আমাদের বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের নামি-দামি মোবাইল ব্র্যান্ড রয়েছে। আচ্ছা, আপনাদের যদি এখন প্রশ্ন করা হয় যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় মোবাইল কমিউনিকেশন সমাধানকারী প্রতিষ্ঠান কোনটি। কোন মোবাইল ব্র্যান্ড ‘স্যামসাং’ এর পরেই সবচেয়ে বেশি মোবাইল ফোন উৎপাদন করে রেকর্ড গড়েছে এবং টেলিকমিউনিকেশন সমাধানের আড়ালে সবচেয়ে বেশি তথ্য পাচারের অভিযোগে বিতর্কিত কোম্পানিটির নাম কি। উত্তরটি হবে ‘হুয়াওয়ে’। অনেকে হয়তো আশ্চর্য হচ্ছেন, যে এই ব্র্যান্ডের ফোন তো আপনারাও ব্যাবহার করেছেন। যাই হোক আজ আপনারা জানতে চলেছেন এই ‘হুয়াওয়ে’ মোবাইল ব্র্যান্ডের ব্যাপারে কিছু অজানা ইতিহাস।
চলুন নিচে গিয়ে জেনে আসা যাক এর ব্যাপারে বিস্তারিতঃ⤵
‘হুয়াওয়ে’ বিশ্বের একমাত্র কোম্পানি, যেটি সবচেয়ে বড় টেলিকমিউনিকেশন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এই মূহুর্তে। এর পাশাপাশি ‘স্যামসাং’ এর সাথে পাল্লা দিয়ে, স্মার্টফোনের শেয়ার দখল করে আছে। ২০১৮ সালে ‘অ্যাপল’ ব্র্যান্ডকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়।
‘হুয়াওয়ে’ শব্দটির অর্থ ‘চাইনিজ এক্সিলেন্স’। ৭০ এর দশকে চায়নাতে টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম ছিলো অত্যান্ত দূর্বল। সারা বিশ্বের যোগাযোগ ব্যাবস্থা অত্যান্ত ক্ষীন থাকায় চাইনিজ সরকার টেলিকমিউনিকেশন ব্যাবস্থাকে আরও উন্নত করার প্রকল্প হাতে নেয়। ১৯৮৭ সালে ‘রেন জেং ফি’ এই ‘হুয়াওয়ে’র প্রতিষ্ঠা করেন শেঞ্জেং শহরে। শুরুর দিকে কোম্পানিটি একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে ৮.৫ মিলিওন ডলার লোন নিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
‘হুয়াওয়ে’ প্রথম দিকে শুধু ‘ফুল সুইচ’ উৎপাদন করতো। এরপর আস্তে আস্তে তাদের ব্যাবসাকে তারা প্রসারিত করে। যার মধ্যে রয়েছে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক বিল্ডিং, প্রোভাইডিং অপারেশন সার্ভিস, ইকুয়েপমেন্ট এন্ড এন্টারফেস সার্ভিস প্রোভাইডিং। এগুলো হতো চায়নার ভিতরে, এবং বাইরেও। সব স্থানেই তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলো।
সাথে আরও ছিলো মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এবং ওয়য়ারলেস। ১৯৯২ সালে ‘হুয়াওয়ে’ ব্যাক্তিগতভাবে তাদের নিজেদের সুইচবোর্ড তৈরী করতে সক্ষম হয়। মার্কেটে এর চাহিদাও ছিলো অনেক।
১৯৯৩ সালে ‘হুয়াওয়ে’ তাদের নিজস্ব ‘আরএনডি ল্যাব’ চালু করে। যাতে তারা সবচেয়ে বেশি রিসার্চ এবং ডেভোলপমেন্টের কাজ করে আসছিলো। বর্তমানেও তাদের রিসার্চ এবং ডেভোলপমেন্ট সেন্টার রয়েছে।
১৯৯৪ সালের দিকে শুরু করে ‘হুয়াওয়ে’ বেইজিং এবং সাংহাই’তে তাদের আবিষ্কৃত সব ধরনের টেলিকমিউনিকেশন সুবিধাগুলো চালু করতে সক্ষম হয়। যেটা সেই সময়ে চায়না’র একটি বিশাল বিপ্লব শুরু করেছিলো।
১৯৯৬ সালে এসে তারা তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক লাইন ধরতে সক্ষম হয়। যা ছিলো হংকং এর ‘অলবিএট’। ৯০ দশক এর শেষ দিকে এসে যখন পুরো পৃথিবীতে মোবাইল ফোন এর প্রচলন বাড়তে শুরু করলো, তখন ‘হুয়াওয়ে’ মোবাইল উৎপাদনের দিকে নজর না দিয়ে তাদের মোবাইলের নেটওয়ার্ক এর দিকে নজর দিয়েছিল। কারন সেই সময় মোবাইলের নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করার মত কোম্পানি ছিলো হাতে গোনা কয়েকটি। হুয়াওয়ের বর্তমান রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার অনেক বড় অ্যাসেট হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। এই রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের জন্যই তারা অনেকগুলো বড় পার্টনারশিপ ডিল করতে সক্ষম হয়েছিলো৷ যার মধ্যে রয়েছে মাইক্রোসফট, সান মাইক্রে সিস্টেম, মটোরোলা এবং ইন্টেল এর মত বড় বড় কোম্পানি। এর মাধ্যমে তারা চাইনিজ আর্মিদের টেলিকমিউনিকেশন বিল্ডিং এর কাজ ও পেয়ে যায়।
১৯৯৭ সালে নিজস্ব জিএসএম ইকুইপমেন্ট তৈরি করতে সক্ষম হয় ‘হুয়াওয়ে’। বর্তমানে ‘হুয়াওয়ে’তে রয়েছে এক লক্ষ আশি হাজার কর্মী।
‘হুয়াওয়ে’র রিচার্জ এবং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার রয়েছে আমেরিকা, কানাডা, ইন্ডিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং সুইডেনে। চায়নাতে ‘হুয়াওয়ে’র সবচেয়ে বড় রিচার্জ এবং ডেভলপমেন্ট সেন্টার রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের ১৭৫টি দেশে ‘হুয়াওয়ে’র ব্যবসা চালু আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ওয়ারলেস নেটওয়ার্ক কানেকশন এই হুয়াওয়ে’রই। টেলিকমিউনিকেশন খাতে ‘হুয়াওয়ে’র সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ‘এরিকসন’। ২০১২ সালে এই ‘এরিকসন’কে পিছনে ফেলে বিশ্বের এক নাম্বার টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান হয়েছিল ‘হুয়াওয়ে’। ২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত স্মার্টফোন উৎপাদনের দিক থেকে ‘অ্যাপল’কে পিছনে ফেলে বর্তমানে তারা দুই নাম্বারে রয়েছে। তাদের সামনে রয়েছে শুধুমাত্র ‘স্যামসাং’। এছাড়াও ২০১৮ সালে সেরা ৫০০ মোবাইল ব্র্যান্ডের তালিকায় ৭২নাম্বারে ছিলো এই ‘হুয়াওয়ে’ মোবাইল ব্র্যান্ড।
বিশ্বসেরা ৫০টি টেলিকমিউনিকেশন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, ৪৫টির সাথেই সরাসরি ব্যাবসা রয়েছে ‘হুয়াওয়ে’র সাথে। কারন, তারা ‘হুয়াওয়ে’র ইকুয়েপমেন্টের উপর নির্ভরশীল।
‘হুয়াওয়ে’র রয়েছে দুইটি সাবস্টিটিউড টেলিকোম্পানি। যেগুলোর নাম হচ্ছে ‘হাই সিলিকন’ এবং ‘হনর’৷ শুধুমাত্র চাইনিজ স্মার্টফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘হুয়াওয়ে’র অবস্থান ৪ নাম্বার এ। এর আগের তিনটি হচ্ছে ‘ভিভো, অপ্পো এবং হনর’। কিন্তু, যদি টেলিকমিউনিকেশন এবং স্মার্টফোন উৎপাদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করা হয়। সেক্ষেত্রে সবার চেয়ে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে ‘হুয়াওয়ে’।
‘হুয়াওয়ে’ মোবাইল ব্র্যান্ডটির সফলতার পাশাপাশি জড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বিতর্কতায়। এর কারনে প্রতিনিয়তই বাজার হারাচ্ছে এই কোম্পানিটি৷ ২০২০ সালের ১৫ই মে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’ এই ‘হুয়াওয়ে’র সব রকমের টেলিকমিউনিকেশন সেবাদান আমেরিকায় নিষিদ্ধ করেছে। তার কিছুদিন পরই ১৯ই মে গুগল তাদের প্লে স্টোর থেকে ‘হুয়াওয়ে’কে বাদ দিয়ে দিয়েছে। ‘হুয়াওয়ে’র আপকামিং কোনো প্রোডাক্ট ‘গুগল প্লে স্টোরে’র সেবা পাবেনা। এর পরেও কেনো তাহলে বাজারে টিকে রয়েছে ‘হুয়াওয়ে’।
উত্তরও রয়েছে এর। আসলে সারা পৃথিবী জুড়ে ১৯,৭৩০০০ কোম্পানি সরাসরি ‘হুয়াওয়ে’র ইকুয়েপমেন্ট ব্যাবহার করে তাদের ব্যাবসা পরিচালনা করে আসছে। পাশাপাশি গত বছর ২০০ মিলিওনের বেশি মোবাইল ফোন বিক্রি করে, রীতিমতো রেকর্ডের জন্ম দিয়েছে তারা। সারা পৃথিবীতে এই ‘হুয়াওয়ে’র রয়েছে অনেকগুলো ‘আরএনটি সেন্টার’। যেগুলো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্ভাবনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যদি ‘হুয়াওয়ে’ প্রতিষ্ঠানে ধস লাগে, তারপরেও তাদের এই ব্যাকআপ দিয়ে তারা টিকে থাকবে বাজারে।