বিশ্বের শীর্ষ চুক্তিভিত্তিক চিপ নির্মাতা তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) লিমিটেড যুক্তরাষ্ট্রে নিজস্ব কারখানা নির্মাণ করছে। দেশটির অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে এ অ্যাডভান্সড চিপ কারখানার নির্মাণকাজ চলছে। টিএসএমসির অ্যারিজোনা কারখানায় ৫-ন্যানোমিটার ট্রানজিস্টার চিপ তৈরি করা হবে, যা আগামী কয়েক মাস তাইওয়ানের গ্রাহকদের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই জানানো হয়েছে।
টিএসএমসি মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপলের এ-সিরিজের প্রসেসর চিপ তৈরি করে আসছে। চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে তাইওয়ানে অনুষ্ঠিত এক মিটিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ যুক্তরাষ্ট্রে চিপ কারখানা নির্মাণের সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে। শিগগিরই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ টিএসএমসির অ্যারিজোনা কারখানা পূর্ণাঙ্গ রূপে চিপ উৎপাদনে যাবে। এটা নিশ্চিত নয়, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় কারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে স্টেট কিংবা ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের আর্থিক প্রণোদনা পেতে যাচ্ছে টিএসএমসি। তবে প্রতিষ্ঠানটির যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে স্টেট এবং বাণিজ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিপ কারখানা নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি কাজ। টিএসএমসি এরই মধ্যে তাইওয়ানের তাইনান অঞ্চলে নতুন একটি চিপ কারখানায় ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। কারখানাটি চলতি বছরই আইফোনের বিভিন্ন সরঞ্জাম উৎপাদন শুরু করবে।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা যায়, অ্যাপল ইন্টেলের পরিবর্তে নিজস্ব চিপ দিয়ে ম্যাক কম্পিউটার উৎপাদনে কাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, টিএসএমসির অ্যারিজোনা কারখানায় উৎপাদিত ৫-ন্যানোমিটার চিপ ম্যাক উৎপাদনে ব্যবহার করা হতে পারে।
টিএসএমসি গত ফেব্রুয়ারি মাসে মূলধনি ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণা দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, বিশ্বব্যাপী পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ফাইভজি সমর্থিত স্মার্টফোনের চাহিদা ও বিক্রি বৃদ্ধি তাদের ব্যবসায় বাড়তি মুনাফা যোগ করবে। যে কারণে চলতি বছর মূলধনি ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যবসা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
টিএসএমসি চলতি বছর মূলধনি ব্যয় বাড়িয়ে দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার নির্ধারণ করেছে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৪০০ কোটি থেকে দেড় হাজার কোটি ডলার মূলধনি ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত গত বছরজুড়ে প্রতিষ্ঠানটির মূলধনি ব্যয় ১ হাজার ৪৯০ কোটি ডলারে পৌঁছেছিল।
বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজারের নাজুক পরিস্থিতির কারণে কয়েক বছর ধরে খারাপ সময় পার করছে টিএসএমসি। এখন ফাইভজির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়েছে। দ্রুতগতির এ মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির সুবিধা পেতে দরকার ফাইভজি সমর্থিত স্মার্টফোন। যে কারণে স্মার্টফোনের চাহিদা বৃদ্ধির প্রত্যাশা করছে প্রতিষ্ঠানটি। সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে মূলধনি ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা বাড়াতে চাইছে টিএসএমসি। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে নিজস্ব চিপ কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ডাটা করপোরেশনের (আইডিসি) পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর বৈশ্বিক বাজারে স্মার্টফোনের সরবরাহ ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ১৪০ কোটি ইউনিটে পৌঁছবে। এর মধ্যে ১৯ কোটি স্মার্টফোন থাকবে ফাইভজি সমর্থিত। অর্থাৎ চলতি বছর মোট যতসংখ্যক ইউনিট স্মার্টফোন সরবরাহ হবে, তার ১৪ শতাংশই থাকবে ফাইভজি সমর্থিত। বিশ্বব্যাপী ফাইভজি ফোনের চাহিদা বৃদ্ধিকে মুনাফা আয়ের নতুন সুযোগ হিসেবে দেখছে টিএসএমসি।
টিএসএমসির গ্রাহক তালিকায় অ্যাপল ছাড়াও মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি কোয়ালকম ও চীনভিত্তিক হুয়াওয়ে রয়েছে। গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) টিএসএমসির রাজস্ব ১০ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৩৯ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যা ছিল প্রতিষ্ঠানটির প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে রাজস্ব আয় ১ হাজার ২০ কোটি থেকে ১ হাজার ৩০ কোটি ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দিয়েছিল টিএসএমসি। এছাড়া অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ১৬ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে ৩৮৮ কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য বিরোধের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে টিএসএমসি। কারণ চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি সিংহভাগ চিপ চীনে নির্মিত কারখানায় উৎপাদন করে আসছে। ভবিষ্যতে ব্যবসায় ঝুঁকি এড়াতে তাই যুক্তরাষ্ট্রে নিজস্ব চিপ কারখানা নির্মাণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এ বিষয়ে টিএসএমসি বা মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।