সরবরাহ ও বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রেন্ডফোর্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে প্রযুক্তিপণ্য বাজারের চিত্র বদলে গেছে। শুরুতে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে মৃতের সংখ্যা লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এখন চীনের আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমলেও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ছে। ভয়াবহ এ পরিস্থিতিতে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে স্মার্টফোন উৎপাদন ১২ শতাংশ কমে ২৭ কোটি ৫০ লাখ ইউনিটে দাঁড়ানোর পূর্বাভাস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।