বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিতে দীর্ঘদিন ধরে মরিয়া হয়ে কাজ করছে চীন। এমনকি করোনা-পূর্ববর্তী চীনের অর্থনীতি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল দেশটির। কিন্তু এ ক্ষিপ্রগতিতে বাদ সাধে নভেল করোনাভাইরাস। দেশটিতে উত্পত্তি হলেও বর্তমানে এটির ভয়াবহতার সবচেয়ে বেশি শিকার যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনীতিকেও রীতিমতো বিধ্বস্ত করে দিয়েছে মরণঘাতী ভাইরাসটি। এ অবস্থায় করোনা-পরবর্তী পৃথিবীর নেতৃত্ব কার হাতে যাবে, সেটি নিয়ে এখন নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে এটি নিয়ে সংশয় থাকলেও একথা নিশ্চিত যে, প্রযুক্তি খাতে যে দেশ এগিয়ে থাকবে, তারাই আগামীর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। এ কারণেই বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেয়ার দীর্ঘদিনের বাসনাকে বাস্তবে রূপ দিতে এবার প্রযুক্তি খাতে বড় বিনিয়োগে যাচ্ছে চীন। শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনীতিতে প্রযুক্তি খাতের অবদান ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে কাজ করছে দেশটি। এজন্য ব্যাপক ভিত্তিতে তারবিহীন নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহারে যাচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতির দেশটি।
আগামী বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার চীনের এ বাসনা বাস্তবায়নের মূলে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজেই। এরই মধ্যে তিনি একটি মহাপরিকল্পনা নিয়েছেন। যে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগামী ছয় বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে প্রযুক্তি খাতে ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করা হবে। এজন্য নগর সরকার এবং হুয়াওয়েসহ প্রযুক্তি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপক ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে ফাইভজি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা চালু করা, ক্যামেরা ও সেন্সর ব্যবস্থা চালু করা, এআই প্রযুক্তি উন্নত করার মতো নির্দেশনা রয়েছে। যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করা যায় এবং শহরকেন্দ্রিক সবকিছু নজরদারির আওতায় আনা যায়।
প্রযুক্তি খাতে নতুন এসব অবকাঠামোর নেতৃত্ব দেবে মূলত আলিবাবা, হুয়াওয়ে ও সেন্স টাইম গ্রুপের মতো স্থানীয় জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান। যারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যুক্তরাষ্ট্রের খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে টেক্কা দিতে জোরেশোরে কাজ করছে। চীন সরকারের প্রযুক্তি জাতীয়তাবাদের এমন আগ্রাসী মনোভাবের মধ্য দিয়ে প্রযুক্তি খাতে বৈদেশিকনির্ভরতা কমে আসবে। একই সঙ্গে পরোক্ষভাবে এটি ২০২৫ সালের মধ্যে মেড ইন চায়না রূপরেখার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। যদিও চীনের এমন আগ্রাসী মনোভাবকে মোটেই ভালোভাবে নিচ্ছে না মার্কিন প্রশাসন। এ কারণেই বেইজিংয়ের এমন উত্থান ঠেকাতে এককাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছে ওয়াশিংটন। হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে এমনই একটি পদক্ষেপ হলো হুয়াওয়েসহ চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষিদ্ধ করা। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি মিত্র দেশগুলোর বাজারেও চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষিদ্ধ করতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে ওয়াশিংটন। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে মিত্র দেশগুলোকে কাছে টানতে এবং চীনবিদ্বেষী করার কাজে নেমেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ওয়াশিংটনের এমন প্রতিবন্ধকতাকে মোটেই আমলে নিচ্ছে না বেইজিং। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অতীতের মতো চীনকে বাধা দিতে সর্বাগ্রে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। ফেসিয়াল রিকগনিশন ক্যামেরা ও সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্প্রতি হংকংয়ে অফিস চালু করেছে ডিজিটাল চায়না হোল্ডিংস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মারিয়া ওক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন কার্যক্রম আগে যে ঘটেনি এমন না। কিন্তু এটা চীনের জন্য একটি রেস। যেখানে প্রযুক্তি খাতে চীন জয়ী হতে চায়। চলতি বছর চালু করলেও এরই মধ্যে তার প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখা শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।
প্রযুক্তি খাতে চীনের এমন উচ্চাভিলাষী বিনিয়োগের মূলে রয়েছে অর্থবছরে এ খাতে বড় বরাদ্দ রাখা। যেটি অনুমোদনের জন্য দেশটির আইনসভার স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। চলতি সপ্তাহেই এটিতে স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটির কমিউনিস্ট সরকার প্রযুক্তি খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে চলতি বছর ৫৬ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে পারে। যদিও মাও জেদং-পরবর্তী সময়ের মধ্যে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে চীন।
প্রযুক্তি খাতে চীনের এমন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অপরিহার্য হিসেবে রয়েছে দেশটির সবচেয়ে বড় ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ডাটা অ্যানালাইসিস প্রতিষ্ঠান আলিবাবা গ্রুপ হোল্ডিং লিমিটেড ও টেনসেন্ট হোল্ডিংস লিমিটেড। এছাড়া ফাইভজি প্রযুক্তি উন্নয়নে এরই মধ্যে হুয়াওয়েকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। পনি মা ও জ্যাক মাসহ অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও এ প্রক্রিয়ায় অংশীদার হিসেবে কাজ করছে।
প্রযুুক্তি, জ্বালানি, পণ্যবাজার, অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতের তথ্য প্রদানকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ নিউ এনার্জি ফিন্যান্সের (এনইএফ) গবেষণা বিভাগের প্রধান নানান কাও মনে করেন, চীনের এমন উদ্যোগ দেশটিকে প্রযুক্তি খাতে আরো অগ্রসর করবে। বিশেষ করে জিই এবং সিয়েন্সের মতো বৈশ্বিক জায়ান্টদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, একই সময়ে অন্যান্য দেশও কিন্তু বসে থাকবে না। অর্থনীতিকে টেনে তুলতেই অনেকেই এখন প্রযুক্তি খাতের ওপর নির্ভর করছে, যা এরই মধ্যে শুরু করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। ফলে চীনের এমন আয়োজন শেষ ফলাফল আসলে কী হবে, সেটি এখনই অনুমান করা সম্ভব না।